২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

ইসরাতের সাফল্যগাথা

ইসরাত জাহান এখন বগুড়ার নামকরা উদ্যোক্তা
ছবি: সোয়েল রানা

সুই-সুতা আর রান্নাঘরের সঙ্গে ইসরাত জাহানের সখ্য স্কুলজীবন থেকে। আশির দশকে মাসে ৮০০ টাকা বেতনে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে খণ্ডকালীন চাকরি নেন। পরে বিমা কোম্পানির হিসাব বিভাগেও টানা কয়েক বছর চাকরি করেছেন।

১৯৯৯ সালে একবার রান্নাবিদ রাহিমা সুলতানার দেওয়া রেসিপি ছাপা হয় প্রথম আলোর নকশায়। সেটি পড়ে ঢাকায় গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন ইসরাত। রান্না শেখার আগ্রহের কথা জানান। রাহিমা বগুড়ায় রান্নার প্রশিক্ষণ কর্মশালা আয়োজনের পরামর্শ দেন তাঁকে। সেই শুরু ইসরাত জাহানের রান্না শেখা। রান্নার প্রশিক্ষণের আয়োজন করেন। তারপর শেখেন ব্লকপ্রিন্ট, বাটিক ও পোশাকের নকশার কাজ।

এরপর পেরিয়ে গেছে ২২ বছর। ইসরাত সুই-সুতার শৈল্পিক কারুকাজ আজও আগলে রেখেছেন সযতনে। তবে হরেক রকম খাবার বানানোর সেই নেশা আজও ছাড়তে পারেননি। সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে নারী ও পুরুষদের সৌন্দর্যচর্চাকেন্দ্রও (পারলার) খুলেছেন।

ইসরাত এখন বগুড়া শহরের প্রতিষ্ঠিত একটি ফ্যাশন হাউসের উদ্যোক্তা। অনেকটা শূন্য থেকেই আজ একজন সফল নারী উদ্যোক্তা। কয়েক কোটি টাকার পুঁজি খাটছে তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সুকন্যা ফ্যাশনে। বগুড়া শহরের অভিজাত এলাকা জলেশ্বরীতলায় সুকন্যা বিউটি অ্যান্ড স্পা এবং সুকন্যা জেন্টস ব্লু সেলুন অ্যান্ড স্পা চালু করেছেন। অচিরেই চালু হবে আরেকটি নতুন উদ্যোগ—রেস্তোরাঁ। তাঁর প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজ করছেন প্রায় ১৫০ জন কর্মী।

সম্প্রতি শহীদ আবদুল জোব্বার সড়কের সুকন্যা বিউটি অ্যান্ড স্পাতে বসে কথা হয় উদ্যোক্তা ইসরাত জাহানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘উদ্যোক্তা হয়ে উঠার পেছনে আমার অন্যতম প্রেরণা প্রথম আলোর ক্রোড়পত্র নকশা। এরপর নানা চড়াই–উতরাই পেরিয়ে আজ এখানে। এখনো প্রতি মঙ্গলবার নকশা পড়ি। সেখান থেকে জানতে পারি হালের রূপচর্চা আর ফ্যাশনধারা সম্বন্ধে।’

পুরোনো সেই দিনের কথা

কথা বলতে বলতে স্মৃতির কথা মনে পড়ে ইসরাত জাহানের। তিনি বলেন, ‘বগুড়ায় রান্নাবিষয়ক কর্মশালা আয়োজনের পাশাপাশি ব্লকপ্রিন্ট, বাটিক, টেইলারিংসহ পোশাকে সুই-সুতার শৈল্পিক কারুকাজেও ঝুঁকে পড়ি। একসময় নিজেই দেশি-বিদেশি রান্নার প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করি। নানা রকমের কেক বানিয়ে বিক্রি করতাম। আয় থেকে সঞ্চয় করতে থাকি। বউ সাজানোর শখ থেকে শহরের কাটনারপাড়া এলাকায় ছোট পরিসরে বিউটি পারলার দিই। পরে যুক্ত হয় বেকারি শপ। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’

তখন শহরে বিউটি পারলার ছিল হাতে গোনা দুয়েকটি। ঝুঁকি নিয়ে মোটা অঙ্কের পুঁজি বিনিয়োগ করেন। এখন বগুড়া শহরে এক নামেই পরিচিত সুকন্যা বিউটি পারলার। আগামী মাসে (সেপ্টেম্বর) এই পারলারে প্রথমবারের মতো শুরু হচ্ছে আয়ুর্বেদিক ট্রিটমেন্ট। ইসরাত জাহান বলেন, ‘শুধু নিজের ব্যবসাই দাঁড় করাইনি, বরং অন্য নারীদের দক্ষ করে তুলতেও কাজ করছি। ২০১৯ সালে বগুড়া শহরে চালু করেছি সৌন্দর্যচর্চা প্রশিক্ষণকেন্দ্র। আছে সুকন্যা স্কিল ডেভেলপমেন্ট ট্রেনিং সেন্টার। কারিগরি শিক্ষা বোর্ড অনুমোদিত এই রূপচর্চা প্রশিক্ষণ স্কুলটির কার্যক্রম বর্তমানে করোনার সংক্রমণের কারণে বন্ধ।’

নারীদের অনুপ্রেরণা

বগুড়া শহরে নানামুখী ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনায় সফল ইসরাত জাহান অন্য নারীদের জন্য এক অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছেন। অনেকেই তাঁকে দেখে উদ্যোক্তা হওয়ার সাহস পাচ্ছেন। ইসরাত জাহান বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সদস্য। মেকআপ, ত্বকের যত্ন, অ্যারোমা থেরাপি, হেয়ার কাটসহ নানা বিষয়ে ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ নানা দেশে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। প্রশিক্ষণ নিয়ে রান্নার হাতও যে ঠিকমতো পাকিয়েছেন, সেটা বোঝা যায় ২০০৫ সালে প্রাণ-প্রথম আলো জাতীয় আচার প্রতিযোগিতায় (মিষ্টি বিভাগ) দ্বিতীয় পুরস্কারের মাধ্যমে। এ ছাড়া রূপচাঁদা রান্না প্রতিযোগিতায় ২০১৬ সালে আঞ্চলিক পর্যায়ে প্রথম রানারআপ হয়েছিলেন ইসরাত জাহান।

ঘুরে দাঁড়ানোর অপেক্ষায়

ইসরাত জাহানের স্কুলে লেভেল-১ ও ২ নামে স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ চালু আছে। এ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি কোর্স আছে ব্লক, বাটিক, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ, কম্পিউটার প্রোগ্রামিং ইত্যাদি। জানা যায়, প্রায় দেড় বছর করোনাকালে বিয়েসহ সবধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান বন্ধ থাকায় পারলারের ব্যবসা প্রচণ্ড রকমের ধাক্কার মুখে পড়েছে। দীর্ঘ সময় পারলার বন্ধ থাকায় কর্মীদের বেতন দিতে হিমশিম খেতে হয়েছে। করোনার ধাক্কা কাটিয়ে পারলার ব্যবসা পুরোপুরি এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি, তবে চেষ্টা চলছে। পারলারের সঙ্গে শত শত কর্মীর জীবিকা জড়িয়ে আছে। ইসরাত তাই মনে করেন, এসএমই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা বা স্বল্প সুদে ঋণ দিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে সরকারের উদ্যোগ নেওয়া দরকার।

ইসরাত জাহান জানালেন উদ্যোক্তা হয়ে উঠার দীর্ঘ পথ পাড়ির এই সংগ্রামে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ পেয়েছেন স্বামীর কাছ থেকে। কোনো উদ্যোগেই তিনি বাধা হয়ে দাঁড়াননি, বরং সব সময় তিনি বন্ধুর মতো হাত বাড়িয়েছেন, যা এখনো অব্যাহত। ব্যবসার আয়ে সন্তানেরা বিদেশে পড়াশোনা করছেন। এক ছেলে ও এক েময়ের দুজনেই এখন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। বগুড়া লেডিস ক্লাব ও ইনার হুইল ক্লাবের সদস্য হয়ে সামাজিক কার্যক্রমেও যুক্ত ইসরাত জাহান।

ইসরাতের মতে, ব্যবসা মানেই ঝুঁকি। করোনার সংকট সেটা আরও ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছে। তবু থেমে গেলে চলবে না। নারীদের সাহস করে ঝুঁকিটা নিতে হবে।