ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে হামজা চৌধুরী
‘আপনি কি বাংলা বলতে পারেন?’
প্রশ্ন শুনে হাসির রেখা খেলে গেল দেওয়ান হামজা চৌধুরীর মুখে। সে রেখা মিলিয়ে যাওয়ার আগেই বলে উঠলেন, ‘জি অয়, আমি বাংলা মাত্তাম ফারি’!
তিনি যে বাংলা বলতে পারেন, তা যেন মুখ ফুটে বলেই প্রমাণ দিলেন। তবে এ–ও বললেন, তাঁর বাংলা বলাটা প্রমিত বাংলায় নয়; সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায়। এরপর বলে চলেন, ‘আমি তো বাঙালি। আমার আব্বা-আম্মা বাংলাদেশের। ২০ বারের বেশি বাংলাদেশে গিয়েছি। ছোটবেলায় আমাদের গ্রামে কাদার মধ্যে ফুটবল খেলেছি।’ ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের তরুণ এই ফুটবলারের কথা শুনে বিস্ময় জাগে।
দেওয়ান হামজা চৌধুরী। পেশাদার ফুটবলার। খেলেন দুনিয়ার সবচেয়ে দামি ও নান্দনিক ফুটবল আসর ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে। লেস্টার সিটি ফুটবল ক্লাবের মূল দলের মিডফিল্ডার তিনি। পাশাপাশি ওই ক্লাবের অনূর্ধ্ব–২৩ দলের অধিনায়কও। অথচ বয়স ছুঁয়েছে কেবল ২১ বছর। হামজার ফুটবল প্রতিভা সম্পর্কে জানান দিতে এটুকু তথ্যই তো যথেষ্ট!
১৪ অক্টোবর লন্ডনের একটি বাংলা সংবাদপত্রের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে এসেছিলেন উদীয়মান এই ফুটবলার। সেখানেই কথা হলো তাঁর সঙ্গে। সঙ্গে ছিলেন তাঁর বাবা দেওয়ান গোলাম মোর্শেদ চৌধুরী এবং মা রাফিয়া চৌধুরী।
ঝাঁকড়া চুলের হামজা
একটি বিশেষ কারণে হামজাকে নিয়ে ব্রিটিশ গণমাধ্যমে বেশ মাতামাতি। সেটি হলো মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল। সেই সঙ্গে এই তরুণ বাংলাদেশি পরিবারের সন্তান। যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশিদের অগ্রযাত্রার পথে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করা এই তরুণ নিজের বাঙালি পরিচয় নিয়ে গর্ববোধ করেন। যে কারণে পাশ্চাত্য ফুটবলের রঙিন দুনিয়ায় বাংলাদেশের নামটিও বারবার উচ্চারিত হচ্ছে।
ফুটবলের অভিজাত আসরে
হামজার সাফল্যের মর্যাদা বুঝতে হলে ইংলিশ ফুটবল লিগ সম্পর্কে ধারণা থাকা জরুরি। বিশ্বকাপ ফুটবলের বাইরে ফুটবল জগতের সবচেয়ে দামি আর উত্তেজনাপূর্ণ আসর ইংলিশ ফুটবল লিগ। এই লিগের মোট চারটি ধাপ। দেশের সেরা ২০টি ক্লাব নিয়ে হয় প্রিমিয়ার লিগ। দ্বিতীয় সারির ২৪টি ক্লাব খেলে চ্যাম্পিয়নশিপ। তারপরে যথাক্রমে ‘লিগ ওয়ান’ এবং ‘লিগ টু’। এই দুটি লিগেও ২৪টি করে ক্লাব। চার ধাপের মোট ৯২টি ক্লাবের সমন্বয়ে গঠিত ইংলিশ ফুটবল লিগের প্রতিটি ধাপই একটি আরেকটির সঙ্গে যুক্ত। প্রতিটি ধাপে সবচেয়ে খারাপ খেলা এক বা একাধিক দল নিচের ধাপে নেমে যায় (রেলিগেশন)। বিপরীতে নিচের ধাপের লিগে সেরা এক বা একাধিক দল পরবর্তী ধাপে উন্নীত হয় (প্রমোশন)। এসব লিগ পর্বের ক্লাবগুলো পেশাদার ক্লাব হিসেবে স্বীকৃত। এদের নিজস্ব স্টেডিয়ামসহ আনুষঙ্গিক নানা কিছু থাকতে হয়।
১৯৯২ সাল থেকে শুরু হওয়া প্রিমিয়ার লিগে এ পর্যন্ত ৪৯টি ক্লাব খেলার সুযোগ পেয়েছে। এর মধ্যে শিরোপা জিতেছে ৬টি ক্লাব। এগুলোর মধ্যে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড শিরোপা জিতেছে ১৩ বার। চেলসি ৫ বার, আর্সেনাল ও ম্যানচেস্টার সিটি ৩ বার করে এবং ব্ল্যাকবার্ন রোভার্স ও লেস্টার সিটি ১ বার করে চ্যাম্পিয়ন হয়। ২০১৬ সালে প্রিমিয়ার লিগ চ্যাম্পিয়ন হয় লেস্টার সিটি। এই ক্লাবের হয়ে গত মৌসুমে (২৮ নভেম্বর ২০১৭) হামজার অভিষেক ঘটে ইংলিশ ফুটবলের সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ আসরে। এবারও শীর্ষস্থানীয় এই ক্লাবের মূল দলে আছেন বাঙালি পরিবারের সন্তান হামজা চৌধুরী।
মোট ৩০ জনের সমন্বয়ে হয় ক্লাবের মূল দল। পারফরম্যান্সের ওপর মাঠে নামার বিষয়টি নির্ভর করে। আগস্ট থেকে পরবর্তী বছরের মে পর্যন্ত চলে প্রিমিয়ার লিগ মৌসুম। খেলা হয় কেবল সাপ্তাহিক ছুটির দিনে।
অনূর্ধ্ব ২৩ দলের অধিনায়ক
লেস্টার সিটির অনূর্ধ্ব–২৩ দলের অধিনায়ক হামজা চৌধুরী। কিন্তু মাঠের ক্ষিপ্রতায় বয়সের সীমা ডিঙিয়েছেন তিনি। গত মৌসুমে লেস্টার সিটির হয়ে প্রিমিয়ার লিগের মোট আটটি ম্যাচ খেলেন। এর আগে ২০১৫-১৬ মৌসুমে বার্টন অ্যালভিয়ন হামজাকে ভাড়া করে (লোন) নিয়ে যায়। ক্লাবটির পক্ষে ১৮ বছর বয়সেই খেলেন লিগ ওয়ান। ভালো খেলে ক্লাবটি ওই বছর চ্যাম্পিয়নশিপে উন্নীত হয়। পরের বছর বার্টন অ্যালভিয়ন আবারও হামজাকে ভাড়ায় নিয়েছিল চ্যাম্পিয়নশিপ খেলতে।
ইংল্যান্ড জাতীয় দলের জন্যও খেলছেন হামজা। চলতি বছরের ২৬ মে অনূর্ধ্ব–২১ জাতীয় দলে তাঁর অভিষেক। ইতিমধ্যে মেক্সিকো, বাহরাইন, আলজেরিয়া, রাশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশের বিপক্ষে মাঠে নেমেছেন।
যেভাবে শুরু
‘হামজার জন্ম লাফবারা শহরে। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে সবার বড়। ছোটবেলা থেকেই বেশ দুরন্ত ছিল সে। আর ফুটবলের প্রতি ছিল বেশ ঝোঁক। যে কারণে চার বছর বয়স থেকেই ফুটবল খেলতে নিয়ে যেতাম।’ বলছিলেন হামজার মা।
পাঁচ বছর বয়সে হামজাকে লাফবারা ফুটবল ক্লাবে ভর্তি করা হয়। তখনই নিজের চেয়ে বয়সে দু-এক বছরের বড়দের সঙ্গে খেলত হামজা। ছয় বছর বয়সে এক ম্যাচ খেলতে গিয়ে ফুটবল ক্লাব নটিংহাম ফরেস্টের খেলোয়াড় অনুসন্ধানী দলের নজরে পড়ে হামজা। কয়েক দিন পর অন্য একটি ম্যাচে লেস্টার সিটির অনুসন্ধানীরাও তার দিকে দৃষ্টি ফেলে। উভয় দলই তাকে নিতে চায়।
হামজার বাবা দেওয়ান গোলাম মোর্শেদ চৌধুরী বললেন, ‘তখন দুই দলই আমাদের বিনা মূল্যে টিকিট দিত খেলা দেখার জন্য।’ শেষ পর্যন্ত তাঁরা লেস্টার সিটিতে হামজাকে ভর্তি করান। স্কুল ছুটির পর সপ্তাহে দুদিন করে প্রশিক্ষণ। আর শনি ও রোববার থাকত ম্যাচ। এ কারণে তাঁরা লেস্টার শহরে চলে যান পরিবারসহ।
২০১৩ সালে জিসিএসই (বাংলাদেশে এসএসসি) সম্পন্ন করার পর লেস্টার সিটি একাডেমিতে দুই বছরের বৃত্তি পায় হামজা। ফুটবল প্রশিক্ষণের পাশাপাশি পড়াশোনারও দায়িত্ব নেয় তারা। সাধারণত ১৮ বছর বয়স হলেই পেশাদার ফুটবলার হিসেবে চুক্তি করতে হয়। মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, ‘একটি বড় ক্লাব হামজাকে নেওয়ার প্রস্তাব করে। এর বিনিময়ে বড় অঙ্কের অর্থ দেওয়ার পাশাপাশি পুরো পরিবারের দায়িত্ব নেওয়ারও প্রস্তাব করে। কিন্তু লেস্টার সিটি একাডেমির সঙ্গে বৃত্তির চুক্তির কারণে সেই সুযোগ গ্রহণ করা যায়নি।’
বাংলাদেশের প্রতি আছে ভালো লাগা
ছয় মাস বয়স থেকে পরিবারের সঙ্গে হামজার বাংলাদেশে যাতায়াত শুরু। সর্বশেষ তিন বছর আগে বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন হামজা। বাংলাদেশে হামজাদের বাড়ি হবিগঞ্জের বাহুবল থানার স্নানঘাট গ্রামে। পেশাদার খেলোয়াড় হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পর প্রশিক্ষণ ও খেলার চাপ বেশ বেড়ে গেছে। সপ্তাহে পাঁচ দিন সকাল সাড়ে নয়টা থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত প্রশিক্ষণ। থাকে ম্যাচ। ফলে বেড়ানোর সুযোগ হয়ে ওঠেনি। তবে সুযোগ পেলেই বাংলাদেশে যেতে চান এই ফুটবল তারকা।
তখন মনে পড়ল প্রিমিয়ার লিগে অভিষেকের পর ব্রিটিশ গণমাধ্যমকে বলা হামজার কথাগুলো। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার বাবা-মা দুজনেই বাংলাদেশি। আমার পরিবার বিশাল। বাংলাদেশিদের পরিবার সবখানে। যেকোনো আনন্দ কিংবা দুঃখের ঘটনায় সবাই একত্র হয়ে যায়।’ সত্যিই তো তা-ই!