আব্বুর পড়ার ঘরটা অন্ধকার দেখি
২০ জুন বাবা দিবস। করোনাকালে অনেকেই তাঁদের বাবাকে হারিয়েছেন। সাধারণ থেকে বিখ্যাত সব বাবাই সন্তানদের হৃদয়ে বিশেষ জায়গায় থাকেন। ব্যস্ত ও খ্যাতিমান বাবা সন্তানের কাছে কেমন ছিলেন? করোনাকালে হারিয়ে যাওয়া এক বাবা সাংবাদিক মিজানুর রহমান খানকে নিয়ে লিখেছেন তাঁর সন্তান
আব্বু কাজের সুবাদে নিয়মিত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে যেতেন। অনেক সময় তাঁদের সঙ্গে পারিবারিক গল্প হতো। আমাদের (সন্তান) প্রসঙ্গে কেউ কিছু জানতে চাইলে অনেকটা গোলকধাঁধায় পড়ে যেতেন আমার বাবা। আম্মুকে ফোন করে জানতে চাইতেন, ‘ওরা যেন কোন ক্লাসে পড়ে?’
অনেক সময় আমার নামটাই ভুলে যেতেন আব্বু। আমার কথা শুনে ভালোবেসে অনেকেই তাঁর হাত দিয়ে আমাকে বই উপহার দিতেন। সেখানে আমার নাম লিখে অটোগ্রাফও দিতেন। বাসায় ফিরে বইটা আব্বু যখন আমার হাতে দিতেন, আমি খুলে দেখতাম আমার প্রকৃত নামটাই সেখানে লেখা নেই! আব্বুকে বলার পর সেই সরল হাসি দিয়ে বলতেন, ‘ওহো, আমি তো আপনার নাম ভুলে গিয়েছিলাম মাম্মি।’
আমার আব্বু প্রয়াত সাংবাদিক মিজানুর রহমান খানকে যাঁরা চিনতেন সবাই জানেন, তিনি সবাইকে আপনি বলে ডাকতেন। তাঁর সেই অভ্যাস বাসাতেও ছিল। আমাকেও আব্বু আপনি করে ডাকতেন। বিদেশে গেলে সেখান থেকে ফোন করতেন, ‘তাসনিম মাম্মি, আপনার জন্য কী আনব?’ আব্বু ভালোবেসে আমাকে তাসনিম মাম্মি ডাকতেন।
একবার রাশিয়া গিয়েছিলেন। আমি ছবি আঁকতে ভালোবাসি দেখে তিনি একটা বড় দোকানে গিয়ে আমাকে ফোন দিলেন, ‘মাম্মি একটা বড় দোকানে এসেছি। আপনার জন্য কী আনব বলেন।’ আমিও বোকার মতো, একটা লম্বা তালিকা দিলাম। যেসব উপকরণ দেশে সাধারণত পাওয়া যায় না, সেগুলোই আনতে বললাম। একে তো রুশ ভাষা বোঝা মুশকিল, তার ওপর ব্র্যান্ডের দোকান। আব্বু সেবার অনেক টাকা খরচ করে ফেলেছিলেন আমার ওই জিনিসগুলো কিনতে। দেশে ফিরে আমার হাতে সেসব দিয়ে বলেছিলেন, ‘ভাইদের বইলেন না এত টাকা খরচ করেছি এগুলোর জন্য। ওদের মন খারাপ হতে পারে।’
এত ব্যস্ত সাংবাদিক ছিলেন, তারপরও আমাদের ছোট ছোট অনেক বিষয়েই তাঁর আগ্রহ দেখে আমরা অবাক হয়ে যেতাম। এমন অনেকবারই হয়েছে আমরা টানা অনেক দিন আব্বুকে দেখিনি অথচ তিনি বাড়িতেই থাকতেন। সকালে বের হয়ে আব্বু বাসায় ফিরতেন গভীর রাতে। আমরা হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছি। তারপরও স্কুলে আমার কোনো অনুষ্ঠান থাকলে আব্বু সেটা মিস করতেন না। কোনো বিশেষ দিনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেব শুনলে আব্বু ব্যাপক উৎসাহ দেখাতেন। বাসার সবাইকে নিয়ে সেই অনুষ্ঠান দেখতে চলে যেতেন।
আমার ‘ও লেভেল’ পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের দিন আব্বুর সে কী উৎকণ্ঠা। বারবার এসে জিজ্ঞাসা করছেন, ‘রেজাল্ট পেলেন মাম্মি?’ এদিকে তাঁর অফিসে যেতে হবে। তিনি শার্ট-প্যান্ট পরে তৈরি হচ্ছেন, আবার এসে জিজ্ঞাসা করছেন। রেজাল্ট দেখতে আমিও অনলাইনে বারবার রিফ্রেশ দিচ্ছি আর চেষ্টা করছি। আর আব্বু পায়চারি করছেন। এরপর যখন রেজাল্ট পেলাম, আব্বু শিশুর মতো হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বললেন, ‘কী রেজাল্ট? আমি কি বসব মাম্মি?’ রেজাল্ট জানানোর পর আব্বু খুশিতে হুলুস্থুল কাণ্ড শুরু করলেন।
আব্বু পরিবারের পাশে থাকতেন ছায়ার মতো। প্রতিবার আমার জন্মদিনের সকালে রুমে এসে আব্বু ঘুম ভাঙাতেন। আমার ১৮তম জন্মদিনে বাইরে নিয়ে গেলেন কেনাকাটা করে দিতে। বাবার সঙ্গে বাইরে গেলেও বেশ মজা হতো। তিনি হয়তো কোনো দোকানে গেলেন, হঠাৎ দোকানি সালাম দিলেন আব্বুকে। তারপর হয়তো বললেন, আপনার কথা টিভিতে খুব মনোযোগ দিয়ে শুনি। নিজে খুব লেখাপড়া না জানলেও আপনার লেখা পড়ি।
কেনাকাটা করলে দামও বেশি রাখতেন না আব্বুকে দেখে। এত মানুষ তাঁকে ভালোবাসে দেখে গর্ব হতো। আব্বু বলতেন, ‘যেটা করবেন, মন দিয়ে করতে হবে। তাহলেই সেখানে ভালো করতে পারবেন।’
আব্বু যখন করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে, আমরাও তখন বাসায় করোনাক্রান্ত। আমাদের করোনা নেগেটিভ হওয়ার পর হাসপাতালে গেলাম, আব্বু আইসিইউতে (নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র) আছেন। একদিন রাতে গিয়ে দেখি তিনি কিছুতেই খেতে চাচ্ছেন না। আমি ঢোকার পরই শিশুর মতো আমাকে ডাকতে শুরু করলেন, ‘মাম্মি, আপনি আমাকে খাওয়ায়ে দেন।’ আমি তাঁকে খাওয়ালাম। এরপর কিছুতেই সেখান থেকে আসতে দেবেন না। আইসিইউর ভেতরে তো বেশিক্ষণ থাকা সম্ভব নয়। তাঁকে বুঝিয়ে বললাম আমি বাইরে আছি। তারপরও আব্বু বের হতে দেবেন না, ‘যেয়ো না, যেয়ো না।’ ছোটবেলা যে হাত শক্ত করে ধরে স্কুলে যেতাম, সেই হাত তখন ছাড়িয়ে দিতে আমারও কি কম কষ্ট হচ্ছিল! আব্বু চলে যাওয়ার পর থেকে এই কথাই বেশি কানে বাজছে।
বাসায় আমার রুমের মুখোমুখি আব্বুর পড়ার ঘর। রাতে একটু পরপর উঠে আসতেন, জিজ্ঞাসা করতেন কী করছি। আমার রুমের দরজাও খোলা থাকত। এখনো দরজা খোলা থাকে। তবে আব্বু আসেন না। ঘর থেকে বাইরে তাকালে এখন আব্বুর পড়ার ঘরটা অন্ধকার দেখি। আব্বুকে দেখি না।
লেখক: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক প্রয়াত মিজানুর রহমান খানের মেয়ে