মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি বাহিনীর কাছেই জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলার কামালপুর ছিল কৌশলগত রণক্ষেত্র। ১৯৭১ সালে দীর্ঘদিন ধরে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়ছে এই কামালপুরে। তাৎপর্যপূর্ণ কামালপুরের যুদ্ধ পড়ানো হয় বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের বিভিন্ন সামরিক প্রশিক্ষণকেন্দ্রের পাঠ্যসূচিতে। সে রণাঙ্গণেই পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের নায়ক হয়ে আছেন বশির আহমেদ।
পাকিস্তানি ক্যাম্পে কে যাবে আত্মসমর্পণের চিঠি নিয়ে?
ভারতীয় মিত্রবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার হরদেব সিং ক্লের প্রশ্নটি করলেন। সীমান্তঘেঁষা ভারতীয় গ্রাম ব্রাহ্মণপাড়ায় তখন যৌথবাহিনীর হাজারো সদস্য উপস্থিত, যাঁরা মৃত্যুকে হাতে নিয়েই যুদ্ধের ময়দানে। কয়েক ঘণ্টা আগেও সম্মুখসমরে বীরত্ব দেখিয়েছেন তাঁরা। তবু এই প্রশ্নে তাঁদের মুখাবয়বে অনিশ্চয়তা। হাসিমুখে এমন নিশ্চিত মৃত্যুকে বরণ করতে কে চায়?
ব্রিগেডিয়ার ক্লের যখন প্রশ্নটা দ্বিতীয়বার করলেন, ঠিক তখনই মুক্তিবাহিনীর এক কিশোর যোদ্ধা বলে উঠলেন, ‘আমি যাব।’ সেই কিশোর যোদ্ধা বশির আহমেদ।
১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বরের সেই ক্ষণটা যেন জ্বলজ্বল করে উঠল তাঁর চোখে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় বসে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তাই একেবারে অন্য মানুষ হয়ে উঠলেন বশির আহমেদ, বীর প্রতীক। অবসরপ্রাপ্ত বিজিবির সদস্য। ঢাকার পিলখানায় এসেছিলেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহান বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে। ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে বাড়ি ফেরার তাড়া নিয়ে বেরিয়েছিলেন। জিগাতলা থেকে মহাখালী যাবেন। যাত্রাসঙ্গী হলাম। গাড়িতে বসে শুনলাম যুদ্ধদিনের কথা।
হাতে সাদা পতাকা, পকেটে চিঠি
ব্রাহ্মণপাড়া থেকে কয়েক শ মিটার দূরেই কামালপুর বিওপি (বর্ডার আউট পোস্ট)। বর্তমান জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলার ভারত সীমান্তবর্তী এলাকা এই কামালপুর। বিওপিটি ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্প। এই ক্যাম্প থেকে ভারতের মহেন্দ্রগঞ্জের অবস্থান মাইলখানেক দূরে। অনেকেরই জানা, মুক্তিযুদ্ধে ১১ নম্বর সেক্টরের সদর দপ্তর ছিল মেঘালয় রাজ্যের এই মহেন্দ্রগঞ্জ। তাই কৌশলগতভাবে দুই পক্ষের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ ছিল কামালপুর বিওপি। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর এখানে রক্তক্ষয়ী অনেক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। এমন এক যুদ্ধেই পা হারান কর্নেল আবু তাহের।
১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর। ক্রমাগত অভিযানে সেখানে তখন অবরুদ্ধ হয়ে আছে পাকিস্তানি বাহিনী। সকালে হরদেব সিং ক্লেরের কাছ থেকে নেওয়া আত্মসমর্পণের চিঠি পকেটে এগিয়ে গেলেন বশির আহমেদ। ক্যাম্পের সামনের রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালেন। তাঁর হাতে সাদা পতাকা। পতাকা নাড়ালেন। কিন্তু শত্রুপক্ষের ক্যাম্পের ভেতর থেকে কোনো সাড়া পেলেন না।
তখন নিশ্চয়ই ভয়াবহ অনিশ্চয়তায় পড়ে গেলেন! প্রশ্নটা শুনে বশির আহমেদ বলেন, ‘বাপু, মরণ স্বীকার কইরাই তো চিঠি নিয়া গেছি। তখন আর ভয় করে নাই।’
একসময় ক্যাম্পের ভেতরে তাঁকে ডাকল পাকিস্তানি বাহিনী। যেতে যেতে মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল সম্ভাব্য বিপদের কথা। তিনি ক্যাম্পের ভেতরে গেলেন। যা ভেবেছিলেন, ঠিক তার বিপরীত আচরণ পেলেন কোণঠাসা পাকিস্তানি বাহিনীর কাছ থেকে। তাঁকে বসতে দেওয়া হলো। রুটি-ডাল দিয়ে আপ্যায়ন করা হলো। চিঠি পৌঁছে দিলেন বিওপির কমান্ডার ক্যাপ্টেন আহসান মালিকের হাতে।
বশির আহমেদ বলেন, ‘আমি তো খাইতেই চাই নাই। জোর করল অনেক। পরে খাইলাম। তারপর অনেকক্ষণ বসে থাকলাম।’
চিঠির বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেও সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না পাকিস্তানি বাহিনী। অনেক সময় গড়াল। এরই মধ্যে মিত্রবাহিনীর চারটি যুদ্ধবিমান হামলা শুরু করল। বশির আহমেদকে বাংকারে ঢোকানো হলো। কয়েকজন সৈনিক হতাহত হলো। পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল আরও ভেঙে গেল।
এরই মধ্যে মুক্তিবাহিনীর আরও একজন এলেন আত্মসমর্পণের চিঠি হাতে। তিনি আনিসুর রহমান। সহযোদ্ধাদের কাছে সঞ্জু নামে পরিচিত।
‘সঞ্জুর কাছে শুনলাম, অনেকে ভাবছে আমারে মাইরা ফেলছে। তারে পাঠাইছে আরও কঠিন ভাষায় লেখা আত্মসমর্পণের চিঠি হাতে।’ বলছিলেন বশির আহমেদ।
দ্বিতীয় চিঠি পেয়েও কালক্ষেপণ করছিল পাকিস্তানি বাহিনী। আবারও বিমান হামলা করে যৌথবাহিনী। অবস্থা বেগতিক দেখে এবার আত্মসমর্থনের সিদ্ধান্ত নেয় পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন আহসান মালিক। তবে আত্মসমর্পণের আগে তিনি কথা বলতে চাইলেন। মালিকের এই বার্তা নিয়ে বশির আহমেদ ছুটে এলেন ব্রাহ্মণপাড়ায়।
‘যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই একজন ক্যাপ্টেন আমাকে আদর করে তাঁর ঘাড়ে তুলে নেন। সবাই খুব খুশি তখন। আমি চিঠিটা ব্রিগেডিয়ার সাবের হাতে দিই। ওদিকে সঞ্জু (বীর প্রতীক) ক্যাম্পেই থেকে যায়।’ বলে যান বশির আহমেদ।
এরপর দুই পক্ষের আলাপ চলল ঘণ্টাখানেক। সন্ধ্যার পর যুদ্ধরীতি মেনে শুরু হলো আত্মসমর্পণপর্ব। আহসান মালিকসহ ১৫০ জনের বেশি নিয়মিত বাহিনীর সদস্য, ৩০ জনের ওপর রেঞ্জার ও মিলিশিয়াসহ বেশ কিছু স্থানীয় রাজাকার আত্মসমর্পণ করল যৌথবাহিনীর কাছে। ৪ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হলো কামালপুর। পতাকা উঠল স্বাধীন বাংলাদেশের। অমর হলো কিশোর যোদ্ধা বশির আহমেদ ও প্রয়াত আনিসুর রহমানের নাম।
যুদ্ধ তিনি করবেনই
মুক্তিযুদ্ধের সময় বশির আহমেদ ধানুয়া কামালপুর কো-অপারেটিভ উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র। এপ্রিল মাস। পরিচিত অনেকেই যুদ্ধে গেছেন। সীমান্তের ওপারের মহেন্দ্রগঞ্জেই ভর্তি করানো হচ্ছিল নতুনদের। গেলেন ১৫ কি ১৬ বছরের বশির আহমেদও।
সেখানে সোলায়মান হক নামে তাঁর এক শিক্ষক নতুন সদস্য বাছাইয়ের প্রাথমিক কাজটি করছিলেন। বশির আহমেদকে দেখে তিনি বললেন, ‘তুই তো অনেক ছোট মানুষ। পারবি না। চলে যা।’ মন খারাপ করে চলে এলেন বশির আহমেদ। কিন্তু মনের ভেতর তাড়নাটা রয়েই গেল।
মে মাসের দিকে নতুন সদস্য নেওয়া হচ্ছে শুনে আবার গেলেন। সোলায়মান হক আবার একই কথা বললেন। এবার নাছোড়বান্দা বশির আহমেদ, ‘স্যারকে বললাম, আমি মরা-বাঁচা নিয়ে চিন্তা করি না। আমি যুদ্ধে যাবই।’ তাঁর অবিচল মনোবল দেখে ফেরাতে পারলেন না সোলায়মান হক।
সেই অবিচল মনোভাবের সত্য গল্প তো এখন কিংবদন্তি।
তথ্যসূত্র: জামালপুর জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, গতিধারা এবং কামালপুর ১৯৭১: সম্মুখযোদ্ধা এবং ভারতীয় ও পাকিস্তানি সমর বিশেষজ্ঞদের কথা, প্রথমা প্রকাশন