ধড়ফড় করে বিছানা থেকে উঠে পড়লাম। তখনো আতঙ্কিত কণ্ঠে কে যেন বলে চলেছে, ‘আগুন, আগুন’। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি রাত ৫টা ২০। তড়িঘড়ি করে জানালার পাশে যাই। কোথায় আগুন, সেটা বোঝার চেষ্টা করি। কিন্তু কোথাও আগুন দেখি না, তবে মানুষের চিৎকার শোনা যাচ্ছিল। ঠিক তখনই বাসার পাশের মসজিদ থেকে মাইকে ঘোষণা এল, ‘আগুন লেগেছে, আগুন লেগেছে। ‘‘আশ্রয়’’-এ আগুন লেগেছে।’ আমরা কয়েকজন মিলে যে ভাড়া বাড়িটায় থাকি সেটার নামই ‘আশ্রয়’! কথাটা শুনে মনে হচ্ছিল পায়ের তলা থেকে মেঝে সরে যাচ্ছে। তখন একটাই ভাবনা মাথায় চাপল, বাসা থেকে কীভাবে বের হব।
আমার রুমের দরজা খুলে দেখি, অন্যরা সবাই খাবার রুমে ছোটোছুটি করছে। আবছা অন্ধকারেও সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমাদের বাসায় নাকি আগুন লাগছে?’
কে যেন বলল, ‘হ্যাঁ।’
বাসাটা ছিল সাততলা একটি ভবন। পাশের দুটি ভবন চারতলা আর পাঁচতলা। চাইলেও অন্য ভবনে যাওয়ার উপায় নেই। আমার সঙ্গে যারা থাকে, তাদের বললাম, ‘তাহলে চল আমরা বের হয়ে যাই।’ ওরা বলল, ‘না আপু, আগুন সিঁড়ির গোড়ায় লাগছে বের হওয়া যাবে না।’ তবু আমি চেষ্টা করলাম বের হওয়ার জন্য। দরজা খুলতেই দেখি, সিঁড়িটা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। শ্বাস নেওয়া যাচ্ছে না।
ধাম করে দরজা বন্ধ করে ফিরে এলাম। কী করব বুঝতে পারছিলাম না। বাইরের পরিস্থিতি দেখে কাঁদছিলাম। মনে মৃত্যুভয় ভর করল। বাইরের চিৎকার চেঁচামেচি ক্রমেই বাড়ছে। মা-বাবা, ভাইবোন সবার কথা মনে হচ্ছিল। অন্যরা সান্ত্বনা দিচ্ছিল কাঁদবেন না, ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা চলে আসবে কিছুক্ষণের মধ্যেই।
আমাদের ফ্ল্যাট থেকে কিছু দেখা যাচ্ছিল না। তাই বুঝতে পারছিলাম না আগুন কতটুকু ধরেছে বা কী। শুধু মনে হচ্ছিল, এখনই দরজায় আগুন লাগবে। তাই সবাই আমরা পেছনের বারান্দায় চলে যাই। সেখানে গিয়ে শুনি সামনের বাসার কে একজন বলছেন, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি এদিকে আসতে পারছে না। ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন বাসা থেকে মাত্র দুই মিনিটের পথ। কিন্তু তখন রাস্তায় কাজ চলছিল বলে ঘুরে আসতে হয়েছে। এ কথা শুনে শেষ ভরসাটুকুও যেন নিভে গেল।
বাসার আরও দুজন কাঁদতে শুরু করল। অন্য ফ্ল্যাটে সবার আর্তচিৎকার শুনে মনে হচ্ছিল এই বুঝি পুড়ে গেলাম। উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে যাই দরজার দিকে, সাহস করে দরজা খুলে দেখি কেউ মনে হয় সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠছে। দম বন্ধ হয়ে আসছিল। ধোঁয়ায় শ্বাস নিতে পারছিলাম না। ভেতরে এসে বললাম, ‘চল আমরা ছাদে যাই।’ কিন্তু ওরা বলল যাবে না। আমি একাই বেরিয়ে গেলাম। সিঁড়ির ধাপগুলো দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল, সব কটি ধাপ মুখস্থ। মুখে কাপড় চেপে এক দৌড়ে ছাদে চলে যাই।
ছাদে গিয়ে দেখি, বাসার প্রায় সবাই সেখানে। ভয়ে হাত-পা এমনভাবে কাঁপছিল যেন মুহূর্তে পড়ে যাব। তখনই এক খালাম্মা এসে বললেন, আগুন প্রায় নিভে গেছে। তখন ৫টা ৫৫ মিনিট। এই কিছুক্ষণ সময় মনে হয়েছিল কতটা বছর।
সকাল হতেই আমরা অনেকেই বাড়িতে চলে গেলাম। সেই অগ্নিকাণ্ডের ভয়জাগানিয়া ঘটনা মনের ভেতর দগদগে ক্ষতের মতো হয়ে থাকল অনেক দিন। তখন হঠাৎ করেই মনে হতো পোড়া গন্ধ পাচ্ছি। ঘুমের মধ্যে হঠাৎ করে জেগে উঠতাম। নিজের অজান্তেই হাত দেয়ালে চলে যেত, মনে হতো দেয়ালটা কেমন যেন গরম লাগছে! সেই থেকে আগুনের ভয়টা মনের মধ্যে গেঁথে গেছে।
মাহযাবিন আনোয়ার
কুমিল্লা