আকাশছোঁয়া অবদান, তবু বঞ্চনা
নারী পোশাকশ্রমিকদের নিয়ে কারখানার মালিকদের অভিমত, পুরুষদের তুলনায় নারীরাই বেশি ‘দক্ষ’ ও ‘নিষ্ঠাবান’। তবে অভিযোগ আছে, এই নারী শ্রমিকেরাই মজুরিবৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। কর্মক্ষেত্রে হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হন প্রতিনিয়ত। আর কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নত না হওয়ায় যেকোনো দুর্ঘটনায় নারীদেরই জীবন দিতে হচ্ছে সবচেয়ে বেশি।
তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ১৯৮৪-৮৫ অর্থবছরে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে আয় হয় ১১ কোটি ডলার। সর্বশেষ ২০১২-১৩ অর্থবছরে এই আয় দুই হাজার ১৫১ কোটি ডলারে গিয়ে দাঁড়ায়। আর এই সাফল্যের নেপথ্যের কারিগর হচ্ছেন শ্রমিকেরা। বর্তমানে পোশাকশিল্পে কাজ করছেন ৪০ লাখ শ্রমিক, যার প্রায় ৮০ শতাংশ আবার নারী।
গত ৩০ বছরে পোশাকশিল্পের এই অগ্রগতির জন্য সবচেয়ে বেশি অবদান নারী শ্রমিকদের, এ কথা কমবেশি সবাই স্বীকার করেন। বিপুলসংখ্যক এই নারীর কর্মসংস্থান ও ক্ষমতায়নের কথা বলে বিজিএমইএর নেতারা প্রায় সময়ই কৃতিত্ব নেন। তবে তাঁরা নারীদের কর্মপরিবেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টি বরাবরই কম গুরুত্ব দিয়ে দেখেছেন। এর মধ্যেই ঘটে গেছে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দুই শিল্প দুর্ঘটনা—তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ড ও রানা প্লাজা ধস।
গত বছরের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধসে এক হাজার ১৩৪ জন পোশাকশ্রমিক নিহত হন। ভবনধসের ১০০ দিন পূর্তি উপলক্ষে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, নিহত শ্রমিকদের মধ্যে ৮৩৪ জনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। এর মধ্যে পুরুষ ৩৭১ ও নারী ৪৬৩ জন। এ ছাড়া নিখোঁজ ৩৩২ জনের মধ্যে ২৩৩ জনই নারী। অন্যদিকে, ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর রাতে তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ডে নিহত ১১২ জনের মধ্যে নারীর সংখ্যাই বেশি।
তাজরীন ও রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট মহলের টনক নড়েছে। বিদেশি ক্রেতা ও ব্র্যান্ডদের গঠিত দুই জোট—অ্যার্কড ও অ্যালায়েন্স কর্মপরিবেশ উন্নত করতে কারখানা পরিদর্শনের কাজ শুরু করছে। সরকার ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এ বিষয়ে কাজ করছে।
কর্মপরিবেশ নিয়ে কাজ চললেও দুই ঘটনায় আহত-নিহত সব শ্রমিককে এখন পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি। এ কারণে পুরুষের পাশাপাশি অনেক নারীই অনিশ্চিত জীবন কাটাচ্ছেন। এমনই দুজন হচ্ছেন জরিনা বেগম ও সুনীতা।
তাজরীনের অগ্নিকাণ্ডে জীবন বাঁচাতে লাফ দেন জরিনা বেগম। এতে তাঁর ডান পা আর মেরুদণ্ড ভেঙে যায়। গত নভেম্বরে কথা হয় জরিনার সঙ্গে। বলেন, ‘খুব কষ্টে আছি। ঠিকমতো বসতে পারি না। পায়ে এখনো ব্যথা। তাই কোনো কারখানায় কাজে যোগ দিতে পারতাছি না। চার মাসের বাসাভাড়া বাকি পড়ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘টাকার অভাবে কোমরে থেরাপি দিতে পারি না। তাই সুস্থ হওয়ার আশা আর দেখতাছি না।’
আর রানা প্লাজা ধসের পর পাঁচ দিন পর জীবিত উদ্ধার হন সুনীতা। পরে হাসপাতালে আরও পাঁচ দিন অজ্ঞান থাকার পর জ্ঞান ফেরে তাঁর। অর্থাভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না। গত জানুয়ারি মাসে নিজের অসহায়ত্বের কথা বলেন এভাবে, ‘আমার ডান হাতের হাড় ভাঙা। তাতে রড ঢোকানো। মাথা ফেটে গিয়েছিল। পায়ের ওপর মেশিন পড়েছিল। সেই ব্যথা এখনো সারে নাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘স্বামী দিনমজুর। আমি কাজ করতে পারি না। অনেক কষ্টে সংসার চলে।’
কর্মপরিবেশ নিয়ে আলোচনা চললেও নারীদের পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিত করার বিষয়টি উপেক্ষিতই থাকছে। একই সঙ্গে নিরাপদ চলাচল এবং কর্মক্ষেত্রে হয়রানি ও নির্যাতন বন্ধের ব্যাপারেও নেই কোনো উচ্চবাচ্য। মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস করার দীর্ঘদিনের দাবিটি পূরণ হয়নি। গত বছর সংসদে পাস হওয়া সংশোধিত শ্রম আইনে আগের মতোই মাতৃত্বকালীন ছুটি চার মাস রয়ে গেছে। এসব ব্যাপারে শ্রমিক সংগঠনগুলো নিশ্চুপ না হলেও যথেষ্ট সোচ্চার নয়।
এদিকে ঘণ্টা হিসেবে কাজ করলেও অনেক কারখানাতেই নারী শ্রমিকেরা মজুরিবৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। গত সেপ্টেম্বরে নিম্নতম মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে শ্রমিকদের আন্দোলনের সময় গাজীপুরে কথা হয় রুনা আক্তারের সঙ্গে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘কাজ করি অপারেটরের, কিন্তু বেতন পাই হেলপারের।’ তিনি জানান, তিন বছর ধরে এমনটাই চলে আসছে। সব মিলিয়ে মজুরি পান তিন হাজার ৮০০ টাকা।
রুনা আরও বলেন, ‘আমার মতো অনেক নারী শ্রমিককেই ঠকাচ্ছে মালিকপক্ষ। কিন্তু কাজ চলে যাওয়া আর কারখানার কর্মকর্তাদের গালমন্দের ভয়ে কেউ মুখ খোলে না বলে দাবি করেন তিনি।
এ বিষয়ে জাতীয় নারী শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি আয়েশা ইসলাম বলেন, নারী পোশাকশ্রমিকেরা সংগঠিত নন। তাঁরা মনে করেন, যেটুকু পাচ্ছেন, সেটুকুই যথেষ্ট। আর যথেষ্ট সচেতন না হওয়াই বঞ্চনার অন্যতম কারণ। শ্রমিক সংগঠনের বিষয়ে তাঁর বক্তব্য, অধিকাংশই শ্রমিকদের চেয়ে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারেই বেশি ব্যস্ত।
বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম বলেন, আগের চেয়ে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। উন্নতি হচ্ছে। তবে কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। ধীরে ধীরে এগুলো সমাধান হবে। অবশ্য মজুরিবৈষম্যের কথা অস্বীকার করেন তিনি।
সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, পোশাকশিল্পের নারী শ্রমিকেরা অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন—এই স্বীকৃতি বড় প্রাপ্তি। তবে তার বিপরীতে নারীদের সামাজিক মূল্যায়ন ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত হয়নি। নূন্যতম চাহিদার কিছু পূরণ হলেও গুণগত মানের তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। এ ক্ষেত্রে সরকার, শ্রমিক ও মালিক সংগঠনকে নিবিড়ভাবে কাজ করতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।