অভিষেকেই কীর্তিমান নাঈম হাসান
>
টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে নাম লিখিয়েই ছুটিতে বাড়ি ফিরেছিলেন নাঈম হাসান। অভিষেক ম্যাচে ৫ উইকেট নেওয়া সর্বকনিষ্ঠ বোলারের কৃতিত্বটা শুধু যে নাঈম হাসানকেই স্বপ্নে ভাসাচ্ছে তা তো নয়, চট্টগ্রাম নগরের ফরিদার পাড়ার মানুষও শামিল সে আনন্দে। এই এলাকাতেই নাঈমের ক্রিকেটার হয়ে ওঠা। নাঈমের আদ্যোপান্ত নিয়ে এই আয়োজনে।
মাহবুব কাউন্সিলরের বাড়ি কোথায়?
বহদ্দারহাট কাঁচাবাজারের মুখে এক দোকানির জবাব, ‘সোজা গিয়ে ডানে চলে যান।’
এভাবে জিজ্ঞেস করতে করতে এগোচ্ছিলাম। কাউন্সিলর বাড়ির সঙ্গে আমাদের দূরত্ব কিছুটা কমে আসতেই এক কিশোরের সঙ্গে দেখা। নিশ্চিত হওয়ার জন্য একই প্রশ্ন তাকেও করলাম। সে হাঁ করে তাকিয়ে রইল। যখন বললাম, নাঈম হাসানের বাড়ি কোনটি, তখনই সে হেসে দেখিয়ে দিল নির্মাণাধীন দোতলা বাড়িটি।
নাঈম হাসান বাংলাদেশ ক্রিকেটের নতুন প্রতিভা। চট্টগ্রাম টেস্টে অভিষেক ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৫ উইকেট নিয়ে রেকর্ড বইয়ে ঢুকে পড়েছেন নাঈম। তাঁকে নিয়ে সারা দেশে মাতামাতির শেষ নেই। সেই মাতামাতির আঁচ তো একটু বেশি তাঁর পাড়া–প্রতিবেশীদের মধ্যে লাগতেই পারে। তাঁদের চোখের সামনেই নাঈমের বেড়ে ওঠা। জেলা ও বিভাগীয় বয়সভিত্তিক দলের হয়ে খেলতে খেলতে জাতীয় দলে স্থান পাওয়া। পরেরটা ইতিহাস। তাই তাঁদের উচ্ছ্বাসটা বাড়াবাড়ি মনে হয় না। এই যেমন চট্টগ্রাম টেস্টের শেষে ২৫ নভেম্বর সকালে নাঈমের বাড়িতে ভিড় করেছেন তাঁর বন্ধু, বড় ভাইসহ অনেকে। ফুলের তোড়ায় তোড়ায় ভরে যায় নাঈমের ঘর। তাঁদের সঙ্গেই নাঈম বেরিয়ে পড়েন ঘর থেকে। গলির মোড়ে কয়েক বন্ধুর সঙ্গে মিলে কেক কাটেন নাঈম।
পৌনে তিন দিনে টেস্ট জয়ের পর ২৪ নভেম্বর রাতেই হোটেল থেকে নাঈম ফরিদার পাড়ার পৈতৃক বাড়িতে ফিরেছেন। মা-বাবা, ভাইয়ের সঙ্গে খাওয়াদাওয়া আর গল্প চলে অবিরাম। ২৫ নভেম্বর মাকে পাশে বসিয়ে অভিষিক্ত হওয়ার আগমুহূর্তের অনুভূতির কথা আমাদের শোনালেন নাঈম। ‘সকালে সাকিব ভাই বললেন, “তুমি আজ খেলবে।” সতীর্থদের অনেকে সাহস দিলেন, ভয় না পেতে। মুশফিক ভাই ক্যাপ পরিয়ে দিলেন। অনেক ভালো লেগেছে। ব্যাটিংয়ে নামার সময় সাকিব ভাই বললেন, “ও তো অনেক ভালো ব্যাট করে...।”’ থামলেন নাঈম।
ছেলের অভিষেকের সংবাদ মা মমতাজ বেগম পেয়েছেন ছোট ছেলে হাসিবুল আলমের এক শিক্ষকের মাধ্যমে। এরপর ফরিদার পাড়ার বাড়িটিতে আনন্দের বন্যা। ‘ফোন পেয়ে তার বাবাকে বললাম। তাড়াতাড়ি টিভি খুলে দেখলাম। কী যে ভালো লেগেছে। মনে মনে বললাম, আল্লাহ মুখ তুলে তাকিয়েছে। স্বপ্ন সার্থক হলো।’
পরিবারের পাশাপাশি পাড়াতেও আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। ব্যাট হাতে ২৬ রান করার পর এক এক করে যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজের উইকেট নিচ্ছিলেন নাঈম, তখন উল্লাস ভেসে আসছিল ফরিদার পাড়ার বিভিন্ন কোণ থেকে। পাড়ার বন্ধুদের সামনে উইকেট নেওয়ার সেই কাহিনিটি শোনালেন নাঈম নিজেই, ‘মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম, বল হাতে পেলে আর ছাড়ব না। যখন মাঠে নামি তখন ভাবি আমি নাম্বার ওয়ান হব। দ্বিতীয় ইনিংসে উইকেট না পাওয়াটাও পার্ট অব গেম।’
এর মধ্যে পাশে এসে বসেন বড় ভাই কামরুল আলম ও ছোট ভাই হাসিবুল আলম। ভাই সুযোগ পাবে না ভেবে চট্টগ্রাম টেস্টের প্রথম দিন এ দুজন মাঠে যাননি। দ্বিতীয় দিন সকাল সকাল উপস্থিত হন স্টেডিয়ামে। কামরুল ও নাঈম একসময় স্টার ক্লাবে একসঙ্গে ক্রিকেট খেলতেন। হাসিবুল এখন অনূর্ধ্ব-১৬ জেলা দলে খেলে।
মমতাজ বেগম দুই ছেলেকে একসঙ্গে জাতীয় দলে খেলার স্বপ্নটি এখনই দেখতে চান না। সময় দিতে চান আরও, ‘নাঈম প্রতিদিন ভোর ছয়টায় ওঠে অনুশীলনে চলে যেত। হাসিবুলও খেলছে। দেখা যাক কত দূর যায়।’
একই মত বড় ভাই নাঈম হাসানেরও, ‘সে খেলুক ধীরে ধীরে। এখনই যেন কোনো চাপ না পড়ে তার ওপর।’
বলতে বলতে আরও একঝাঁক প্রতিবেশী এসে হাজির। নাঈমের সঙ্গে কুশল বিনিময়, সেলফি সবই চলল। মমতাজ বেগমের আনন্দ ধরে না। একসময় ফুটবলতারকা স্বামী মাহবুবুল আলমকে নিয়ে গর্ব হতো তাঁর। তিনি প্রথম বিভাগ ফুটবল লিগে খেলতেন। দুবারের সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলরও তিনি।
মাহবুব কাউন্সিলরের বাড়ি বললে সবাই চেনে। এখন ছেলে নাঈম হাসানই পাড়াটির আইডল। দেশের তো বটেই।
মমিন স্যারের ক্লাসে
একবার কোচের সঙ্গে অভিমান করে নাঈম হাসান ক্রিকেট একাডেমি থেকে বাড়ি ফিরে এসেছিলেন। তখন বেশ ছোট। বাড়িতে গিয়ে নাঈম মাকে জানান, ওই একাডেমিতে আর যাবেন না। তখন মা মমতাজ বেগম তাঁকে জানিয়ে দেন, ‘ক্রিকেট খেললে তোমাকে মমিনের একাডেমিতে যেতে হবে। নইলে নয়।’
রোববার এ গল্পটি করছিলেন নাঈম হাসানের কোচ মমিনুল হক। মমিনুল হকের ব্রাদার্স ক্রিকেট একাডেমিতে ক্রিকেটার হয়ে ওঠার পাঠ নিয়েছিলেন। জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পাওয়ার পর এখনো সময় পেলে নাঈম ছুটে যান মমিনুল হকের একাডেমিতে।
গত ২৬ নভেম্বর দুপুরে ব্রাদার্স একাডেমিতে যান তিনি। সেখানে গিয়ে সতীর্থদের সঙ্গে খুনসুটিতেই মেতে ওঠেন। ব্যাট করতেও ছাড়েননি। নাঈম বললেন, ‘মমিন স্যারের ওখানেই আমার বেড়ে ওঠা। তাঁর কাছ থেকে টিপস নিই। সময় পেলেই চলে আসি একাডেমিতে।’
শুরুর দিকে নাঈম হাসান পেস বোলিং করতেন। এরপর মমিনুল হক তাঁকে পরামর্শ দেন স্পিন করার। একসময় স্পিন রপ্ত করে ফেলেন ছোট্ট নাঈম। অনূর্ধ্ব-১৪, অনূর্ধ্ব-১৬ জেলা দলে সুযোগ চলে আসে নাঈমের। এই সিঁড়ি বেয়ে জাতীয় দলে সুযোগ পান নাঈম।
‘প্রায় ১০ বছর আগে যখন একাডেমির সদস্য ১৭ জন, তখনই নাঈমকে পাই আমি। পেস বোলিং করত। দেখলাম ওর শক্তি কম। তখন স্পিন করার পরামর্শ দিয়েছিলাম। এখন সে একজন সেরা স্পিনার।’ বললেন নাঈমের গুরু মমিনুল হক।
অনূর্ধ্ব-১৭ থেকে জাতীয় দলে খেলছেন নাঈম। দীর্ঘদিন বাইরে থাকতে হয়। কিন্তু যখনই ছুটি পান তখন চট্টগ্রামে ফিরে একাডেমিতে চলে যান। সেখানে অনুশীলন করেন। একাগ্রতা এবং নিষ্ঠার কারণে নাঈম আজ জাতীয় দলের টিকিট পেয়েছেন এমনটি মনে করছেন মমিনুল হক। একটা উদাহরণও দিলেন—‘একবার ঈদের দিন আমাদের (একাডেমির ছেলেদের) এক জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার কথা। নাঈমের জন্য অপেক্ষা করছি। সে আসে না। অনেকক্ষণ পর সে এল। এসে জানাল প্র্যাকটিসের জন্য দেরি হয়েছে। এমন একাগ্রতা তার। তার পুরস্কার পেল সে।’
মমিনুল হক এখন বিসিবির কোচ। অনূর্ধ্ব-১৮ বিভাগীয় দল নিয়ে তিনি এখন খুলনায় রয়েছেন। অনুশীলনই নাঈমের প্রধান অস্ত্র। সোমবার মাঠে গিয়ে সতীর্থদের সঙ্গে ব্যাট করতে নেমে পড়েন। ব্যাটিং করার সময় স্ট্যান্স শুদ্ধ করে নেন কোচ মাহমুদুল করিমকে দিয়ে।
ব্রাদার্স একাডেমির আরেক কোচ মো. মাছুমউদ্দৌলাকে পেয়ে কিছু টিপস নেন। মাছুমউদ্দৌলা বললেন, ‘সে অনেক প্রতিভাবান। অনেক শৃঙ্খলা নিয়ে চলে। এখন জাতীয় দলে নিয়মিত হওয়াটাই তার চ্যালেঞ্জ। তবে সে সফল হবে।’
নাঈমের শিক্ষাগুরু প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অনুপম সেনও ছাত্রকে নিয়ে আশাবাদী। নাঈম এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়ছেন। অনুপম সেন নিজেও পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে চট্টগ্রাম দলের হয়ে ব্যাটিং ওপেন করতেন। পূর্ব পাকিস্তান দলের ১৬ জনের স্কোয়াডে ছিলেন। কিন্তু একাদশে ঢুকতে পারেননি। তাই ছাত্র নাঈমের টেস্ট অভিষেকে আনন্দিত হওয়ারই কথা তাঁর।