বন্ধুবান্ধবের ছেলে-মেয়েরা বলে, ‘আন্টি তুমি এত ইয়াং’

২০-২২ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভ সড়কে হয়ে গেল ‘কোস্টাল আলট্রা ২০২৫’। ২০০ কিলোমিটারের এই ম্যারাথন সম্পন্ন করতে পেরেছেন মাত্র চারজন, তাঁদের মধ্যে আবার নারী মাত্র একজন: সিফাত ফাহমিদা নওশিন। ৪৬ বছর বয়সী এই দৌড়বিদের গল্প শুনেছেন জাওয়াদুল আলম

কোস্টাল আলট্রা ম্যারাথনে সিফাত ফাহমিদা নওশিনছবি: ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স

ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জের ছোট্ট গ্রাম বীরহুলিতে আমার বাড়ি। ছোটবেলায় খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। খেলাধুলার ব্যাপারে বাধা না দিলেও খেলাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার ব্যাপারে বাড়িতে আপত্তি ছিল। তাই স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর পর মাথা থেকে খেলার ভূত নামাতে হয়। কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়জীবনেও আর খেলার মাঠে ফেরা হয়নি। তবে খেলোয়াড় না হতে পারার আক্ষেপ সব সময়ই আমাকে পোড়াত।

২০০৮ সালের দিকে আমার সঙ্গী হয় সাইকেল। ভ্রমণ বরাবরই পছন্দ, তাই সাইকেল নিয়ে বিভিন্ন গ্রুপের সঙ্গে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতাম। পাহাড়-পর্বতে ট্রেকিংয়েও যেতাম। বেড়ানোর পাশাপাশি আমরা কয়েকজন আবার সাইকেল র‍্যালি, দল বেঁধে ট্রেকিংয়ের আয়োজন করতাম। সেই ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালের শুরুর দিকে ঢাকায় উইমেন্স ম্যারাথনের আয়োজন করলাম। অনেকটা কৌতূহলবশেই প্রতিযোগী হিসেবে নিজেও নাম লেখালাম। শেষ মুহূর্তে সংশয়, অনেক দিন ধরে খেলাধুলার মধ্যে নেই, এত দূর দৌড়াতে পারব তো। ম্যারাথনে আর অংশ নেওয়া হলো না। তবে অগ্রগতি কিছুটা হলো, একই বছরের ডিসেম্বরে দিনাজপুরে হাফ ম্যারাথনে প্রথমবার এত লম্বা দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিলাম। মাত্র আড়াই ঘণ্টায় দৌড় শেষ করে মনে হলো—আরে দৌড়ানো তো বেশ সহজ!

আরও পড়ুন
দেশ–বিদেশের ম্যারাথনে অংশ নেন সিফাত ফাহমিদা নওশিন
ছবি: সংগৃহীত

লক্ষ্য আলট্রা ম্যারাথন

২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় আবার উইমেন্স ম্যারাথন হলো। এবার সেখানে পঞ্চম স্থান অর্জন করলাম। পুরস্কার হিসেবে ১০ হাজার টাকা পেলাম। এই পুরস্কার প্রেরণা হিসেবে কাজ করল। এরপর বাংলাদেশ ও ভারতে বিভিন্ন ম্যারাথনে নিয়মিত অংশ নিতে থাকি। তবে মনে মনে আলট্রা ম্যারাথনে অংশ নেওয়ার জন্য পরিকল্পনা করছিলাম। সাধারণ ম্যারাথনের (৪২ দশমিক ২ কিলোমিটার) চেয়ে অধিক দূরত্বের প্রতিযোগিতাই আলট্রা ম্যারাথন। লক্ষ্য স্থির করে নিয়মিত দৌড়ের অনুশীলনও করতাম। তবে ঢাকায় নারীদের জন্য দৌড়ানো বেশ কষ্টসাধ্য। পর্যাপ্ত খোলা জায়গা নেই। তার পরও আমি নিজের মতো করে কখনো মাঠে, কখনো রাস্তার পাশে অনুশীলন চালিয়ে গেলাম। আমার উচ্চতা পাঁচ ফুট ছুঁই ছুঁই। দৌড়ের জন্য এই উচ্চতা পর্যাপ্ত না। তাই বলে এই খামতির জন্য হারকে মেনে নিতে পারি না।

২০১৮ সালে আমার স্বপ্ন পূরণ হলো। ভারতের ‘কলকাতা আলট্রা’য় ৬০ কিলোমিটারে অংশ নিয়ে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করলাম। ভারতে অনেকেই আমার প্রশংসা করলেন। একই বছর কলকাতায় আবার আরেকটি আলট্রা ম্যারাথনে অংশ নিলাম। সেবারও সফল হলাম। দেশে ২০২০ সালে কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভ সড়কে ১০০ কিলোমিটারের আলট্রা ম্যারাথনে একমাত্র নারী প্রতিযোগী হিসেবে ম্যারাথন সম্পন্ন করি। সেদিন সবার অভিনন্দন আর ভালোবাসা পেয়ে মনটা ভরে গেল। আমার সাফল্য দেখে আলট্রা ম্যারাথনে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়তে শুরু করে। ২০২৩ সালে ভারতের চণ্ডীগড়ে ১১০ কিলোমিটার ও বেঙ্গালুরুতে ১৪০ কিলোমিটার দূরত্বের আলট্রা ম্যারাথনও সম্পন্ন করি।

আরও পড়ুন
‘চিরসবুজ’ থাকার জন্য হলেও দৌড় চালিয়ে যেতে চান সিফাত ফাহমিদা নওশিন
ছবি: সংগৃহীত

‘কে হতে চাও ইতি আপু?’

‘কোস্টাল আলট্রা ২০২৫’ নিবন্ধনের সময় ফেসবুকে আমাকে নিয়ে ফটোকার্ড পোস্ট করেন আয়োজকেরা। যেখানে লেখা ছিল, ‘কে হতে চাও ইতি (আমার ডাকনাম) আপু?’ পরিচিত অনেকেই পোস্টটি শেয়ার করেছিল, ভালো ভালো কথা লিখেছিল। সবার লেখা পড়ে আমার কী যে আনন্দ হয়েছিল, বলে বোঝাতে পারব না।

২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ইনানী সমুদ্রসৈকত থেকে দৌড় শুরু করি। প্রথমে ১০ কিলোমিটার লুপে দৌড়াই। এভাবে ৬০ কিলোমিটার দৌড় সম্পন্ন করি। সন্ধ্যায় আবহাওয়া শীতল থাকবে ভেবেছিলাম; কিন্তু অনেক গরম লাগছিল, তৃষ্ণাও পাচ্ছিল। তাই শুরুতে কিছুটা অস্বস্তিবোধ করছিলাম। তবে সময়ের সঙ্গে তা ঠিক হয়ে গেছে। এরপর একবারে ৫০ কিলোমিটারের লুপ দৌড়ে মোট ১১০ কিলোমিটার শেষ করি। বাকি ৯০ কিলোমিটার আবার ১০ কিলোমিটারের লুপে দৌড়াই। ২২ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২টার পরপর ইনানীতেই শেষ হয় আমার ২০০ কিলোমিটার দৌড়। এই ৪২ ঘণ্টায় পানি আর শুকনা খাবারের জন্য মাঝেমধ্যে বিরতি নিয়েছি। একদিন দুপুরের খাবারের জন্য কিছুটা সময়ের বিরতি ছিল। ওয়াশরুমের জন্য দুবার বিরতি নিয়েছিলাম। আর শেষ দিন ভোরে এক ঘণ্টা ঘুমিয়েছি।

আন্টি তুমি এত ইয়াং

বার্ধক্যের কারণে আমার মা অসুস্থ। তাঁকে দেখাশোনার জন্য ঠাকুরগাঁওয়ে গ্রামের বাড়িতে থাকি। সেখান থেকে গিয়েই বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিই। দৌড়ের প্রতি ভালো লাগার আরেকটা কারণ স্বাস্থ্য। আমার বয়সী বন্ধুবান্ধব প্রায় সবাই ডায়বেটিস, রক্তচাপ, স্থূলতাসহ বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছে। এসব কোনো জটিলতা নেই বলে ইতিবাচকভাবেই তারা আমাকে ঈর্ষা করে। তাঁদের ছেলে-মেয়েরা বলে, ‘আন্টি তুমি এত ইয়াং, তোমাকে দেখলে তো আমাদের বন্ধু মনে হয়।’

‘চিরসবুজ’ থাকার এই আনন্দের জন্য হলেও দৌড় চালিয়ে যেতে চাই।

আরও পড়ুন