হাসপাতালে মায়ের সেবা করেছেন, পরীক্ষাও দিয়েছেন, পেয়েছেন জিপিএ ৫
দেড় বছর বয়সে বাবাকে হারান রবিউল ইসলাম। তার এক বছরের মাথায় দাদা-দাদি। নানাও বেঁচে ছিলেন না। কাঁথা সেলাই থেকে শুরু করে যখন যে কাজ পেয়েছেন, তা-ই করে সংসার চালিয়েছেন মা। স্থানীয় ব্যক্তিদের সহায়তায় লেখাপড়া শুরু হয়েছিল রবিউলের।
এরপরও যখন সংসার চলছিল না, গার্মেন্টসে কাজ নেন মা। রবিউলের ঠাঁই হয় চাচার বাসায়, তাঁর বোনকে মামাবাড়িতে রেখে আসেন মা। সে সময়ের স্মৃতিচারণা করে রবিউল বলেন, ‘চাচা-চাচি ছেলের মতোই দেখতেন। কিন্তু মা কাজ না করলে আমার পড়াশোনা বন্ধ থাকত। সবাই জানে, গার্মেন্টসের কাজ কত কঠিন। মা কখনোই এসব বুঝতে দেননি। শুধু চিন্তা করতেন, চাকরিটা যেন না যায়। করোনাকালে মায়ের সেই চাকরিটাও চলে গেল। ফোন করে মায়ের সে কী কান্না! তখন আমার মাধ্যমিক পরীক্ষার অল্প কিছুদিন বাকি। পরে যদিও অনেক কষ্টে মা চাকরিটা ফিরে পেয়েছেন।’
মাধ্যমিকে জিপিএ-৫ পেয়ে রবিউল খুশি ছিলেন না। রাজশাহীর সেরা কলেজটায় ভর্তি হওয়ার মতো নম্বর যে তিনি পাননি। ভেবেছিলেন বিজ্ঞানে পড়ার অনেক খরচ। টিউশন, কলেজের ফি, মেসের বেতন সব মিলিয়ে প্রায় আট হাজার টাকা। এত টাকা কোথায় পাবেন! কিন্তু মায়ের জেদ, বিজ্ঞানেই পড়তে হবে। তাই রবিউল ভর্তি হন রজব আলী মেমোরিয়াল বিজ্ঞান কলেজে। রবিউল বলেন, ‘মা বলতেন, “বাবা তুই টেনশন করবি না, দরকার হলে রক্ত বিক্রি করে তোকে পড়াব।” কিন্তু আমি জানি, খাবারে অনিয়ম করতে করতে মায়ের শরীরের রক্তও কমে গেছে। কলেজে ভর্তির পর দুই মাস যেতে না যেতেই লক্ষ করি, মা খরচ চালিয়ে উঠতে পারছেন না। তখন যাঁদের কাছে প্রাইভেট পড়তাম, তাঁদের সব খুলে বলি। দুজন শিক্ষক টাকা কম রাখতে রাজি হন। আমি তাঁদের কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।’
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার মাসখানেক আগে রবিউল জানতে পারেন, মায়ের শরীর খুব খারাপ। আগেই জরায়ুতে টিউমার ধরা পড়েছিল, সেটা তখন জটিল পর্যায়ে পৌঁছেছে। অপারেশন দরকার। রবিউল বলেন, ‘আমার পরীক্ষার মাঝামাঝি সময়ে মায়ের অপারেশন হলো। শেষের দিকে সবগুলো পরীক্ষা আমি না ঘুমিয়ে দিয়েছি। দিনের বেলায়ও হাসপাতালে থাকতে হতো। আবার রিভাইজ না দিয়ে পরীক্ষা দেওয়া যাবে না। আমার পরীক্ষাও শেষ হলো, মাকে একই সময়ে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেওয়া হলো।’
এত ঝড়ঝাপটার পরও জিপিএ–৫ পেয়েছেন এই শিক্ষার্থী। রবিউল বলেন, ‘ফল ঘোষণার পাঁচ মিনিটের মধ্যে টেলিটক সিম দিয়ে এসএমএস দিই। ফিরতি বার্তায় শুধু “৫” সংখ্যাটার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ। বারবার মায়ের কথা মনে হচ্ছিল। চাচা বারবার ফোন দিচ্ছিলেন। রিসিভ করছিলাম না। আমি শুধু কাঁদছিলাম।’
ফল শুনে রবিউলের মা নাকি বলেছেন, ‘বাবা, আমার সব রোগ সেরে গেছে। তুমি চিন্তা কোরো না।’
ভবিষ্যতে রবিউল একজন রসায়নবিদ হতে চান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন বিভাগে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি।