নাসা, অ্যাপলের চাকরি ছেড়ে কেন তিনি ইউটিউবার হলেন
মার্ক রবারের বিখ্যাত ভিডিওটি হয়তো আপনারও চোখে পড়েছে। পার্সেল–চোরদের হাতেনাতে ধরতে ফাঁদ পেতেছিলেন তিনি। বাক্সের ভেতরে কায়দা করে বসিয়ে দিয়েছিলেন গ্লিটার বম্ব (জরি-চুমকি দিয়ে তৈরি এক ধরনের বোমা) আর দুর্গন্ধযুক্ত স্প্রে। ব্যাস, বাক্স খুলতেই ধরাশায়ী চোর। চারটি গোপন ক্যামেরায় এই পুরো দৃশ্য ধারণ হয়েছিল স্বয়ংক্রিয়ভাবে। ‘গ্লিটার বম্ব ১.০ ভার্সেস পোর্চ পাইরেট’ নামের ভিডিওটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই লুফে নেন ইউটিউবের দর্শকেরা। ভাইরাল এই ভিডিও ২৪ ঘণ্টায় পেয়ে যায় আড়াই কোটি ভিউ।
ইউটিউবে মার্ক রবারের চ্যানেলে ঢুঁ মারলে এমন বিচিত্র আরও বহু ভিডিও পাবেন। সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা প্রায় ২ কোটি ৪০ লাখ। তবে এই ইউটিউবারের কিন্তু আরও পরিচয় আছে। তিনি একজন প্রকৌশলী। কাজ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা, এমনকি অ্যাপলেও! প্রকৌশল পেশা থেকে কীভাবে তিনি পুরোদস্তুর ইউটিউবার বনে গেলেন?
ছেলেবেলা থেকেই বিজ্ঞানের প্রতি ছিল অমোঘ টান। পেঁয়াজ কাটার সময় চোখের জল আটকাতে বিশেষ ধরনের এক চশমা তৈরি করে মাকে চমকে দিয়েছিলেন ছোট্ট রবার। বরাবরই যন্ত্রের খুঁটিনাটিতে আগ্রহ থাকায় ব্রিগহাম ইয়ং ইউনিভার্সিটি থেকে যন্ত্রকৌশলে ডিগ্রি অর্জনের পাশাপাশি ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া থেকে স্নাতকোত্তর করেন তিনি। ২০০৪ সালে যোগ দেন নাসায়। মঙ্গলগ্রহে চলাচল উপযোগী রোভার তৈরির প্রকল্পেও কাজ করেছেন প্রায় সাত বছর। এত গুরুত্বপূর্ণ মিশনের জটিল একটি অংশে কাজ করা সত্ত্বেও নাসায় কাজের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন রবার।
হতাশা কাটাতে তাই একটি ইউটিউব চ্যানেল খুলে ফেলেন। উদ্দেশ্য—নিজের ক্ষুদ্র উদ্ভাবনগুলো সাধারণ দর্শকদের দেখানো। ২০১১ সালে হ্যালোইন উৎসবের জন্য একটি ভিডিও তৈরি করে ফেলেন মার্ক। যেখানে টি–শার্টের দুই দিকে দুটি আইপ্যাড লাগিয়ে দৃষ্টিবিভ্রম সৃষ্টি করার মতো একটি হ্যালোইনের পোশাকের আইডিয়া দেওয়া হয়েছিল। ইউটিউবে তোলার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ভিডিওটি প্রায় ১৫ লাখ দর্শক দেখে ফেলেন। অর্থাৎ, প্রথম ভিডিওতেই বাজিমাত। এর কিছুকাল পরেই নাসা থেকে বিরতি নেন তিনি, যুক্ত হন অ্যাপল ইনকরপোরেটেডে। অ্যাপলের স্বয়ংক্রিয় যানের ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি অংশে দারুণ কাজ করলেও রবারের মন পড়ে ছিল ইউটিউবের দুনিয়ায়, কারণও ছিল। রবার যখন অ্যাপলে যোগ দেন, তখন তিনি ইউটিউবে রীতিমতো বিখ্যাত। বেতনের তুলনায় ইউটিউব ভিডিওগুলো থেকেই আয় হচ্ছিল বেশি। মজার ভিডিওর মাধ্যমে দর্শকদের তিনি শেখাচ্ছিলেন বিজ্ঞানের বিভিন্ন খুঁটিনাটি। বিষয়টি তাঁকে বেশ আনন্দও দিচ্ছিল। এর ফলে সব ছেড়ে দিয়ে পুরোদস্তুর ইউটিউবের পেছনেই সময় দিতে শুরু করেন এই প্রকৌশলী।
ঘরে বসে হাতে তৈরি সামান্য যন্ত্রও যে বিনোদনের উৎস হতে পারে, সে বার্তাই মার্ক রবার তাঁর দর্শকদের দিতে চান। তাই তাঁর চ্যানেল ঘুরে আমরা দেখতে পাই অদ্ভুত মজার সব ভিডিও। কখনো তাঁকে দেখা যাচ্ছে বিজ্ঞানের ছোটখাটো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে, কখনো তিনি তৈরি করছেন রোবট পিয়ানো, চলমান ডার্টবোর্ড, স্নোবল মেশিনগান, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জেলোপুল কিংবা সর্ববৃহৎ নার্ফ গানের মতো চমকপ্রদ সব জিনিস। কখনো তিনি পড়ে আছেন বাগানের কাঠবিড়ালিদের নিয়ে কাল্পনিক অলিম্পিক গেম চালুর পেছনে, এটিও কিন্তু ইউটিউবের জনপ্রিয় ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্যতম। নিজ চ্যানেলে সাত পর্বের একটি সিরিজে বিভিন্ন ঘটনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও দিয়েছেন তিনি।
শুধু এডুটেইনমেন্ট (শিক্ষা ও বিনোদন) নয়, রবার তাঁর ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে কিছু সমাজসেবামূলক প্রচারেও ভূমিকা রেখেছেন। যেমন ২০১৯ সালে আরেক বিখ্যাত ইউটিউবার জিমি ডোনাল্ডসনের (মি. বিস্ট) সঙ্গে মিলে উদ্যোগ নেন দুই কোটি গাছ লাগানোর। মাত্র দুই মাসের মধ্যে তাঁরা এ অসাধ্য সাধন করে বসেন। রবার তখন দেখিয়েছিলেন, গাছ লাগাতে কীভাবে ড্রোন ব্যবহার করা যায়। এ প্রকল্পের সাফল্যের পর ২০২১ সালে তাঁরা আরেকটি সাহসী চ্যালেঞ্জ নিয়ে বসেন। সেবার তাঁদের লক্ষ্য ছিল বিশ্বের নোংরা নদীপথগুলো থেকে তিন কোটি পাউন্ড আবর্জনা পরিষ্কার করা। এই প্রকল্পও সফল হয়েছিল। এবারও রবার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন এক স্বয়ংক্রিয় জলযানের সঙ্গে, যা নদী থেকে ময়লা ছেঁকে আলাদা করতে পারে। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, যেখানে মার্ক রবার, সেখানেই কোনো সমস্যার বৈজ্ঞানিক সমাধান। হয় তিনি তৈরি করছেন নতুন কোনো প্রযুক্তি, নয়তো তুলে ধরছেন তাঁরই মতো বিজ্ঞানমনস্ক অন্য কারও উদ্ভাবন। দারুণ সব ভিডিও ছাড়াও গত কয়েক বছরে মার্ক আমাদের দেখিয়েছেন, কীভাবে নামী চাকরির বদলে নিজের পছন্দকে গুরুত্ব দিয়ে সফল হওয়া যায়।