‘ক্যামেরায় বিদ্রোহ’ প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পাওয়া ছবিটা যেভাবে তুলেছি
২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে পাঠকের কাছে ছাত্র-জনতার গণ–অভ্যুত্থানের সময়কার ছবি ও ভিডিও আহ্বান করেছিল প্রথম আলো। ‘ক্যামেরায় বিদ্রোহ’ নামের এই আয়োজনে সাড়া দেন বহু পাঠক। বিচারকদের দৃষ্টিতে প্রথম সেরা হয়েছে মো. আহছান উল্লাহর এই ছবিটি। তিনি ভিডিও শাখাতেও দ্বিতীয় সেরা হয়েছেন।
গত ৪ আগস্ট সকালে মধুবাগের বাসা থেকে বেরিয়েছি। গন্তব্য শাহবাগ। হাতিরঝিল হয়ে রিকশায় প্রথমে কারওয়ান বাজারে আসি। এই এলাকা তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারদলীয় নেতা-কর্মীদের দখলে। হেঁটে হেঁটে বাংলামোটরে গিয়ে দেখি সেখানে অবস্থান নিয়েছে ছাত্র-জনতা। ছবি তুলতে তুলতে শাহবাগে পৌঁছে যাই।
স্লোগানে প্রকম্পিত তখন পুরো শাহবাগ। ছাত্রদের একটি দল সাংবাদিকদের ফুল দিচ্ছিল। আমি ক্যামেরা বের করে সেই ছবি তুলি। এর মধ্যেই খবর আসে বাংলামোটরের দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা চলে আসছে। ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালাচ্ছে। কথাটা শুনেই শাহবাগ থেকে অনেকে বাংলামোটরের দিকে হাঁটা শুরু করে। আমিও সড়কের এক পাশ দিয়ে আসতে আসতে দেখি গুলিবিদ্ধ কয়েকজন মানুষকে রিকশায় হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। বাংলামোটরে আসতে আসতে ছাত্র-জনতার ধাওয়া খেয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আবার পিছু হটতে থাকে। পেছাতে পেছাতে কাঁদানে গ্যাস, রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ছিল তারা।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা একসময় ফার্মগেট চলে যায়। আর কারওয়ান বাজারের ভেতরে ঢুকে পড়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। ফার্মগেট গিয়ে সাঁজোয়া যান নিয়ে আবার ফিরে আসে পুলিশ। এরপর পাল্টাপাল্টি ধাওয়া চলতে থাকে। কয়েকজন গুলিবিদ্ধ ছাত্র-জনতাকে দেখলাম। কারও গায়ে গুলি লেগেছে, কারও পায়ে। যতটা সম্ভব নিরাপদ অবস্থানে থেকে ছবি তোলার কাজটি করছিলাম। পাশাপাশি ভিডিও ফুটেজও নিচ্ছিলাম।
তখন বাজে বিকেল প্রায় চারটা। আন্দোলনকারীরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আক্রমণ মোকাবিলা করতে টিন, রাস্তার প্লাস্টিকের ডিভাইডার, খালি পানির জারকে ঢাল বানিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। কারওয়ান বাজারের সড়কে এমনই একজন আন্দোলনকারী একদল পুলিশের সামনে চলে যান। তাঁর ডান হাতে ঢেউটিন আর বাঁ হাতে ইস্পাত আর ইটের টুকরা। সামনে এগোতে এগোতে ছাত্র-জনতাকেও এগিয়ে আসতে আহ্বান জানাচ্ছেন। সেই মুহূর্তে তোলা ছবিটাই প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন ‘ক্যামেরায় বিদ্রোহ’-তে সেরা ছবি হয়েছে। একই প্রতিযোগিতার ভিডিও শাখায় আমি দ্বিতীয় হয়েছি। ৩৯ সেকেন্ডের সেই ভিডিওটিও সেদিনের কারওয়ান বাজার এলাকা থেকেই তোলা।
আম্মা ক্যামেরা কিনে দিলেন
পেশায় আমি একজন ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হয়ে বিয়েসহ নানা আয়োজনের ছবি তুলি। ক্যামেরার সঙ্গে সখ্য কলেজে পড়ার সময়। কিশোরগঞ্জে আমার বাড়ি। সেখানকার গুরুদয়াল সরকারি কলেজে অনার্স পড়ার সময় কখনো মুঠোফোনে, কখনো বন্ধুদের ক্যামেরা ধার করে পথেঘাটে ছবি তুলে বেড়াতাম। আমার আগ্রহ দেখে ২০১৬ সালে আম্মা আমাকে একটা ক্যামেরা কিনে দেন। তারপর আমাকে আর পায় কে!
পছন্দের ছবিগুলো প্রায়ই ফেসবুকে পোস্ট করতাম। সেসব দেখে এক বড় ভাই মেসেজ দিয়ে জানতে চাইলেন, আমি তাঁর সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী কি না। তিনি ঢাকায় ওয়েডিং ফটোগ্রাফি করেন। আম্মাকে বললাম। আম্মা সায় দিলেন। এরপর মাসের বেশ কিছুদিন ঢাকায় এসে কাজ করতাম। বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে বিয়ের আয়োজনের ছবি তুলতাম।
পড়াশোনা শেষ করে ২০১৯ সালে ঢাকায় আসি। বিভিন্ন ফার্মের সঙ্গে এখনো কাজ করি। তবে পথঘাটে ছবি তোলা বাদ দিইনি। বিভিন্ন আলোচিত ঘটনার ছবি তুলতেও ভুলি না। ২০১৮ সালেও যেমন কোটাবিরোধী আন্দোলনের ছবি তুলেছি।
এবারও ১৫ জুলাই থেকেই আমি মাঠে ছিলাম। কারফিউয়ের দিনগুলো ছাড়া ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছবি তুলেছি, ভিডিও করেছি। সেসব ছবি ও ভিডিওর জন্য পুরস্কার পাওয়ার আনন্দ আসলে ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।
(অনুলিখন: সজীব মিয়া )