সোনা জেতা ইমরানুরের ফিটনেসের রহস্য কী
১১ ফেব্রুয়ারি কাজাখস্তানে ইতিহাস গড়েছেন বাংলাদেশের ইমরানুর রহমান। এশিয়ান ইনডোর অ্যাথলেটিকস চ্যাম্পিয়নশিপে ৬.৫৯ সেকেন্ড সময় নিয়ে ৬০ মিটার স্প্রিন্টে জিতেছেন সোনা। বিদেশবিভুঁইয়ে চাকরি করেও কীভাবে নিজেকে ফিট রেখেছেন এই অ্যাথলেট? নিজেই সেই রহস্য ফাঁস করেছেন ইমরান। ১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বাংলাদেশ অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের দপ্তরে তাঁর সঙ্গে আড্ডায় বসেছিলেন হাসান ইমাম
রেকর্ডার অন করতেই ইমরানুরের জিজ্ঞাসা, ‘সিলোটি খইতাম, না ইংরেজি?’ দুই সেকেন্ড সময় নিয়ে বললাম, ‘সিলোটিই বলুন।’ ইমরানুর একটা মিষ্টি হাসি দিলেন। ইংল্যান্ডে বড় হলেও ঘরের লোকজন তো বাংলাদেশি। আরও নির্দিষ্ট করে বললে সিলেটি। তাই বাংলার এই আঞ্চলিক রূপটায় কথা বলেই আরাম পান। ইংল্যান্ডে চাকরি করে কীভাবে ফিটনেস ধরে রাখেন? উত্তর শুরু করার আগে আবার সেই মিষ্টি হাসি, ‘হ্যাঁ, চাকরি তো করতেই হয়। ইংল্যান্ডে আমার স্ত্রী-সন্তান আছে, পরিবার আছে। কিন্তু অ্যাথলেটিকস এখন আমার কাছে নেশার মতো। তাই নিয়মিত দুই বেলা অনুশীলন করি। কাজে যাওয়ার আগে এবং কাজ থেকে ফিরে এই অনুশীলন চালিয়ে নিই।’
ইংল্যান্ডে শেফিল্ডে বেড়ে উঠেছেন ইমরানুর রহমান। ছোটবেলায় অ্যাথলেটিকে খুব একটা আগ্রহ ছিল না, স্কুলে খেলতেন ফুটবল, ক্রিকেট। কিন্তু কিছুটা বড় হওয়ার পর বন্ধুরাই ইমরানকে বলতে থাকে, ‘তুই অ্যাথলেটিকসে ভালো করবি।’ এসব কথা শুনেই শেফিল্ডের একটি ক্লাবে ভর্তি হয়ে যান। তখন তাঁর বয়স ১৯ বছর, এখন ২৯, মাঝের ১০টি বছর ক্লাবে ক্লাবেই কেটে গেছে। এর মধ্যেই একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পূর্ণকালীন হিসাবরক্ষকের চাকরিতে যোগ দেন। আরেকটি চাকরি করেন খণ্ডকালীন। বিয়ে করে সংসার শুরু করেছেন বেশ কয়েক বছর। একটি কন্যাসন্তানও আছে।
২০১৭ সাল থেকে তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করে বাংলাদেশ অ্যাথলেটিকস ফেডারেশন। তবে ইনজুরি আর করোনার কারণে বাংলাদেশের হয়ে খেলা শুরু করতে কিছুটা সময় লেগে যায়। ২০২১ সালে দেশে আসেন ইমরান। বিকেএসপিতে ট্রায়ালে অংশ নেন। ১০০ মিটার স্প্রিন্টে ইমরানুর সময় নেন ১০.৪০ সেকেন্ড। ৬০ মিটারে ৬.৫০ সেকেন্ড। টাইমিং দেখে ফেডারেশন কর্মকর্তারা খুশি। মিলল জাতীয় প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার সুযোগ। ২০২২ সালে ঢাকায় জাতীয় অ্যাথলেটিকস চ্যাম্পিয়নশিপে ১০.৫০ সেকেন্ড দৌড়ে ২২ বছরের পুরোনো রেকর্ড ভাঙলেন। একে একে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় দেশের হয়ে আশা দেখাতে শুরু করলেন। আর সবচেয়ে বড় সুখবর এনে দিলেন এক বছরের মাথায়। কাজাখস্তানে সোনা জেতার সুবাদে প্রথমবার এশিয়ান অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের র্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষে উঠল বাংলাদেশি কোনো অ্যাথলেটের নাম।
ইমরানুরের এই সাফল্যে কাতার, জাপান, হংকং, ভারতের প্রতিযোগীরাও অবাক। বাংলাদেশি এই খেলোয়াড়ের পিঠও চাপড়ে গেছেন তাঁরা। এসব উৎসাহ বাংলাদেশের এই খেলোয়াড়কে আরও বড় স্বপ্ন দেখাচ্ছে। আর সেই স্বপ্নকে বাস্তব চেহারা দিতে নিজেকে কঠোরভাবে নিয়মের মধ্যে আনতে চাইছেন। সোনা জিতে দেশে ফিরে এর মধ্যেই শুরু করে দিয়েছেন অনুশীলন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হয়ে খেলা ইমরানুর রহমান ইংল্যান্ডে অনুশীলন করেন কখন? ‘সকাল সাতটার আগেই ঘুম থেকে উঠে অনুশীলনের জন্য বেরিয়ে পড়ি। প্রথমে ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা কঠোর অনুশীলন। সকালের সেশনটা বেড়ে মাঝেমধ্যে তিন ঘণ্টাও হয়ে যায়। এরপর কাজের জন্য ছুটতে হয়। আট ঘণ্টার ফুলটাইম অফিস শেষ করে একটা ছোট্ট বিরতি। তারপর আবার জিম,’ জানালেন বাংলাদেশের দ্রুততম মানব। জিমেও দেড়-দুই ঘণ্টা ব্যায়াম করেন। বাকি সময়টা পরিবারের সঙ্গে কাটাতে চেষ্টা করেন। সময় পেলে ঘুরতেও যান।
১০ বছর একটা খেলার পেছনে সময় দেওয়ার পর যখন সাফল্য মেলে সেটার স্বাদ কেমন? ইমরানুর বলেন, ‘এটা একটা অন্য রকম অনুভূতি। নিজের কঠোর পরিশ্রম আর পরিবারের ত্যাগ একনিমেষেই হাওয়া। আমার জন্য দেশের জাতীয় সংগীত বাজছে বিদেশের মাটিতে—এই অনুভূতির সঙ্গে অন্য কিছুর তুলনা হয় না।’
এই মাসের শেষ দিকে আবার দেশ ছাড়বেন ইমরানুর। তবে দেশের জন্য আরও ভালো কিছু করার প্রেরণা নিয়েই এই যাত্রা। সামনে এশিয়ান গেমস, আছে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ। সেসব প্রতিযোগিতা থেকেও দেশের জন্য সোনা জিততে চান। আর তাই ফিরে গিয়ে নতুন উদ্যমে অনুশীলন চালিয়ে যাবেন বাংলাদেশের সোনার ছেলে।
খাবারদাবার কেমন
ফিটনেস ঠিক রাখতে খাবারটাও হওয়া চাই ঠিকঠাক। তবে ইমরানুরের কথা শুনে মনে হলো, খুব একটা কঠোর না তাঁর খাবারের রুটিন। খালি খাদ্যতালিকা থেকে সচেতনভাবে বাদ রেখেছেন কয়েকটা উপাদান। ইমরানুর বলেন, ‘তেল ও চিনি খুব একটা খাই না। তেলে ভাজা খাবার, কারিও (ঝোল) বাদ রাখতে চেষ্টা করি। সকালের নাশতায় সিরিয়াল, ব্রেড, ডিম, দুধ ইত্যাদি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে খাই। আর সারা দিনে বেশি খাই গ্রিলড খাবার। ভাত খাই, তবে পরিমাণে কম। সবজি, মুরগি, ছোলা বেশি খাই। টোস্টেড ব্রেড, পাস্তা, বেক করা আলু খাই। আমার প্রিয় খাবার ভেড়ার মাংসের গ্রিল অথবা শাসলিক। তবে সেটা যে নিয়মিত খাই, তেমন না। রেডমিট খেতে হয় হিসাব করে।’
প্রতিযোগিতার আগে খাবারের রুটিন কিছুটা পাল্টে যায়। ওই সময় তিন বেলার বদলে চার বেলাও খেতে হয়। খাবার থেকে অনুশীলন—সবই তখন কোচের কথামতো চলে।