১৮ বছর পর্যন্ত লিখতে-পড়তে পারতেন না, এখন কেমব্রিজের অধ্যাপক
১৯৯৪ সালের মে মাসের এক দিনের কথা। ৯ বছর বয়সী পুত্রকে নিয়ে দক্ষিণ লন্ডনে শিশুমনোবিদের দ্বারস্থ হয়েছেন এক মা। তিন বছর বয়সেই শিশুটির মধ্যে ‘অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার’ দেখা দিয়েছিল। মনোবিদই জানালেন, শিশুটি কানে শুনতে পায় না, বাকি জীবনও তাকে এভাবেই পার করতে হবে। এ-ও বললেন, তার বোধশক্তি দুর্বল। ফলে সব সময়ই সমবয়সীদের থেকে বুদ্ধি ও জ্ঞানে সে ১০-১৫ বছর পিছিয়ে থাকবে।
মনোবিদের এসব কথায় ভীষণ আঘাত পেয়েছিলেন সেই মা। তবে হাল ছাড়েননি। চিকিৎসককে সেদিনই জবাব দিয়েছিলেন, ‘আমি জানি, আমার ছেলেটা একদিন দারুণ সব কাজ করবে। আর সেদিন হাসি থাকবে আমার মুখে। কারণ, সমগ্র বিশ্ব তখন আমার সন্তানের কাজ দেখতে ব্যস্ত থাকবে।’
২৮ বছর পরের কথা। সব বাধা অতিক্রম করে কেমব্রিজের শিক্ষক হতে চলেছেন সেই শিশু । তাঁর নাম জেসন আরডে। জেসনকে বলা হচ্ছে যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বকনিষ্ঠ কৃষ্ণাঙ্গ অধ্যাপক।
চিকিৎসকের ভাষায় ‘পিছিয়ে পড়া’ এক শিশু থেকে ইতিহাসের পাতায় নাম লিখিয়ে নেওয়া জেসনের জীবনটা সংগ্রামে ভরা। দক্ষিণ-পশ্চিম লন্ডনের ক্ল্যাফামে বেড়ে ওঠা জেসন শ্বেতাঙ্গদের বর্ণবাদী আচরণ দেখেছেন নিজ চোখে। কিন্তু সব ছাপিয়ে তাঁর মূল লড়াই ছিল নিজের সঙ্গে। অটিজমের কারণে তাঁর শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি স্বাভাবিক গতিতে এগোয়নি। ১১ বছর বয়স পর্যন্ত কথা বলতে পারতেন না, ইশারা ভাষাই ছিল ভরসা। ১৮ বছর পর্যন্ত লিখতে–পড়তেও পারতেন না। ফলে শৈশবের বেশির ভাগ সময় তাঁকে কাটাতে হয়েছিল স্পিচ থেরাপিস্ট ও মনোবিদদের কাছে।
পড়াশোনার খরচ জোগাতে বিভিন্ন চেইন সুপার শপে লাগাতার কাজ করে গেছেন জেসন। শিক্ষাজীবনে দুটি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পাশাপাশি ‘ইউনিভার্সিটি অব সারে’ থেকে শারীরিক শিক্ষা নিয়েও ডিগ্রি নেন তিনি। তাঁর একাডেমিক সাফল্যের ঝুড়িতে একটি পিএইচডিও আছে। ২০১৬ সালে ‘লিভারপুল জন মুরস’ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডির গবেষণা শেষ করেন। যে শিক্ষা কার্যক্রম থেকে জীবনের ১৮টি বছর বঞ্চিত ছিলেন, পরে সেই একাডেমিক দুনিয়াকেই করে তোলেন পেশা। কর্মজীবন শুরু করেন ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে। এরপর গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব এডুকেশনে সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক হন।
কিন্তু জেসন আরডের সাফল্যগাথা এখানেই থেমে থাকেনি। ১০ বছর আগে পিএইচডি করার সময় তিনি তাঁর মায়ের শোবার ঘরের দেয়ালে ব্যক্তিগত লক্ষ্যগুলো বড় করে লিখে রেখেছিলেন। এই তালিকার তিন নম্বরে ছিল, ‘একদিন অক্সফোর্ড বা কেমব্রিজে কাজ করব।’ আগামীকাল তাঁর সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেবে। মাত্র ৩৭ বছর বয়সেই জীবনের বড় একটি লক্ষ্য পূরণ করেছেন জেসন আরডে, হয়েছেন স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক।
বিশ্বাসের সঙ্গে পরিশ্রম থাকলে যেকোনো কিছুই সম্ভব—এ মন্ত্রে বিশ্বাসী জেসন আরডে বলেন, ‘আমি জানতাম, বিপুল প্রতিভা আমার নেই, তবে এটাও জানতাম যে কতটা দৃঢ়ভাবে আমি লক্ষ্যে পৌঁছাতে চাই। আর এর জন্য কতটা কঠোর পরিশ্রম করতে পারি!’
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান