শৈশবেই সন্তানকে যেভাবে মানবিকতা শেখাবেন
সামাজিক অস্থিরতার সমসাময়িক চিত্র সবার দৃষ্টিতেই প্রকট। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, কেউ কাউকে ন্যূনতম ছাড় দিতেও রাজি না। হাতাহাতি পর্যন্ত গড়ায় তুচ্ছ কোনো বিষয়। কিশোর গ্যাঙের ত্রাস ছড়ানোর খবর আমাদের আতঙ্কিত করে। যদি মায়া–মমতা, ভালোবাসা আর সহমর্মিতার চর্চা শৈশব থেকেই করানো হয়, তাহলে খুব কমসংখ্যক মানুষ অমন নেতিবাচক পথে ধাবিত হবেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মিজানউদ্দিন বলেন, কোনো ব্যক্তি ‘মানুষ’ হিসেবে কেমন, সেটি তাঁর বেড়ে ওঠার পরিবেশের ওপর নির্ভর করে। অধিকাংশ প্রাণীই জন্মের পর খুব দ্রুত স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে। কিন্তু মানবশিশুকে ‘মানুষ’ করে তুলতে হয়। সামাজিক মানুষ গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। উদাহরণ হিসেবে সাবেক এই উপাচার্য বলেন জাপানের শিশুদের কথা। পরস্পর আলাপচারিতার সময় নম্রতা ও ভদ্রতার শিক্ষা জাপানের শিশুদের দেওয়া হয় বাড়িতেই। বড় হওয়ার পরেও সেই ভদ্র আচরণ বজায় রাখেন জাপানিরা।
‘সহযোগিতা’ আর ‘দয়াশীল’ শব্দ দুটি অনেক শিশুর জন্যই বেশ কঠিন। তবে শব্দ হিসেবে জানার চেয়েও অনেক বেশি জরুরি হলো প্রাত্যহিক আচরণে এই বিষয়গুলোকে যুক্ত করে নিতে পারার সক্ষমতা। হুট করে এমন গুণের অধিকারী হওয়া যায় না। একেবারে ছোটবেলা থেকেই শুরু করতে হয় চর্চা। আপনার সন্তানকে বয়স অনুযায়ী ধীরে ধীরে এসব বিষয়ে অভ্যস্ত করে তুলুন। নিজের আচরণেও বজায় রাখুন আদর্শ। কারণ, শিশুরা অনুকরণপ্রিয়।
শিশুর পরিবারের জন্য
শিশুকে পরিবারের প্রাত্যহিক কাজে যুক্ত করতে পারেন। নিজের মতো করে সে মা-বাবার কাজে সহযোগিতা করুক। রান্নাবান্নার মতো ঘরোয়া কাজে এটা-ওটা এগিয়ে দিতে দিতেই শিশু শিখবে, সবাইকেই সাধ্যমতো সাহায্য করা উচিত। শিশু বিছানা গোছানোর মতো বড় হয়নি? তাতে কী! শিশুকে বালিশটা জায়গামতো রাখতে শেখান। এভাবেই ধীরে ধীরে আপনাকে সাহায্য করতে শিখবে সে। তবে জবরদস্তি করা যাবে না; বরং আপনাকে সাহায্য করতে তাকে অনুরোধ করুন। তার কাজে উৎসাহ দিন। অভিভাবক কাজে ব্যস্ত থাকলে একটি শিশু তার ছোট ভাইবোনকে নিয়ে খেলতেও পারে, যাতে তারা অভিভাবককে বিরক্ত না করে। সে তাদের পড়ালেখাতেও সাহায্য করতে পারে।
অন্যদের সঙ্গে আচরণ
শিশু যাতে কাউকে প্রতিযোগী না ভাবে, সেদিকে খেয়াল রাখুন। প্রথম হতেই হবে, অমুকের চাইতে ভালো করতে হবে—এমন বাক্য অসুস্থ প্রতিযোগিতার অবতারণা করে। শিশু নিজের পড়া পড়ুক। আনন্দ নিয়ে কিছু শিখুক। নিজে কোনো বিষয় ভালো বুঝলে অন্যদেরও বুঝিয়ে দিক। অহংকার না আসুক তার মনে। অন্যদের সঙ্গে খেলার সামগ্রীও ভাগ করে নিতে পারে শিশু।
তাকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে শেখান। ‘ধন্যবাদ’ বলতে তার যাতে দ্বিধা না থাকে।
কারও সাহায্য প্রয়োজন হলে কীভাবে তাঁকে অনুরোধ করা উচিত, ছোটবেলা থেকেই সেটির চর্চা শুরু হোক।
প্রতিবেশী, শিক্ষক এমনকি অচেনা মানুষকে সহযোগিতা করার সুযোগ থাকলে তাতেও শিশুকে উৎসাহ দিন। ধরা যাক, আপনি আপনার সন্তানকে নিয়ে লিফটে করে ওপরে যাচ্ছেন। ওদিকে হয়তো লিফট পর্যন্ত হেঁটে আসতে একজন বয়স্ক ব্যক্তির একটু বেশি সময় লাগছে। এমন অবস্থায় শিশুকে বলুন, ওই ব্যক্তি আসা পর্যন্ত আপনারা লিফট আটকে রাখতে চাচ্ছেন। চাইলে শিশুটি নিজেও লিফট ধরে রাখার বোতাম চাপতে পারে।
শিশুর সমবয়সী বন্ধু কিংবা কোনো সামাজিক দায়িত্বে থাকা বয়স্ক ব্যক্তির (যেমন নিরাপত্তাকর্মী) জন্য কখনো কখনো ‘ধন্যবাদ কার্ড’ বানিয়ে দিতে পারে শিশু। অসুস্থ কারও জন্যও শুভেচ্ছা বার্তা লিখতে পারে।
সমাজ যাঁদের ‘নিচু’ মনে করে, তাঁদের জন্য আপনি কিছু করলে অবশ্যই সেই কাজে শিশুকে সঙ্গে নিন। এতে তার মধ্যে সব মানুষকে সমান চোখে দেখার চর্চা গড়ে উঠবে।
অন্যের প্রশংসাও করতে শিখুক শিশু। সেই শিক্ষা বাড়িতেই দিতে হবে।
প্রাণ ও প্রকৃতির জন্য, অসহায় মানুষের জন্য
অসহায় মানুষ এবং প্রাণীর জন্য সামান্য কিছু হলেও করুক শিশু। অসহায় মানুষকে হয়তো খাবার দেবেন, খাবারের বাক্সটি গোছাতে শিশুর সাহায্য নিন। গাছপালা পরিচর্যায় উৎসাহ দিন। বাড়ির পোষা প্রাণী দেখভালের কাজেও শিশুকে সঙ্গে নিন। বারান্দায় পাখির জন্য পানি বা কিছু খাবার রেখে দেওয়া কিংবা বাড়ির সামনে পথপ্রাণীর তৃষ্ণা মেটাতে পানি বা উষ্ণতা জোগাতে চটের বস্তা রেখে দেওয়ার মতো কাজে উৎসাহ দিন। তাকে বুঝিয়ে দিন, প্রতিটি প্রাণীরই অনূভূতি আছে। প্রতিটি প্রাণীর কষ্ট হয়। কাউকে কষ্ট না দেওয়া এবং সম্ভব হলে কারও কষ্ট কমিয়ে দেওয়াতেই আমাদের সার্থকতা।