দুই বছরে এসে শিশুরা কেন জেদি আর রাগী হয়?
গুটি গুটি পায়ে হাঁটছে বাচ্চা। আধো বোলে মাতিয়ে রাখছে পুরো পরিবার। তার মধ্যেই হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করলেন, সে ভীষণ জেদি আর একগুঁয়ে হয়ে উঠেছে। তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেও বোঝানো যাচ্ছে না। আবার সে যা বোঝাতে চেষ্টা করছে, হয়তো আপনি তা বুঝতে পারছেন না। জেদাজেদি থেকে অনেক সময় এমন পরিস্থিতিরও সৃষ্টি হয় যে শিশুকে আঘাত করতে উদ্যত হন অনেক অভিভাবক।
দুই বছর বা তার কাছাকাছি বয়সটাতে বেশির ভাগ শিশুর ক্ষেত্রে এমনটা হতে দেখা যায়, এতে ঘাবড়ানোর কিছু নেই, এটা শিশুর স্বাভাবিক বিকাশেরই অংশ। কারও কারও ক্ষেত্রে ৪ বছর বয়স পর্যন্তও এমনটা ঘটতে দেখা যায়। এ সময়টাকে বলা হয় ‘টেরিবল টুজ’ (ভয়ংকর দুই)। বড় হতে হতে নতুন অনেক কিছু শেখে শিশু। নিজে নিজে সে এগুলোর প্রয়োগও ঘটাতে চায়। এই যেমন বাসায় একলা হাঁটতে পারছে ভেবে পথে হাঁটার সময় আপনার আঙুল ধরতে আপত্তি জানাতে পারে শিশু। ব্যস্ত সড়কে তার এই অবুঝ হাঁটাহাঁটি যে মারাত্মক দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে, সেই বোধটুকু জন্মায় না বলেই এই বিপত্তি। অনেক সময় আবার অনেক কাজ ঠিকঠাক পেরেও ওঠে না শিশু। তার হয়তো ইচ্ছা হলো, জগ থেকে নিজেই পানি ঢেলে খাবে। কিন্তু তা করতে গিয়ে টেবিলে গড়িয়ে পড়ল পানি, টেবিল থেকে মেঝেতে। অমনি তার মেজাজ গেল বিগড়ে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের শিশু বিভাগের কনসালট্যান্ট তাসনুভা খান বলেন, ‘শিশু এই ধাপটি পেরনোর সময় অভিভাবকদের একটু কৌশলী হতে হবে। অভিভাবকদের আচরণ এমন হতে হবে, যাতে শিশু নিজেকে গুরুত্বপূর্ণও বোধ করে। আবার জেদ করলেই সব পাওয়া যায়, এই ধারণা যেন শিশুর মধ্যে না গড়ে ওঠে। তাই শিশুর কিছু দাবি যেমন মানতে হবে, তেমনি কিছু অযৌক্তিক দাবি পূরণ করা যাবে না। এটা শিশুকে যুক্তি দিয়ে বোঝাতে হবে।’
শিশুর কোনো ইচ্ছাপূরণ না করা হলে এর বদলে তাকে অন্য কোনো উপহার দেওয়ার অভ্যাস করাও ঠিক নয়। বরং তাকে একটা গল্প শোনাতে পারেন, একটু বাড়তি সময় দিতে পারেন।
জেদি আচরণ
নানান কাজে ব্যর্থতার কারণে কিংবা নিজের কথা অপরকে বোঝাতে না পেরে বিরক্ত হয়ে যায় শিশু। চিৎকার করে বা মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কান্নাকাটি করে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। জিনিসপত্র ছোড়াছুড়ি, লাথি দেওয়া, কাউকে কামড়ানো বা আঘাত করার মতো আচরণও করে। কখনো কখনো মুহূর্তেই বিগড়ে যায় হাসিখুশি শিশুর মেজাজ। বিপরীতধর্মী অনুভূতিতে শিশুর আচরণও হয়ে পড়ে অস্থিতিশীল। এই সবই তার মনের মধ্যে চলতে থাকা নৈরাশ্যের প্রভাব।
সামলাবেন কী করে
শিশু যতই উত্তেজিত হোক, শান্ত থাকুন। ধমকাবেন না। রাগ দেখাবেন না। আঘাত করবেন না। অন্য কারও সন্তান আপনার সন্তানের সঙ্গে জেদ করলে তার অভিভাবকের প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করবেন না। আপনার সন্তানের জন্য অন্যকে ছাড় দিতে বলবেন না। বরং পরিস্থিতি যেটাই হোক, কোমল আচরণ করুন। শিশুর সামনে কোনো নেতিবাচক আচরণ করা যাবে না। মনে রাখবেন, সন্তানের কাছে আপনিই প্রথম রোল মডেল। উত্তেজনার মুহূর্তে অনেক সময় বুঝিয়েও কাজ হয় না। তাই শিশু জেদ করতে থাকলে বরং তার মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করুন। মজার কোনো জিনিসের দিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন। বাড়ির বাইরে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হলে তাকে ওই জায়গা থেকে সরিয়ে নিন। তার পছন্দের বা ভালো লাগার কিছু দিয়ে তাকে শান্ত করতে চেষ্টা করুন।
জটিল পরিস্থিতি এড়াতে
শিশুর খাওয়াদাওয়া এবং ঘুমের সময় ঠিক রাখুন। দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকলে কিংবা ক্লান্তি ভর করলে এমনিতেই খিটখিটে হয়ে যেতে পারে মেজাজ।
শিশুকে নিয়মানুবর্তিতা নিশ্চয়ই শেখাবেন। কিন্তু নিয়মগুলো যাতে খুব বেশি বাঁধাধরা গোছের না হয়, খুব কঠিন কিছু না হয়। অতিরিক্ত কড়া শাসন ভালো নয়।
শিশুকে বুঝিয়ে দিন, সব সময়ই আপনি তার মতামতকে গুরুত্ব দেন। আজ কী রঙের পোশাক পরতে চায় সে কিংবা ডিম পোচ নাকি ভাজি খেতে আজ তার মন চাচ্ছে, এখন কোন খেলনাটা নেবে—এমন নানান প্রশ্নে নিজেকে সে গুরুত্বপূর্ণ অনুভব করবে।
শিশু বিপজ্জনক কিছু করতে চাইলে তাকে বিপদগুলোর কথাও অল্পস্বল্প করে বুঝিয়ে বলুন।
শিশুর ইতিবাচক কাজগুলোর প্রশংসা করুন। তার কাজের প্রচেষ্টাকে সম্মান জানান। ভুলের জন্য কটূক্তি করবেন না।
কোনো কাজে আগ্রহ প্রকাশ করলে তাকে সেই কাজের সঙ্গী করে নিন। ক্ষুদ্র কোনো দায়িত্ব দিন। হয়তো সেই দায়িত্ব আদতে কোনো দায়িত্বই না। তবু আপনি যা বলছেন, শিশু তা করার চেষ্টা করলে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন। তুমি ছোট, তুমি এটা পারবে না—এ ধরনের কথা বলে তাকে আশাহত করবেন না।
কখন নেবেন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ?
এমন জেদ সাধারণত ৩-৪ বছর বয়সের মধ্যে কমে যাওয়ার কথা। বা সমস্যা থাকলেও তীব্রতা কমে আসে। তবে কিছু আচরণ এই বাড়ন্ত শিশুদের বিকাশের নেতিবাচক দিককেও বোঝাতে পারে। এমন কিছু লক্ষ্য করলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত—
নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া।
স্বাভাবিকভাবে অন্যদের নিজের দিকে আকর্ষণ না করা।
চোখের দিকে না তাকানো।
হিংস্র আচরণ করা, কোনো মানুষ বা প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর আচরণ করা, নিজের ক্ষতি করা।
সবকিছুতেই তর্ক করা।
প্রায়ই অতিরিক্ত জেদ করা, যা সামলানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।
সূত্র: হেলথলাইন