বাংলাদেশে সিলিং ফ্যানশিল্পের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী?
গরমের সময় শীতল বাতাস দিয়ে প্রশান্তির পরশ বুলিয়ে দেয় সিলিং ফ্যান, তা ছাড়া বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলেও সিলিং ফ্যানের ব্যবহার উল্লেখ্যযোগ্য হারে বাড়ছে। চাহিদা মেটাতে বাজারে আসছে নতুন নতুন কোম্পানি। গ্রাহকের মোট চাহিদার ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ সিলিং ফ্যান দেশেই উৎপাদিত হয়। যমুনা ফ্যানের মতো বৃহৎ পরিসরে সাত থেকে আটটি কোম্পানি ফ্যান উৎপাদন ও বিপণন করে। এ ছাড়া শতাধিক ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান দেশে ফ্যান উৎপাদন করে থাকে। দেশে সিলিং ফ্যানশিল্পে আমদানি–নির্ভরতা অনেকাংশে কমে গেছে। এ ছাড়া বিদ্যমান কোম্পানিগুলো এ শিল্পে বিনিয়োগ ও উৎপাদনের পরিমাণ বাড়াচ্ছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ফ্যানের বাজার কেমন পরিবর্তিত হয়েছে?
আপনারা সবাই অবগত আছেন যে গত বছর প্রচণ্ড তাপদাহে মানুষের স্বাভাবিক জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। গরমের এই তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় ফ্যানের চাহিদা ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বেড়ে যায়। ফলে বর্ধিত চাহিদা মেটাতে প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের উৎপাদনের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। দুই দশক আগেও বাজারে নন-ব্র্যান্ডের ফ্যানের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। ভারত, পাকিস্থান ও চীন থেকে আমদানি করা হতো বিভিন্ন ধরনের ফ্যান। তবে অত্যন্ত আশার কথা যে যমুনা ফ্যানের মতো বৃহৎ ও স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানগুলো দেশেই তৈরি করছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মানসম্মত ফ্যান।
বিভিন্ন ধরনের ফ্যানের মধ্যে দেশে সিলিং ফ্যানের চাহিদাই বেশি। এ ছাড়া টেবিল ফ্যান, ওয়াল ফ্যান, স্ট্যান্ড ফ্যান, রিচার্জেবল ফ্যান, এগজস্ট ফ্যানসহ নানা ধরনের ফ্যান দেশেই তৈরি হচ্ছে।
বৈশ্বিক অর্থনীতির অবস্থা বা কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি কি এ খাতে কোনো প্রভাব ফেলেছে?
বৈশ্বিক অর্থনীতির টালমাটাল অবস্থা, ডলার–সংকটসহ নানাবিধ অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা এ শিল্পকে কিছুটা চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। ক্যাপাসিটর, বেয়ারিং, ব্লেডসিট, সিলিকন সিটসহ বেশ কিছু কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। এসব কাঁচামাল আমদানিতে উচ্চমূল্যে আমদানি শুল্ক দিতে হয়, ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। ক্রেতাকে উচ্চমূল্যে পণ্য ক্রয় করতে হয়।
বর্তমানে সিলিং ফ্যানের ক্ষেত্রে কী ধরনের নতুন প্রযুক্তি বা ফিচার গ্রাহকেরা বেশি পছন্দ করছেন?
বর্তমানে গ্রাহকেরা বিদ্যুৎসাশ্রয়ী ও উন্নত প্রযুক্তির সিলিং ফ্যানের প্রতি বেশি আগ্রহ প্রকাশ করছেন। বিশেষ করে বিএলডিসি (ব্রাশলেস ডিসি) মোটরযুক্ত ফ্যানগুলো জনপ্রিয়তা পাচ্ছে, কারণ এগুলো প্রচলিত ফ্যানের তুলনায় প্রায় ৬৫ শতাংশ বেশি বিদ্যুৎ সাশ্রয় করতে সক্ষম। উদাহরণস্বরূপ, যমুনা তাদের বিএলডিসি ফ্যানে পাঁচ বছরের বিক্রয়োত্তর সেবা প্রদান করছে, যা গ্রাহকদের মধ্যে আস্থা বাড়িয়েছে।
শক্তিসাশ্রয়ী বা স্মার্ট প্রযুক্তির সিলিং ফ্যানের বাজার কেমন? বাংলাদেশি গ্রাহকদের এ বিষয়ে আগ্রহ কেমন?
বাংলাদেশে শক্তিসাশ্রয়ী বা স্মার্ট প্রযুক্তির ফ্যানের বাজার দ্রুত বাড়ছে। ইলেকট্রনিকস অ্যাপ্লায়েন্স খাতে বিদ্যুৎসাশ্রয়ী প্রযুক্তির ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে, যা গ্রাহকদের মধ্যে এই পণ্যের প্রতি আগ্রহের প্রতিফলন। বাসাবাড়িতে এই প্রযুক্তির ফ্যান ব্যবহারে বছরে কয়েক হাজার টাকার বিদ্যুৎ বিল সাশ্রয় হবে আর শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ৬৫ শতাংশের বেশি বিদ্যুৎ সাশ্রয় করা সম্ভব। সাম্প্রতিক সময়ে এনার্জি সেভিং ফ্যানের বিক্রি ১০ থেকে ২০ শতাংশ বেড়েছে, যা গ্রাহকদের মধ্যে শক্তিসাশ্রয়ী ফ্যানের প্রতি আগ্রহের ইঙ্গিত দেয়।
পরিবেশবান্ধব পণ্য বা টেকসই প্রযুক্তি নিয়ে আপনার কোম্পানি কী ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে?
আমরা পরিবেশবান্ধব পণ্য ও টেকসই প্রযুক্তির উন্নয়নে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। যেমন আমরা সর্বনিম্ন ৬৫ ওয়াটের ইন্ডাকশন মোটরের সিলিং ফ্যান বাজারে সরবরাহ করছি এবং ৩০ থেকে ৩২ ওয়াটের মধ্যে বিএলডিসি বিদ্যুৎসাশ্রয়ী ফ্যান উৎপাদনে জোর দিচ্ছি, যা পরিবেশ সুরক্ষায় সহায়ক। সরকারি প্রতিষ্ঠান অ্যাটলাস বাংলাদেশ লিমিটেড বিদ্যুৎসাশ্রয়ী সিলিং ফ্যান উৎপাদন করছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের ফ্যানের জন্য বিএলডিসি মোটর উৎপাদনের কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছি, যা দেশের বিদ্যুৎ খরচ কমাতে সহায়ক হবে।
আপনার কোম্পানির বাজার শেয়ার বর্তমানে কতটুকু এবং আপনারা কীভাবে এ অবস্থান ধরে রাখছেন?
বাংলাদেশে সিলিং ফ্যান কথাটির সঙ্গে ‘যমুনা’ নামটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং আবেগের। কারণ, স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে দেশীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেকে উৎপাদিত একমাত্র ফ্যান যমুনা, যা আজও সমানভাবে জনপ্রিয়। এ জন্য সিলিং ফ্যান তৈরি ও বাজারজাতকরণে যমুনাকে পাইওনিয়ার বলা হয়। ১৯৭৮ সালে উৎপাদন শুরু করা যমুনা ফ্যান দেশের সর্বস্তরের মানুষের আজও পছন্দের ফ্যান। ঐতিহ্য, গুণগতমান ও দীর্ঘস্থায়িত্বের জন্য চার যুগের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের শহর কিংবা গ্রাম সব জায়গায় যমুনা ফ্যান সমান সমাদৃত। নিজস্ব কারখানায় অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি হয় যমুনা ফ্যান। আধুনিক ল্যাবে উৎপাদনের প্রতিটি ধাপের মান কঠোরভাবে পরীক্ষা করা হয়। ফলে আমাদের সম্মানিত ক্রেতারা বাজারের সর্বোৎকৃষ্ট পণ্যটি পেয়ে থাকেন।
বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বাজারে নতুন কোম্পানিগুলোর প্রবেশ কীভাবে প্রভাব ফেলছে?
আমি আগেই বলেছি, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি, শহর কিংবা গ্রাম-গঞ্জে ঘরে ঘরে বিদ্যুতায়ন, শিক্ষা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মাদ্রাসা, কলকারখানাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বাড়ছে ফ্যানের ব্যবহার। ফলে নতুন নতুন কোম্পানি ফ্যান উৎপাদন ও বাজারজাত করছে। দেশে উৎপাদন বাড়িয়ে ফ্যানকে আরও সহজলভ্য ও সুলভ মূল্যে ক্রেতাদের হাতে পৌঁছে দিতে তাদের প্রভাব অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।
আপনার কোম্পানির মূল প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা কী?
সময়ের পথপরিক্রমায় অনেকেই ফ্যান উৎপাদন ও বিপণন কাজে নিয়োজিত, আবার অনেকেই চায়নিজ বা অন্যান্য দেশের পণ্য এনে বিপণন করছেন কিন্ত গুণগতমান আর দীর্ঘস্থায়িত্বের জন্য যমুনা ফ্যান আজও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ১০০ শতাংশ বিশুদ্ধ সুপার এনামেল্ড কপার ও সিলিকন স্টিল, অ্যারোডায়নামিক ডিজাইন, সর্বোচ্চ বিদ্যুৎসাশ্রয়ী ও বুয়েট–স্বীকৃত বাংলাদেশের সর্বোৎকৃষ্ট ফ্যান যমুনা।
আগামী পাঁচ বছরে সিলিং ফ্যান বাজারের কী ধরনের পরিবর্তন আশা করা যায়?
গ্রাহকচাহিদা বিবেচনায় প্রতিটি পণ্যেই সতত পরিবর্তন, পরিমার্জন ও আপগ্রেডেশন হয়ে থাকে। বর্তমান সময়ে বিএলডিসি ফ্যান গ্রাহকের কাছে খুবই জনপ্রিয় ও সমাদৃত। সর্বাধুনিক প্রযুক্তির এ ফ্যান যেমন ভালো শীতলতা দিতে পারে; তেমনই বিদ্যুৎখরচও কমায় সর্বোচ্চ। নিত্যনতুন চাহিদা আর প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনে সিলিং ফ্যানসহ অন্যান্য ফ্যানেও ভবিষ্যতে নানা ধরনের পরিবর্তন আসবে।
আপনাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
সর্বাধুনিক প্রযুক্তি, গুণগতমান আর দীর্ঘস্থায়িত্বের জন্য যমুনা ফ্যান দীর্ঘ চার যুগের বেশি সময় ধরে বাংলার ঘরে ঘরে জনপ্রিয়। গ্রাহকের সন্তুষ্টি আর তাঁদের চাহিদা বিবেচনায় একদল নিবেদিতপ্রাণ কর্মী যমুনা ফ্যান উৎপাদন করছেন। আমরা সময়ের চাহিদা অনুসারে সিলিং ফ্যানের পাশাপাশি স্ট্যান্ড ফ্যান, ওয়াল ফ্যান, নেট ফ্যান, হাইস্পিড ফ্যান, রিচার্জেবল ফ্যান, এগজস্ট ফ্যানসহ অন্যান্য বৃহৎ ফ্যান তৈরি করছি। তা ছাড়া আমাদের উৎপাদিত সর্বাধুনিক প্রযুক্তির বিএলডিসি ফ্যান ইতিমধ্যেই বাজারে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করছে। যমুনা বিএলডিসি ফ্যান পরিবেশবান্ধব এবং রিমোট কন্ট্রোল থাকায় ব্যবহার খুবই সুবিধাজনক। এ ছাড়া পাওয়ার সেভিং মোড থাকায় বিদ্যুৎ খরচ করে সবচেয়ে কম।
এই শিল্পের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ কী কী এবং সেগুলো মোকাবিলায় আপনারা কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন?
কাঁচামাল আমদানি সহজীকরণ, সরকারি নীতিসহায়তা এ শিল্পকে এগিয়ে নিতে পারে। দেশীয় শিল্প বিকাশে সরকারের কিছু সহায়তা, শুল্ক ও কর হ্রাস, সহজ শর্তে ঋণ প্রদান এ শিল্পকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করবে।