২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

শেফালী আজও খুঁজে ফেরেন বাংলাদেশ

শেফালী রনটির জন্ম বাংলাদেশে
ছবি: সাইফুল ইসলাম

চার বছর আগে এশিয়ান আর্ট বিয়েনালে অংশ নিতে ঢাকায় এসেছিলেন। এবারও অভিন্ন উপলক্ষে আসা। নিজের নির্ধারিত কাজের বাইরে সময় করে একদিন আমার বাসায় গিয়েছিলেন তাঁর ব্যবসায়িক পার্টনার স্যামি আইজ্যাকসেনকে নিয়ে। আবদার ছিল ঝাল ঝাল তরকারি, ভাত, ডাল আর মাছ খাওয়ার। সঙ্গে মিষ্টিমুখ হিসেবে আমার স্ত্রী তাঁদের জন্য খেজুর গুড়ের পায়েস বানিয়েছিলেন।

বাটিটা হাতে নিতেই তিনি কেমন আনমনা হয়ে যান। ভেতরে–ভেতরে হাতড়াতে থাকেন কিছু। তাঁর অবস্থা অনুমান করে বলি, ‘কী ভাবছেন, খাচ্ছেন না যে?’ আমার কথায় সংবিৎ ফেরে। সামলে নিয়ে খেতে থাকেন। আর বলেন, ‘এই সৌরভ, এই স্বাদ আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই ছেলেবেলায়। সেই চট্টগ্রামের এক অজগ্রামে। যেখানে এমন সুবাস আমি পেয়েছি প্রতি শীতে। সেই স্মৃতি আমাকে আজও তাড়িয়ে ফেরে।’ এই ৫০ পেরিয়েও। কথা বলতে বলতে তাঁর চোখের কোণ ভিজে ওঠে।

এক বন্ধুর মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় চার বছর আগে। সোনারগাঁও হোটেলের লবিতে বসে কথা বলেছিলাম বেশ অনেকক্ষণ। নিজের ভেতরে জমিয়ে রাখা কথার ঝাঁপি সেদিন খুলে বসেছিলেন। এরপর দেখা না হলেও শেফালী আমার বন্ধু হয়ে যান। তাই এবার আসার আগে তাঁর নানা পরিকল্পনা শেয়ার করেছেন। যার কতক আমি চেষ্টা করেছি বাস্তবায়নে সহায়তা করতে।

শেফালীর পোশাকি নাম অ্যান রনটি। যদিও নিজেকে তিনি আবিশ্ব পরিচিত করিয়েছেন শেফালী রনটি নামে। অভাবের সংসার আর সৎমায়ের কাছ থেকে বাঁচানোর জন্য দাদু তাঁকে চট্টগ্রামের এক খ্রিষ্টান মিশনারিতে দিয়ে দেন। সেখানকার সিস্টাররা তাঁর নাম দেন শেফালী। সেখানে কিছুদিন ছিলেন। এরপর চলে যান ডেকমার্কে। তাঁকে দত্তক নিয়েছিল এক দিনেমার পরিবার।

স্বাধীনতার মাত্র বছর দুয়েকের মধ্যে শেফালীর জন্ম। পারিবারিকভাবে তাঁরা ছিলেন জেলে। অভাবের সংসার। তাই লেখাপড়াও হয়নি। বরং আর পাঁচটা বাচ্চার মতোই গরু–ছাগল দেখা আর বনবাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো ছিল কাজ। খাবার জুটত না তেমন। শেফালীর বয়স তখন মাত্র ছয়, একদিন বিকেলে বারান্দায় বসে ছিলেন মা। মেয়ে মায়ের গলা ধরে দোল খাচ্ছিলেন। সেই সময়েই হঠাৎ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তাঁর মা। এই অদ্ভুত ধাক্কাটা তিনি আজও সামলে উঠতে পারেন না।

এশিয়ান আর্ট বিয়েনালে অংশ নিতে ঢাকায় এসেছেন শেফালী
ছবি: সাইফুল ইসলাম

সেটা ছিল ১৯৭৯। বাবা আবার বিয়ে করেন। মা হারা মেয়েটাকে তাই দিয়ে দেওয়া হয় আশ্রমে। সেখানে তিনি থাকতেন ভীষণই স্তব্ধবাক। তবে একটা গান আজও তাঁর মনে আছে। সবাই মিলে গাইতেন আর শেফালী শুনতেন, ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে…।’ এবারও সেই দুই লাইন গেয়ে শোনান গুন গুন করে।

এবারও তাঁর সঙ্গে কথা হয় সোনারগাঁও হোটেলের লবিতে বসে। বলছিলেন তাঁকে দত্তক নেওয়ার সেই গল্প। কোপেনহেগেন নয়, তাঁর পালিত মা–বাবা ছিলেন পুব উপকূলের শহর আরহুসের। সেখানে যাওয়ার পর তাঁর নাম দেওয়া হয় অ্যান রনটি। কিন্তু ভাগ্য পুনর্বার তাঁকে নিয়ে মশকরায় মেতে ওঠে। অকপটে বলেন, তাঁকে পছন্দ হয়নি তাঁর মায়ের। ফলে বাবাকে ডিভোর্স দিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই এক ধনাঢ্যর সঙ্গে চলে যান।

এই বাবাও সচ্ছল ছিলেন না। কাজের জন্য তাঁকে বাইরে যেতেই হতো। তাই ছয়-সাত বছরের মেয়েটাকে দ্রুত বড় হয়ে উঠতে হয়। শিখে নিতে হয় দিনেমার ভাষা। শিখে নিতে হয় কাজ। সারা দিন পর বাবা এসে অবশ্য তাঁকে রান্না করে খাওয়ান। স্কুলে যাওয়াও শুরু হয়েছে তত দিনে। ক্লাসে তাঁর মন বসে না। অথচ তাঁকে একের পর এক ক্লাসে উঠিয়ে দেওয়া হয়। তাঁর শেখা হয় না কিছুই। এরই মধ্যে সময়ের নিয়মে শিশু থেকে কৈশোর পেরিয়ে নারী হয়ে উঠতে হয় মাঝবয়সী এক পুরুষের সঙ্গে থেকে। এসব আজও তাঁর অতৃপ্তি আর মনোবেদনার কারণ হয়।

তবে স্কুলজীবনের অসহায় পরিস্থিতিতে ত্রাতা হন এক শিক্ষক। তখন ক্লাস নাইন। বেছে নিতে হবে পরবর্তী লক্ষ্য অনুযায়ী বিষয়। সেই শিক্ষক তাঁর বাবাকে বুঝিয়ে রাজি করান পারফর্মিং আর্টে পড়ার। নাচ আর গানে শেফালী ছিলেন পারদর্শী। পরে লন্ডনের ফেম স্কুলে নাচ শেখা ও পড়ার জন্য সরকার থেকে অর্ধেক বৃত্তি পেলেও বাকিটা বাবা দিতে না পারায় সেই স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিতে হয়।

শেফালী রনটি

এরপর অনেক পথ পার হয়েছেন শেফালী। গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবে কাজ করেছেন। সেখানে পরিচয় হয় যে ব্যক্তির সঙ্গে, তিনি এখন তাঁর স্বামী। জীবনের প্রথম কোনো সহৃদয় মানুষ। তাঁর এক মেয়ে আর এক ছেলে। নিজের অপ্রাপ্তির আঁচ লাগতে দেন না সন্তানদের। তবে এরই মধ্যে স্বশিক্ষিত শিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। দুবাইয়ে মেন্টর হিসেবে কাজ করেছেন। তাঁর ছবির প্রদর্শনী হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। পরিব্রাজকের মগ্নতায় ঘুরে বেড়ান। তাঁর আঁকায় ফিরে ফিরে আসেন মা। ‘ট্রিবিউট টু মাদার’ শেফালীর আলোচিত সিরিজ।

১৯৯৬ সালে কমল সেনগুপ্ত নামের জনৈক ভদ্রলোকের মাধ্যমে চেষ্টা করেছিলেন শিকড় সন্ধানে। সেবারের বাংলাদেশ সফর সুখকর হয়নি। ফলে দীর্ঘদিন আর আসেননি দেশে। এরপর ২০১৮ সালে আসেন। এরপর এবারও। তবে কেবল বিয়েনাল নয়, বরং শেফালী ‘ট্রিবিউট টু মাদার’ সিরিজ নিয়ে কাজ করতে চান নতুনভাবে। তাই এখানে এসে পথশিশু, বস্তিতে থাকা নারী থেকে মধ্য ও উচ্চবিত্ত মা–সন্তানদের সঙ্গে কথা বলেছেন। আর এই বাতাসের ঘ্রাণ নিয়ে স্মৃতি হাতড়ানোর চেষ্টা করেছেন। তাই তো ফিরে যাওয়ার আগে খুঁজেছেন খেজুড়ের গুড় আর বাংলাদেশের একেবারে নিজস্ব কিছু, যা তাঁর স্মৃতিকে সজীব রাখবে; দেখাতে পারবে তাঁর সন্তানদের।