আমি খুব একটা কথা বলি না, এর সমাধান কী?
পাঠকের কাছ থেকে মনোজগৎ, ব্যক্তিজীবন ও সন্তান পালনের মতো সমস্যা নিয়ে ‘পাঠকের প্রশ্ন’ বিভাগে নানা রকমের প্রশ্ন এসেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশন অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম নির্বাচিত একটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এবার।
প্রশ্ন: আমি মেডিকেলের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। পড়াশোনার কারণে এই প্রথম বাড়ির বাইরে এসেছি। আমি খুব একটা কথা বলি না। কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দিই, যেটুকু মুখে না বললেই নয়, সেটুকুই শুধু বলি।
এমনও হয়েছে, কোনো প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছি শুনে শুধু মুচকি হেসে অনুভূতি প্রকাশ করেছি; অথচ যে দ্বিতীয় হয়েছে, সে লাফিয়ে উঠে একগাল হেসে চিৎকার করছে। কিন্তু এই আমি একসময় অনেক কথা বলতাম। এখন আমি এমন কেন? আমিও চিৎকার করতে চাই, আমার অনুভূতিগুলো সজোরে প্রকাশ করতে চাই, কেন পারি না?
কম কথা বলি বলে আমার সঙ্গ অনেকের ভালো লাগে না। অনেক কথা বলব ভেবে যখন কারও কাছে যাই, তারপর কেন যেন আর কথা বের হয় না।
হোস্টেলে বন্ধুর অভাব হয়েছে বলে যে চুপচাপ, তা–ও নয়। এখানে এসে খুব ভালো একজন বন্ধু পেয়েছি, তার সামনেও সব সময় আমি চুপচাপ থাকি। এ কথা বলতে না পারায় অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। আমি কথা বলতে চাই। আমার কাছের মানুষদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে অনেক মুহূর্ত তৈরি করতে চাই।
কীভাবে পারব? এ সমস্যা থেকে বের হওয়ার উপায় কী?
আয়শা সিদ্দিকা, বগুড়া।
উত্তর: মানুষের যেহেতু চিন্তা করার দক্ষতা ও অনুভব করার ক্ষমতা রয়েছে, তাই কথোপকথনের মাধ্যমে সামাজিক প্রেক্ষাপটে অন্যদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে আমরা সবাই চাই। আমরা মনের ভাব প্রকাশ করে যেমন আনন্দ পাই, ঠিক তেমনি অন্যের মনের কথা শোনার তাগিদও সবার মধ্যেই প্রবলভাবে থাকে। তা ছাড়া সংঘবদ্ধ হয়ে পারস্পরিক বন্ধন তৈরি করতে পারলে একটি নিরাপত্তাবোধও তৈরি হয় আমাদের মনে। তোমার পারিবারিক বন্ধনের জায়গাটি শৈশব থেকে কতটা নিবিড় ছিল বা এখন সেটি কী অবস্থায় রয়েছে, জানতে পারলে ভালো হতো। জন্মের পর থেকেই মা-বাবা ও কাছের মানুষদের উষ্ণ ভালোবাসা পেলে আমাদের মনের সুস্থ বিকাশ ঘটে। বড় হওয়ার পর এই ভালোবাসা সামাজিক দক্ষতা অর্জনে অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা রাখে। তুমি যে বর্তমানে নিজেকে এভাবে গুটিয়ে নিয়েছ, তাতে তোমার যে কতটা কষ্ট হচ্ছে, সহজেই তা অনুমেয়। তবে তুমি জানিয়েছ, একসময় অনেক কথা বলতে, অথচ এখন কেবল ইশারায় কথা বলো বা যেটুকু না বললেই নয়, সেটুকুই শুধু বলো।
তোমার কি মনে পড়ে, ঠিক কখন থেকে কথা বলার পরিমাণ এতটা কমিয়ে দিয়েছ? তখন কি বিশেষ কোনো ঘটনা ঘটেছিল, যা তোমার জন্য খুব দুঃখজনক বা ভীতিকর হয়েছিল? যদি কোনো ঘটনার কথা মনে পড়ে, তাহলে ভেবে দেখতে পারো, সেখানে এক বা একাধিক মানুষের উপস্থিতি ছিল কি না। ঘটনার সঙ্গে যে মানুষগুলো সংশ্লিষ্ট ছিল, তাদের সম্পর্কে তোমার মনে কী কী চিন্তা কাজ করেছিল, সেগুলো একটি নোট বইয়ে লিখে নিতে পারো। চিন্তা বা ভাবনাগুলো তোমার ভেতরে যেসব আবেগ বা অনুভূতি তৈরি করেছিল, তা–ও লিখতে পারলে ভালো হয়।
নেতিবাচক ভাবনাগুলোই আমাদের মনে নেতিবাচক আবেগ, যেমন ভয়, দুশ্চিন্তা, রাগ ও কষ্ট তৈরি করে। সে কারণেই আমাদের তাৎক্ষণিক চিন্তাগুলোকে পরে বিকল্প ভাবনা দিয়ে প্রতিস্থাপন করা খুব জরুরি। এতে আমাদের নেতিবাচক আবেগগুলোর তীব্রতা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। ফলস্বরূপ, আচরণেও কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। তোমার জীবনে হয়তো একাধিক উল্লেখযোগ্য ঘটনা রয়েছে, যা তোমাকে এতটা অন্তর্মুখী করে ফেলেছে। এসব ঘটনা তোমাকে নিজের ও অন্যের সম্পর্কে যা ভাবিয়েছে, সব লিখে ফেলবে। সেগুলো পরিবর্তন করে ইতিবাচক ভাবনাগুলো চর্চা করার চেষ্টা করবে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কেউ যদি তোমাকে বলে থাকে, তুমি ঠিকমতো কথা বলতে পারো না, আর শুনে তোমার যদি মনে হয় আমি এতে ছোট হয়ে গেছি এবং তার সম্পর্কে হয়তো মনে মনে ভাবলে যে এ কথা বলে সে কেন আমাকে ছোট করল? কীভাবে এটা সে বলতে পারল? এসব ভাবনার পরিবর্তে তুমি যদি নিজেকে বলতে পারো যে অন্তত এ কারণে নিজেকে কখনো আমি অশ্রদ্ধা করব না। অন্যের সম্পর্কে ভাবতে পারো, নিজস্ব অভিমত দেওয়ার অধিকার অন্য মানুষের আছে। সমালোচনা না করে বরং বোঝার চেষ্টা করি এর পেছনে কী কারণ রয়েছে। এতে তো আমার সামাজিক দক্ষতা আরও বাড়িয়ে তোলা সম্ভব হতে পারে।
তবে এসব কাজ সম্পূর্ণ একা করা বেশ কঠিন। সাইকোথেরাপির সহায়তায় আমরা জীবনদক্ষতাগুলো বাড়িয়ে তুলতে সক্ষম হই। তোমার মেডিকেল কলেজের হাসপাতালে ওয়ান–স্টপ ক্রাইসিস মেটাতে কোনো ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট আছেন কি না, খোঁজ নাও। যদি তাঁর খোঁজ পাও, তাহলে তাঁর পরামর্শ নিলে নিশ্চয়ই উপকৃত হবে।
ঘোষণা
পাঠকের প্রশ্ন পাঠানো যাবে ই–মেইলে, ডাকে এবং প্র অধুনার ফেসবুক পেজের ইনবক্সে। ই–মেইল ঠিকানা: [email protected] (সাবজেক্ট হিসেবে লিখুন ‘পাঠকের প্রশ্ন’) ডাক ঠিকানা: প্র অধুনা, প্রথম আলো, ১৯ কারওয়ান বাজার, ঢাকা ১২১৫। (খামের ওপর লিখুন ‘পাঠকের প্রশ্ন’) ফেসবুক পেজ: fb.com/Adhuna.PA