বাঘটা আমাদের আশপাশেই ছিল

নৌকায় দুই বন্ধুর সঙ্গে লেখক (বাঁয়ে)

দিনটি ছিল ১৬ জানুয়ারি। সুন্দরবনের অন্য রূপ দেখতে সাতক্ষীরার শ্যামনগরে এসেছি আমরা তিন বন্ধু। ঠিক করেছি, পর্যটকেরা সাধারণত যেসব পথে যান, সে পথে আমরা যাব না। মুন্সিগঞ্জ বাজারে দুপুরের খাবার খেতে খেতেই ঠিক হলো, ছোট জেলে নৌকা নিয়ে বনের ভেতরে ঘুরতে যাব। পরিচিত স্থানীয় কয়েকজনকে নিয়ে ঘাটের দিকে রওনা দিলাম। কালীনগরের এক মাঝিকে ধরে দুটি কাঁকড়া ধরার নৌকা ঠিক করা হলো। মালঞ্চ নদের বুক চিরে ছুটল আমাদের নৌকা। আস্তে আস্তে সরু খাল ধরে সুন্দরবনে ঢুকল। গাজীখালী খালে ঢোকার সময়ই পাড়ে কয়েকটা বানর চোখে পড়ল।

বিকেলের স্নিগ্ধ আবহাওয়া। নৌকায় সরু খালে ঘুরতে অন্য রকম প্রশান্তি লাগছিল। পাখির কিচিরমিচির কানে সুমধুর সুর হয়ে ধরা দিচ্ছিল। অজান্তেই গলা ছেড়ে গেয়ে উঠলাম, ‘ওরে নীল দরিয়া’। অন্যরাও গলা মেলাল। বনের আরও ভেতরের ঢুকে পড়ি। দুই পাশে সারি সারি গোলপাতা আর কেওড়াগাছ। কোনো কোনো গাছ খালের জলের সঙ্গে গভীর মমতায় মিলেমিশে আছে।

আরও পড়ুন
কাদার ওপর বাঘের পদচিহ্ন
ছবি: লেখক

সময় তখন বিকেল সাড়ে চারটা। ততক্ষণে গাজীখালী খালের অনেক ভেতরে চলে এসেছি আমরা। হঠাৎ নাকে এসে লাগে উৎকট একটা গন্ধ। গন্ধটা চেনা না। তবে এটা যে কোনো প্রাণীর গায়ের গন্ধ, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। অন্য নৌকায় থাকা বন্ধু তুহিন ও শাকিলকে গন্ধের কথা বলতে বলতেই পাশে খচখচ আওয়াজ শুনতে পাই। হাঁক ছেড়ে পেছনের নৌকায় যারা আছে, তাদের সতর্ক করি। ঘন ঝোপের আড়াল থেকে একটা ছায়ামূর্তি ধীরে এগিয়ে আসে। উৎকট গন্ধটা আরও প্রকট হয়ে নাকে লাগে। ভয় জেঁকে বসে—আজ আর রক্ষা নেই, এই বুঝি বাঘের খাবারে পরিণত হতে চলেছি।

ততক্ষণে নৌকাটা দ্রুত ঘুরিয়ে ফেলেছে মাঝি। কিন্তু অন্য কূলের দিকে যেতেও ভয় লাগছে। বাঘেরা অনেক সময় দল বেঁধে চলাফেরা করে। যদি ওপাড়েও থাকে! ভয়টা ক্রমেই আতঙ্কে পরিণত হয়। আরও কয়েকবার খচখচ শুনতে পাই। মনে হতে থাকে, শব্দটা আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। হয়তো সুযোগ খুঁজছে।

আরও পড়ুন

আমাদের মধ্যে কেউ কেউ বুনো বিড়াল, হরিণ ইত্যাদি বলে ভয় কাটানোর চেষ্টা করে। আরেকজন বলে ওঠে, বাঘ হলেও ভয়ের কিছু নেই। বাঘ অতর্কিত আক্রমণ করে না। সম্ভাব্য শিকারকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে সর্বোচ্চ সফলতার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েই তারা আক্রমণ করে। কিন্তু উৎকট গন্ধটার ব্যাপারে কেউ কিছু বলতে পারল না!

যারা অভয় দিয়ে কথাগুলো বলছিল, তাদেরই দুজন প্রাণীটিকে আবছা দেখে ফেলে। বাঘ! রয়েল বেঙ্গলকে দেখে তাদের মুখে কুলুপ এঁটে যায়। নিজেরাই এখন ভয়ে জড়সড়। প্রাণীটা যে বাঘ, এটা নিশ্চিত হলে আমাদের এতক্ষণের জল্পনা–কল্পনারও অবসান হয়।

ছবি তোলা বা ভিডিও ধারণের কথা আমাদের মাথাতেই আসেনি। সত্যি বলতে কি, অকস্মাৎ ভয় পেয়ে ক্যামেরা হাতে নেওয়ার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম।

অনেকটা সময় দূরে অপেক্ষার পর সব যখন সুনসান হয়ে এল, মনে হলো অন্তত পায়ের ছাপটা খুঁজে দেখা যাক, সত্যিই বাঘ কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যাবে। যেদিক থেকে শব্দ হচ্ছিল, সাহস করে সেদিকেই এগিয়ে যাই। একটু এগোতেই পেয়ে গেলাম শক্ত কাদার ওপর বাঘের পদচিহ্ন! দ্রুত ছবি তুলেই দে ছুট!

নৌকা বেয়ে খাল থেকে বড় নদীতে এসে পড়ি। নদীতে আসতেই পেছন থেকে ভেসে আসে বাঘের গর্জন। গন্ধ টের পেয়ে যে ভয় পেয়েছিলাম, নিরাপদে থেকে শোনা গর্জনে আর সেই ভয় পেলাম না। বরং একটা রোমাঞ্চ ভর করল, ১৫ মিনিটের শ্বাসরুদ্ধকর অভিজ্ঞতার রোমাঞ্চ।