গার্মেন্টসকর্মী ভাইয়ের শ্রমে বোন পড়ছেন মেডিকেলে

মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে ৯ ফেব্রুয়ারি। এ বছর যাঁরা পরীক্ষা দেবেন, জেসমিন আক্তারের গল্প থেকে তাঁরা অনুপ্রাণিত হতেই পারেন।

জেসমিন আক্তার
ছবি: সংগৃহীত

জন্মের পর থেকেই দেখছেন বাবা অসুস্থ। দুর্ঘটনায় আঘাত পেয়ে আর কাজে ফিরতে পারেননি, নানা জটিল রোগে ভুগতেন পরিবারের আরও কয়েক সদস্য। প্রত্যন্ত অঞ্চলে বড় হওয়া জেসমিন আক্তারকে তাই চিকিৎসক হওয়ার গুরুত্ব আলাদা করে বোঝাতে হয়নি। ছোটবেলাতেই মনে মনে সংকল্প করেছিলেন—চিকিৎসক হবেন।

জেসমিন এখন এম আব্দুর রহিম (সাবেক দিনাজপুর) মেডিকেল কলেজের এমবিবিএস প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। চার ভাইবোনের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে ছোট। গার্মেন্টসে চাকরি করা বড় ভাইয়ের উপার্জনেই চলে তাঁর পড়ালেখাসহ এত বড় পরিবারের নিত্যদিনের খরচ। কীভাবে এতটা পথ পাড়ি দিলেন, সে গল্পই শোনাচ্ছিলেন তিনি।

আরও পড়ুন

বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার কুতুবপুর ইউনিয়নের মেয়ে জেসমিন আক্তার। যমুনা নদীর ভাঙনে ঘরবাড়ি হারিয়ে একসময় মামার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন জেসমিনরা। সেই সময়টা নিশ্চয়ই খুব কঠিন ছিল? জেসমিন বলেন, ‘শুধু ওই সময় নয়, আমার জীবনের প্রতিটি দিনই আসলে কঠিন। বাবা সেভাবে কাজ করতে পারতেন না, টেনেটুনে চলত সংসার। পড়ালেখার খরচ জোগানোই ছিল প্রায় অসম্ভব। এখনো মনে হয়, স্কুলে পড়তে পেরেছি, এটাই আমার জীবনের বড় অর্জন। পঞ্চম শ্রেণিতে আমাদের ইউনিয়নে প্রথম হলাম। এই ভালো ফলই হয়তো সাহস জুগিয়েছে। শুভাকাঙ্ক্ষীরাও আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছেন।’

অষ্টম শ্রেণির জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও মাধ্যমিকেও উপজেলা পর্যায়ে প্রথম হন জেসমিন। পড়ালেখার পাশাপাশি বিতর্ক, কুইজ, রচনা প্রতিযোগিতাতেও স্কুলে ও উপজেলা পর্যায়ে নিয়মিত পুরস্কার জিতেছেন এই শিক্ষার্থী। এযাত্রায় শিক্ষকেরা ছিলেন তাঁর বড় প্রেরণা। জেসমিন বলেন, ‘ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে পড়ালেখার খরচ একটু একটু বাড়ছিল। পড়ালেখা চালিয়ে নেওয়াই কঠিন ছিল। তবে শিক্ষকেরা সব সময় উৎসাহ দিয়েছেন। বিশেষ করে কুতুবপুর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আসলাম উদ্দিন স্যার। তিনি প্রায়ই বলতেন, “তুমি চেষ্টা করে যাও। আমরা তো আছিই।” তিনি আমাকে বিনা বেতনে স্কুলে পড়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। যাওয়ার-আসার জন্যও কিছু টাকা দিতেন।’

আরও পড়ুন

মেধার পরিচয় দিয়েছেন বলেই বিনা পয়সায় জেসমিনকে প্রাইভেট পড়াতে রাজি হয়েছিলেন বেশ কয়েকজন শিক্ষক। মাধ্যমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক, পুরো যাত্রাতেই শিক্ষকসহ অনেকের সহযোগিতা পেয়েছেন জেসমিন।

তবে বারবারই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে আর্থিক টানাপোড়েন। ভেঙে পড়েছেন, আবার উঠে দাঁড়িয়েছেন। এত চড়াই-উতরাই পেরিয়ে যেদিন মেডিকেল কলেজে ভর্তির ফলাফল এল, কেমন ছিল অনুভূতি? মুঠোফোনের ওপাশে জেসমিন আক্তার একটু সময় নিলেন। মনে হলো, তাঁর কণ্ঠ ভারী হয়ে এসেছে। বললেন, ‘আমার প্রস্তুতি ভালো ছিল। কিন্তু স্বপ্ন পূরণ হবে, এটা ভাবার সাহস পাইনি। আমার ভাই সব সময় বলত, কোনো একটা মেডিকেলে আমার সুযোগ হবেই। এরপর পরীক্ষা দিলাম। ভালোই হয়েছিল। কিন্তু ফলাফল দেখার সাহস আমার ছিল না। ওই দিন আমি আর মা বাড়ির বাইরে গিয়ে হাঁটাহাঁটি করছিলাম। এদিকে ভাইয়া ফোন দিয়েই যাচ্ছে। প্রায় ১০ মিনিট পর বাড়িতে ফিরে দেখি ফোন বাজছে। ফোন ধরেই জানতে পারি, আমি মেডিকেল কলেজে সুযোগ পেয়েছি। সেই মুহূর্তের অনুভূতি বলে বোঝাতে পারব না। যে প্রত্যন্ত এলাকা থেকে আমি উঠে এসেছি, সেখানকার মানুষের কষ্ট আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে। তাঁদের জন্যই চিকিৎসক হয়ে কিছু করতে চাই।’

কুতুবপুর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আসলাম উদ্দিন বলেন, ‘ওর বড় বোনও আমাদের স্কুলেই পড়ত। আমরা যখন ওর কথা জানতে পারি, নিজেরা স্বপ্রণোদিত হয়ে ওদের বাড়িতে কথা বলে ওকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিই৷ এরপর যতটুকু সম্ভব চেষ্টা করেছি, যেন মেয়েটা ঠিকভাবে পড়ালেখার সুযোগ পায়। শুধু অর্থকষ্টের জন্য যেন একটা মেধাবী মুখ হারিয়ে না যায়। বাকিটা ওর নিজের প্রচেষ্টা ছিল। শিক্ষার্থীদের এসব অর্জনের জন্যই তো আমরা মুখিয়ে থাকি৷ এখন জেসমিন যখন বাড়িতে আসে, আমাদের সঙ্গে দেখা করে। আমরাও স্কুলে ডাকি। সে প্রতিটি ক্লাসরুম ঘুরে ঘুরে আমাদের শিক্ষার্থীদের চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখায়, তাঁর পাড়ি দেওয়া পথের গল্প শোনায়। আমরাও তো এতটুকুই চাই। আশা করি, জীবনের কঠিন দিনগুলো মনে রেখে আরও অনেকের জন্য সে একজন ভালো মানুষ ও ভালো চিকিৎসক হিসেবে কাজ করে যাবে।’