৫০ বছর ধরে শোলার শিল্প গড়ে চলা গোপেন্দ্রনাথ কাজটাকে জীবিকা হিসেবে নিতে পারেননি

৫০ বছর ধরে শোলার শিল্প গড়ে চলেছেন ঝিনাইদহের গোপেন্দ্রনাথ চক্রবর্ত্তী। এই কাজ করে শ্রেষ্ঠ কারুশিল্পীর পুরস্কারসহ বেশ কিছু সম্মাননাও পেয়েছেন। তাঁর জীবনের গল্প শুনে লিখলেন রাফিয়া আলম

শোলাশিল্পী গোপেন্দ্রনাথ চক্রবর্ত্তী
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

ছোটবেলা থেকেই হাতের কাজের প্রতি আমার আগ্রহ। স্কুলে পড়ার সময় কখনো কাদা, কখনো কাগজ দিয়ে ফুল, পাখি, নৌকা গড়ার চেষ্টা করতাম। কিন্তু অভাবের সংসারে অষ্টম শ্রেণি ডিঙানোর পর আর পড়া হয়নি। এরপর কুষ্টিয়া সুগার মিলে পিয়নের চাকরি নিই। সেই চাকরি অবশ্য বেশি দিন করতে পারিনি। চাকরি হারানোর পর এখানে-সেখানে নানা কিছু করেছি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পরিবারের সঙ্গে ভারতে চলে যাই। দেশ স্বাধীন হলে ফিরে দেখি, আমাদের বাড়িটি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এরপর কুষ্টিয়ার আড়পাড়া ছেড়ে আমরা চলে যাই নানাবাড়ি ঝিনাইদহে। সেখানেই পরে বাড়ি করি। 

বাবাকে হারিয়েছি সেই না বোঝার বয়সে। ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য এরপর নানা কিছু করার চেষ্টা করেছি। ১৯৭২ সালে চাকরির আশায় ঢাকায় আসি। পরিচিত একজনের সহায়তায় সেন্ট্রাল রোডের আইডিয়াল কলেজে কাজ পাই। আমার কাজ উদ্ভিদবিদ্যার ব্যবহারিক ক্লাসে শিক্ষার্থীদের সহায়তা করা। কলেজের ল্যাবরেটরিতে নানা জিনিস থাকে। এর মধ্যে শখের বশেই একদিন মাইক্রোস্কোপের বাক্সের সাদা কর্ক শিট হাতে নিয়েছিলাম। শুরুতে ঠিকভাবে কাটতে পারতাম না। কর্ক শিট কাটার প্রক্রিয়াটি আয়ত্ত হয়ে গেলে সেটা দিয়ে ফুল-পাখি বানানো শুরু করি। কাজটা করে বেশ মজা পেতাম। মনের মতো আকৃতি দিয়ে বানানো জিনিসগুলো রেখে দিতাম ল্যাবরেটরির আলমারিতেই।

বাংলাদেশ ন্যাশনাল হারবেরিয়ামে কর্মরত ছিলেন অধ্যাপক মাজহারুল ইসলাম। তিনি আইডিয়াল কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে এসে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে ক্লাস নিতেন। আমার গড়া শিল্পকর্ম তিনিই প্রথম টাকা দিয়ে কেনেন। এই কাজে উৎসাহও দেন।

হঠাৎ সেই দুপুরে

১৯৭৪ সাল। ছুটির দিনে কলেজেই ছিলাম। হঠাৎ এক ছাত্রী এসে আবদার করল উদ্ভিদবিদ্যার ল্যাবরেটরি খুলে দেওয়ার জন্য। কিন্তু কলেজের কার্যক্রম বন্ধ থাকলে ল্যাবরেটরি খোলার নিয়ম নেই। এদিকে সেই ছাত্রীও নাছোড়। আমি পড়লাম উভয়সংকটে। অগত্যা তার জোরাজুরিতে ল্যাবরেটরির তালা খুলে দিলাম। ছাত্রীটি ঢুকেই আমার শিল্পকর্ম একটা কার্টনে বোঝাই করল। যাওয়ার সময় শুধু বলল, সে এসব বাংলা একাডেমির বৈশাখী মেলায় নিয়ে যাচ্ছে। পরে জেনেছি এক ঘণ্টার মধ্যেই আমার বানানো এক কার্টন জিনিস বিক্রি হয়ে যায়! বিসিকের (বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন) কর্মকর্তাদের নজরেও আসে আমার কাজ। তাঁরা যোগাযোগ করে বলেন, সামনের বছর যেন দেশি শোলা দিয়ে শিল্পকর্ম বানিয়ে মেলায় আনি।

সেই থেকে দেশি শোলা দিয়েই কাজ করছি।

৫০ বছর ধরে শোলার শিল্প গড়ে চলেছেন গোপেন্দ্রনাথ চক্রবর্ত্তী
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

নতুন কিছু গড়ার আনন্দ

বিয়ে করেছি ১৯৭৫ সালে। শ্বশুরবাড়ি ঝিনাইদহের খড়িখালী গ্রামে। বিয়ের বছর দুয়েক পর এই গ্রামেই নিজের বাড়ি করি। কর্মসূত্রে ঢাকায় থাকলেও আমার স্ত্রী বাড়িতেই থাকতেন।

একসময় কলেজের চাকরি ছেড়ে নিরাপত্তা প্রহরী হিসেবে বাংলাদেশ ন্যাশনাল হারবেরিয়ামে যোগ দিই। ফার্মগেট এলাকা থেকে অফিসটি (বর্তমানে মিরপুরে) স্থানান্তরিত হলে সেই জায়গায় শুরু হয় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের কার্যক্রম। আমি থেকে যাই কৃষি গবেষণা কাউন্সিলেই। রাতে নিরাপত্তা প্রহরীর দায়িত্ব পালন করলে জেগে থাকতে হয়। সেই সময়টা বসে বসে শোলার কাজের চর্চা করতাম। আমার কাজ সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানতেন। তাঁরাও উৎসাহ দিতেন। তবে সবার মধ্যে অধ্যাপক মাজহারুল ইসলামের কাছ থেকে পাওয়া ভালোবাসার কথা বারবারই মনে পড়ে।

সাদামাটা শোলা থেকে বহু কিছু গড়েছি। ফুল, পাখি কিংবা নকশি পাখা তো বটেই, গড়েছি ময়ূরপঙ্খী নৌকাও। অনুভব করে যেকোনো আকৃতি গড়তে পারি। নতুন কিছু গড়ার আনন্দ আছে, সেই বিষয়ই চিরদিন আমাকে টানে।

 বাস্তবতা বড় নির্মম

২০১১ সালে চাকরি থেকে অবসর নিয়েছি। তার পর থেকে ঝিনাইদহে গ্রামের বাড়িতেই আছি। সারা দিন রাজহাঁস, মুরগি আর গরুর দেখাশোনা, শাকসবজির খেতের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। সংসারের নানা কাজ শেষ করে সন্ধ্যা সাতটার দিকে শোলার কাজ নিয়ে বসি। রাত দুইটা–তিনটা পর্যন্তও কাজ করি। সেসব জিনিস নিয়ে বিভিন্ন মেলায় যাই। এই জয়নুল মেলাতেও প্রতিবছর আসি।

এই ৭০ বছরের জীবনে অর্জন কম নয়। নানা সম্মাননাও পেয়েছি। বিসিকের শ্রেষ্ঠ কারুশিল্পীর পুরস্কারসহ প্রায় কুড়িটির মতো পুরস্কার পেয়েছি। ২০২৩ সালে আন্তর্জাতিক পুরস্কার (ওয়ার্ল্ড ক্র্যাফটস কাউন্সিল এশিয়া প্যাসিফিক রিজিয়নের ‘ক্রাফট মাস্টার অ্যাওয়ার্ড’) পেয়েছি। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় জাপানে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে নিজের হাতের কাজ প্রদর্শন করেছি। বিদেশিদের কাছে এ দেশের হস্তশিল্পের কদর কতটা, তা উপলব্ধি করেছি। সেই কারণেই বিমানবন্দরের কাছে আমার মতো শিল্পীদের জন্য একটি বিক্রয়কেন্দ্র করে দেওয়ার কথা বলেছিলাম। তবে সেই চাওয়া পূরণ হয়নি।

আমাদের তিন সন্তান। বড় মেয়ে গৃহিণী, ছোট মেয়ে প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক। ছেলেটার শোলাশিল্পে আগ্রহ ছিল, কিন্তু জীবিকা হিসেবে শোলাশিল্পের মূল্যায়ন নেই বলে কাজটা সে ছেড়ে দিয়েছে। এখন বাংলাদেশ কৃষি
গবেষণা কাউন্সিলে কেরানির চাকরি করে। আমিও আর চাপাচাপি করিনি। আসলে বাস্তবতা বড় নির্মম!

পৃষ্ঠপোষকতা না পাওয়ায় কাজটাকে পুরোপুরিভাবে জীবিকা হিসেবে নেওয়ার সুযোগ কম। আমি নিজেই শখের শিল্পী হিসেবেই কাজ করে যাচ্ছি।