স্কুলের সামনের ‘মাম্মি গ্রুপ’
এখন নাকি শিশুদের চেয়ে পড়াশোনা বেশি করেন তাদের মায়েরা! মানে কোন দিন ক্লাসে কী পড়াল, কবে পরীক্ষা, কবে ক্লাস টেস্ট, কী পড়তে হবে, কতটুকু পড়তে হবে—এসব নিয়ে শিক্ষার্থীদের চেয়ে তাদের মায়েদেরই দুশ্চিন্তা বেশি। আবার কার সন্তান কত নম্বর বেশি পেল, কী লিখে বেশি পেল; তা নিয়েও নাকি তাঁদের দুশ্চিন্তার অন্ত নেই।
শুধু কি তা–ই! কে কোথা থেকে ঈদের পোশাক কিনলেন, কারা নতুন ফ্ল্যাটে উঠলেন কিংবা কোন অভিভাবক নতুন বছরে গাড়ি বদলালেন; তা–ও নাকি বিরাট গবেষণার বিষয়।
ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করানোর আগে মায়েদের গ্রুপ নিয়ে এমন ধারণাই ছিল। আশপাশের লোকজনও এমন ধারণা দিতেন। এদিকে ছেলেকে স্কুলে দিয়ে পাক্কা দুই ঘণ্টা বসে থাকতে হবে আমারও (ছেলেকে আনা-নেওয়া ও আমার অফিস টাইম মিলিয়ে)। তাই যাওয়ার আগেই দুশ্চিন্তা হতো, এ মায়েদের সঙ্গে বসে থাকলে আমি নির্ঘাত পাগল হয়ে যাব।
এসব ভাবতে ভাবতেই আমারও বসে থাকার দিন এসে গেল, আর আমিও হয়ে গেলাম তথাকথিত ভাবি বা ‘মাম্মি গ্রুপ’–এর সদস্য।
কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম, আমার বন্ধুরা (ছেলের বন্ধুর মায়েরা তো বন্ধুই, নাকি!) গল্পে শোনা চরিত্রগুলোর মতো নন। আমরা দেশ-জাতি-রাজনীতি নিয়ে কথা বলি, সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা ভাগ করে নিই, একে অন্যের ধর্ম নিয়ে, ধর্মের আচার নিয়ে কথা বলি, অঞ্চলভিত্তিক রান্নার পদ্ধতিও শিখি। দুই বছর হেঁটে হেঁটে আমরা বোধ হয় লালমাটিয়ার (ছেলের স্কুল সেখানে) সব চায়ের টং ‘এক্সপ্লোর’ করে ফেলেছি। তবে হ্যাঁ, এটাও ঠিক, সবার অভিজ্ঞতা সমান হয় না। শিশুদের মধ্যের প্রতিযোগিতা মায়েদের মধ্যেও এসে পড়ে; সে গল্পও তো আছে। এই প্রতিবেদন লেখার জন্য কথা বলেছিলাম ঢাকার বেশ কয়েকটি স্কুলের অভিভাবকদের সঙ্গে, বিশেষ করে মায়েদের সঙ্গে। ভাবি বা মাম্মি গ্রুপগুলো আসলে কী নিয়ে আলোচনা করেন, কীভাবে সময় কাটান স্কুলের নিচে বসে; সেসবই জানতে চেয়েছিলাম। বেশ মিশ্র অভিজ্ঞতা হলো।
নামকরা একটি স্কুলের এক অভিভাবক মা জানালেন, কোনো দিন যদি তাঁর সন্তান স্কুলে যেতে না পারে, পরদিন তিনি অন্যদের কাছে জানতে চান, কী পড়ানো হয়েছিল। বেশির ভাগই এড়িয়ে যেতে চান, মানে খাতা বা বাড়ির কাজ দেখাতে চান না। ফলে বাধ্য হয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সেটা তাঁকে জোগাড় করতে হয়। অথচ এই অভিভাবকদের সঙ্গেই রোজ ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে গল্প করেন তিনি। এই মা বলেন, ‘ভাবখানা এমন, তাঁদের সন্তানের খাতা দেখলেই আমার মেয়ে ফার্স্ট হয়ে যাবে!’
আরেক স্কুলের গেটের বাইরে তিন বছর ধরে অপেক্ষা করেন এমন একজন মা বললেন, তাঁদের দারুণ একটা গ্রুপ হয়েছে। তাঁরা প্রায়ই সন্তানদের স্কুলে দিয়ে বাইরে নাশতা করতে যান। একে অন্যের বাসায় যাওয়া–আসাও হয়। মাঝেমধ্যেই ওয়ান ডিশ পার্টির আয়োজন করেন। কারও শিশু অসুস্থ হয়ে স্কুলে আসতে না পারলে, অন্যরা সেদিনের শ্রেণির কাজের ছবি তুলে সেই মাকে পাঠিয়ে দেন।
বসে থাকার এই সময়টুকু অনেক মা দারুণভাবে কাজে লাগান। কথা বলেছিলাম অভিভাবক শ্রাবণী রায়ের সঙ্গে। যিনি বেশ ভালো হাতের কাজ জানেন। স্কুলের ভাবিরা তাঁর এই গুণের কথা জানতেই বেশ কিছু কাজের আবদার এল। সেই আবদারের ফলাফল দেখে একজন রীতিমতো পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কাজ দিতে চাইলেন। শ্রাবণী একটু ভেবে কাজটি নিলেন। সেই শুরু। এখন সন্তানের সহপাঠীদের মায়েদের কাছ থেকে অনেক দূরপর্যন্ত ছড়িয়েছে তাঁর সুনাম। সংসারে বাড়তি কিছু আয় করতে পারছেন, এই তৃপ্তিই তাঁকে আরও ভালো কাজ করতে উৎসাহ দিচ্ছে। কাজের পরিধি বাড়ায় দুজন সহকারীও যুক্ত করেছেন। যাঁদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করেছেন নিজেই।
আরেক মা ফারিয়া ফারহানা জানালেন, বন্যার সময় এই স্কুলের সামনে বসে থাকা মায়েদের কাছ থেকে চাঁদা তুলেই প্রায় এক লাখ টাকা তাঁরা পাঠিয়েছিলেন দুর্গত এলাকায়। মায়েদের মধ্যেই কেউ তা বিতরণের ব্যবস্থা করেছিলেন, এমনকি কোথায়, কীভাবে বিতরণ করা হলো, তার বিস্তারিত তথ্যও তুলে ধরেছিলেন সবার সামনে।
যানজটের এই শহরে বহু অভিভাবকই সন্তানকে স্কুলে দিয়ে বসে থাকেন। সব স্কুলে অভিভাবকদের বসার জায়গা থাকে না। তাই তাঁরা কখনো বেছে নেন আশপাশের পার্ক কিংবা কোনো খোলা জায়গা। কখনো কখনো বসতে হয় ফুটপাতে। সঠিক সময়ে স্কুলে ঢোকার তাড়া থেকে শুরু করে বহুদূরের পথ পাড়ি দিয়ে আবার বাড়ি ফিরে এই মায়েদের বেশির ভাগকেই মন দিতে হয় ঘরকন্নায়, কারও থাকে অফিসের তাড়া। তাই অনেকের কাছেই স্কুলের বাইরে অপেক্ষার এই সময়টুকুই ‘মি টাইম’। যখন তিনি কেবল নিজেকেই সময় দিতে পারেন। সামিয়া ফারুক তেমনই একজন মা। তিনি বলছিলেন, ‘ছেলেকে স্কুলে দিয়ে কখনো কখনো কফি খেতে যাই নিজের প্রিয় ক্যাফেতে, সঙ্গে হয়তো বই থাকে। কিংবা রাস্তার পাশে টংদোকানে অন্য মায়েদের সঙ্গে চায়ে ডুবিয়ে নোনতা বিস্কুট খেতে খেতে ফিরে যাই নিজের ক্যাম্পাস–জীবনে।’
একসময় সাংবাদিকতায় যুক্ত থাকা তোহফা চাকরি ছেড়েছেন সন্তান লালন–পালনের সুবিধার্থে। এখনো দুই সন্তান সামলে কাজে ফিরতে পারেননি। তোহফা বলেন, ‘সারা দিনে নিজের জন্য সময় পাই ওই তিন ঘণ্টা। যখন ওদের স্কুলে ঢুকিয়ে দিয়ে আসি। এরপর আমরা গল্প করতে বসি। কে কীভাবে শুক্তো রাঁধেন, কিংবা কার ছেলের ট্যানট্রমকে কীভাবে সামাল দেন, সেই গল্প শুনি। নিজেদের ছোটবেলার কথা বলি, কিছু দুঃখও ভাগ করে নিই। এমন অনেক কথা, যেগুলো হয়তো বন্ধুদেরও বলা যায় না, সেগুলোও অবলীলায় বলি এই নতুন বন্ধুদের। হয়তো নিজের সঙ্গে তাঁদের মেলাতে পারি সহজেই, সে জন্যই।’
প্রিয় পাঠক, তাই এরপর কোনো স্কুলের সামনে মায়েদের জটলা দেখলেই শুধু এটা ভাবা ঠিক হবে না যে সেখানে গসিপ হচ্ছে। জানেন তো, গসিপ আর গল্প কিন্তু এক নয়!