‘ভুল করে’ উদ্ভাবিত হয় এসি
প্রতিবছর তাপমাত্রা ভেঙে ফেলছে পুরোনো সব রেকর্ড। বছরের বেশি সময়জুড়েই তীব্র গরমে অতিষ্ট জনজীবন। অল্প সময়েই চেনা–পরিচিত এক শব্দ হয়ে উঠেছে ‘হিট স্ট্রোক’। এয়ার কন্ডিশন বা এসিকে এখন আর তাই ‘বিলাস পণ্য’ বলতে নারাজ নগরবাসী। শিশুদের নিয়ে রাস্তায় বের হলে অনেক অভিভাবককে শুনতে হয়, ‘বাইরে এসি নেই কেন?’ এই বাস্তবতায় আজ ৩ জুলাই আন্তর্জাতিকভাবে পালিত হচ্ছে ‘এয়ার কন্ডিশন অ্যাপ্রিসিয়েশন ডে’। এই দিনে জেনে নেওয়া যাক এসি উদ্ভাবনের গল্পগুলো।
‘ভুল করে’ উদ্ভাবিত হলো এসি
আজকের দিনে এসির সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যবহার ঘরে আর অফিসে হলেও মূলত ছাপাখানার জন্য আবিষ্কৃত হয়েছিল এই যন্ত্র। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের একটি ছাপাখানায় বাতাসের আর্দ্রতার কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছিল। অতিরিক্ত আর্দ্রতার কারণে ছাপাখানায় মুদ্রণের সময় কাগজের আকার-আকৃতি ঠিক থাকছিল না। আবার কালিও ছড়িয়ে পড়ত। এ সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব পায় বাফেলো ফোর্জ কোম্পানি। কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করে সেই কোম্পানিতে তখন শিক্ষানবিশ হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন উইলিস হ্যাভিল্যান্ড ক্যারিয়ার। বাফেলো ফোর্জের প্রকৌশলীরা যখন হন্যে হয়ে সমাধান খুঁজছেন, তখন একটা সুযোগ চান ২৫ বছর বয়সী এই তরুণ প্রকৌশলী। ১৯০২ সালে সমস্যার কার্যকর একটা সমাধানও বের করে দেন উইলিস।
উইলিস একটি কয়েলকে কম্প্রেসড অ্যামোনিয়া দিয়ে ঠান্ডা করেন। এর ভেতর দিয়ে কারখানার বাতাস সঞ্চালিত হলে ঘরের আর্দ্রতা কমে আসে। সেই সঙ্গে ঘর ঠান্ডাও হয়। কেননা, ঘরের আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করতে আর্দ্রতা অপসারণ করার সময় বাতাসকেও শীতল করত এই ব্যবস্থা। আর এটি কেবল উইলিসেরই নয়, হয়ে থাকল বাফেলো ফোর্জ কোম্পানির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন। এমনকি বিশ্বের ইতিহাসেও একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন।
পরে আটার কল ও ব্লেড তৈরির কারখানায়ও ব্যবহৃত হয় এই প্রযুক্তি। এসব কারখানার ভেতরের তাপমাত্রা কমে আসায় ঠান্ডা পরিবেশে কর্মীদের কাজের আগ্রহ ও সক্ষমতা দুটোই বাড়ে। ফলে সামগ্রিকভাবে কারখানার উৎপাদনশীলতাও বাড়ে।
হলিউডেও বিপ্লব আনে এসি
বিংশ শতকের একেবারে শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেন থিয়েটারটি ঠান্ডা রাখতে ব্যবহার করা হতো বরফ। এই বরফের চাঁইয়ের ওপর জোরে চালিয়ে দেওয়া হতো ফ্যান। তারপর সেই ঠান্ডা বাতাস ডাক্টের মাধ্যমে থিয়েটারের হলরুমে প্রবেশ করানো হতো। এ পদ্ধতিতে ঘর ঠান্ডা হতো ঠিকই, তবে পরিবেশ হয়ে পড়ত স্যাঁতসেঁতে। আর বরফ গলে যাওয়ার পর ভ্যাপসা, কটু গন্ধ ছড়িয়ে পড়ত চারপাশে। তা ছাড়া, প্রতিদিন এই থিয়েটারে ব্যবহার করা হতো চার টন বরফ। সেটিও বেশ ঝক্কির ব্যাপার।
সে সময় মার্কিন প্রকৌশলী উইলিস হ্যাভিল্যান্ড ক্যারিয়ার ভাবলেন, তাঁর প্রযুক্তি যদি কারখানার তাপমাত্রা কমাতে পারে, তাহলে থিয়েটারেও সেটি প্রয়োগ করা সম্ভব। ফলে সফলভাবে ব্যবহৃত হলো থিয়েটারেও। এর ফলে হু হু করে বাড়তে থাকে থিয়েটারের সংখ্যা। হলিউডও মন দেয় আরও বেশি চলচ্চিত্র তৈরিতে, আর তা নতুন নতুন থিয়েটারে মুক্তি দিতে। ফলে ১৯২০–এর দশকে হলিউডের সিনেমায় এক বিপ্লব ঘটে যায়। হলিউডের স্বর্ণযুগের তখনই শুরু। বলা হয়ে থাকে, সে সময় থিয়েটারে যদি এসি না আসত, তাহলে হলিউডের সোনালি সময় হয়তো আরও দেরিতে শুরু হতো।
উইলিস হ্যাভিল্যান্ডকেও আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বাফেলো ফোর্জ কোম্পানির চাকরি ছেড়ে নিজেই একটা প্রতিষ্ঠান দেওয়ার উদ্যোগ শুরু করেন। ১৯১৫ সালে আরও ছয় প্রকৌশলীর সঙ্গে মিলে প্রতিষ্ঠা করেন বিশ্বের বৃহত্তম এসি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ক্যারিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন। মূলত, উইলিস হ্যাভিল্যান্ড ক্যারিয়ারই এসি উদ্ভাবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করেন। এরপর অনেকেই এটির আধুনিকীকরণে নানাভাবে অবদান রেখেছেন।
কীভাবে এল আধুনিক এসি?
উইলিস হ্যাভিল্যান্ডের এসির মূলত দুটো সমস্যা ছিল। এক. এসিতে ব্যবহার করা হতো অ্যামোনিয়া, প্রপেন ও মিথাইল ক্লোরাইডের মতো বিষাক্ত গ্যাস। ফলে এটি অতটা নিরাপদ ছিল না। দুই. এই এসি আকারে ছিল বিশাল। এতটাই বিশাল যে রাখার জন্য আলাদা ঘরের প্রয়োজন হতো। প্রথম সমস্যার সমাধান নিয়ে আসেন মার্কিন প্রকৌশলী ও রসায়নবিদ টমাস মিগলি জুনিয়র। ১৯২৮ সালে ফ্রেয়ন উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে শিল্প ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রসহ আবাসিক ক্ষেত্রেও এসির ব্যবহার অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। ১৯৩০ সালে হোয়াইট হাউসে প্রথম এসি ব্যবহার করা হয়। এই দশকে এসির আকার ছোট করা নিয়ে চলছিল নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। ১৯৪০ সালে ফ্রেডরিক জোনস থার্মো কিং উদ্ভাবনের মাধ্যমে বহনযোগ্য এসির একটা নকশা বের করেন। সেটি সাধারণত ট্রাকে ও গাড়িতে ব্যবহার করা হতো, যা খাবার সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ১৯৪৫ সালে রবার্ট শেরম্যান বহনযোগ্য এমন এক এসি উদ্ভাবন করেন, যা জানালার পাশে রেখে ব্যবহার করা যেত। এই এসি গরমের দিনে ঘর ঠান্ডা আর শীতের দিনে গরম রাখত।
১৯৪৬ সাল থেকেই এসির চাহিদা বাড়ে। সে বছর উৎপাদিত হয় ৩০ হাজার এসি। ১৯৫৩ সালে তা ১০ লাখ ছাড়িয়ে যায়। এর পর থেকে প্রতিবছর উৎপাদন কেবল বাড়ছেই। ১৯৭৯ সালে ক্যারিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং কিনে নেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইউনাইটেড টেকনোলজিস’। তবে উইলিস হ্যাভিল্যান্ড ক্যারিয়ারের সম্মানে আর এই নামের ব্র্যান্ড ভ্যালুর কথা চিন্তা করে নাম আর বদলানো হয়নি। এখন অন্তত ১৭০টি দেশে এসি বাজারজাত করে এই প্রতিষ্ঠান।
প্রতিনিয়ত এসিতে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন প্রযুক্তি। এসিকে কীভাবে আরও পরিবেশবান্ধব করা যায়, কীভাবে এর সুবিধা বাড়ানো যায়, কমানো যায় বিদ্যুৎ খরচ, এসব নিয়ে চলছে নিত্যনতুন গবেষণা। চলে এসেছে ইনভার্টার, শত ভাগ কপার কনডেনসার স্প্লিট এসি। কুলিং, হিটিং মুড ছাড়া চলে এসেছে টাইমার, টার্বো–কুলিং, স্লিপিং মোডসহ নানা ফিচার।
দেশেও তৈরি হচ্ছে এসি
বাংলাদেশেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তৈরি করছে মানসম্মত আধুনিক এসি। দেশের বিভিন্ন এসি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বলছেন, স্থানীয় চাহিদার প্রায় ৯০ শতাংশ এসি দেশেই উৎপাদিত হচ্ছে। এর মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ সম্পূর্ণ দেশে উৎপাদিত হয়। বিদেশি যন্ত্রাংশ (মূলত কমপ্রেসার) এনে দেশে সংযোজন করে উৎপাদিত হয় প্রায় ৩০ শতাংশের বেশি এসি। আর অবশিষ্ট ১০ ভাগ আমদানি করা হয়। দেশের অনেক প্রতিষ্ঠান বিদেশে এসি রপ্তানির উদ্যোগও নিয়েছে।
আধুনিক এসি উদ্ভাবন ও বাজারজাতকরণের সঙ্গে জড়িত সবাইকে আজকের এই বিশেষ দিনে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানানোর এই তো সুযোগ।