নীহারিকার ছবি এক ক্লিকেই তোলা যায় না
ঢাকায় বাসার ছাদ থেকে ওরিয়ন নেবুলা বা কালপুরুষ নীহারিকার ছবি তুলেছেন জুবায়ের কেওলিন। ৭ নভেম্বর ছবিগুলো ফেসবুকে পোস্ট করার পর থেকেই ভাইরাল। আগেও তারকারাজির এমন অনেক ছবি তুলেছেন জুবায়ের। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তানভীর রহমান
প্রথম আলো :
অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফির প্রতি আগ্রহ তৈরি হলো কীভাবে?
সৌরজগৎ সম্পর্কে জানার আগ্রহ ছোটবেলা থেকেই ছিল। চশমার কাচ দিয়ে একটা টেলিস্কোপ বানিয়েছিলাম। ওইটা দিয়ে তারা দেখে আশ্চর্য লাগত, খালি চোখে যেখানে এক-দুটি তারা দেখা যায়, সেখানে টেলিস্কোপ দিয়ে শত শত, হাজার হাজার দেখা যাচ্ছে। ওই সময় থেকে একটা পরিকল্পনা ছিল নিজের কাছে প্রতিজ্ঞার মতো, বড় হয়ে ভালো একটা টেলিস্কোপ বানাব।
তারপর বহুদিন চলে গেল। পেশাগত জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ২০১৮ সালের দিকে অনেক কিছু নিয়ে স্টাডি ও গবেষণা করছিলাম—ইলেকট্রনিকস, রোবোটিকস, থ্রিডি প্রিন্টিং ইত্যাদি। তখন ভাবলাম, আমার কাছে তো ওই টুলসগুলো আছে, যেগুলো দিয়ে ছোটবেলার স্বপ্নগুলো পূরণ করতে পারি, একটা ভালো টেলিস্কোপ বানাতে পারি। ওইটা নিয়ে আবার গবেষণা আরম্ভ করলাম, কেমন টেলিস্কোপ চাই, এটা দিয়ে আমি কী দেখতে চাই! এ সময় মহাকাশের সুন্দর সুন্দর ছবি তোলেন, এমন কিছু আলোকচিত্রীর কাজ দেখি। আমি ভাবতাম, এগুলো হয়তো স্পেস টেলিস্কোপ দিয়ে তুলতে হয়। যখন দেখলাম যে বাড়িতে বসেই তোলা যায়, তখন ফটোগ্রাফিক টেলিস্কোপ বানানোর সিদ্ধান্ত নিই।
প্রথম আলো :
প্রথম ছবি তোলার গল্পটা কি মনে আছে?
অবশ্যই। ওইটা জীবনেও ভুলব না। তারিখটা এখনো মনে আছে, ২০১৯ সালের ২৬ ডিসেম্বর। তখন প্রায় সকাল। জানালা দিয়ে তাকিয়ে আকাশের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করছি। যেটা প্রতিদিনই করি। ওই দিন বাইরে তাকিয়ে দেখি, সূর্য আধখাওয়া অবস্থায় আছে অর্থাৎ সূর্যগ্রহণ চলছে। আমি তখন খুবই রোমাঞ্চিত হয়ে গেলাম। টেলিস্কোপের কাজ তখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। ওই অবস্থাতেই সূর্যগ্রহণের ছবি তুললাম। ওইটা আমার কাছে খুবই বিশেষ স্মৃতি।
প্রথম আলো :
ছবিগুলো কীভাবে তোলা হয়?
আপনি ক্যামেরা দিয়ে একটা দিকে তাকাবেন। তারপর একটা ক্লিক করবেন। ব্যস, ছবি উঠে গেল। নীহারিকাসহ অ্যাস্ট্রোনমির ছবি এভাবে ওঠে না। এখানে অনেক দূরের জিনিস দেখতে হয়। দূরের জিনিসের দুটি সমস্যা। যদি আমরা সৌরজগতের গ্রহ বা চাঁদের কথা চিন্তা করি, এটা পৃথিবী থেকে অনেক দূরে, আমাদের বায়ুমণ্ডলের বাইরে। আর বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রার যে পার্থক্য, এর কারণে বাতাসটা থরথর করে। এ জন্য দূরের জিনিস টেলিস্কোপ দিয়ে দেখলে দেখবেন, কাঁপছে। এটা কাটানোর জন্য আমরা অনেক ছবি তুলি, অনেকগুলো এক্সপোজার নিই। ছবিগুলোতে স্টকিং (১০০০ বা এ রকম অনেক ছবিকে এভারেজ করে একটা ছবি বানানো, যাতে বায়ুমণ্ডলের তারতম্য, থরথর ভাব অনেকখানি চলে যায়) নামক একটা কৌশল প্রয়োগ করি। এরপর ছবিটা এডিট করে কনট্রাস্ট ঠিক করে, নয়েজ থাকলে কমিয়ে যে ছবিটা পাওয়া যায়, সেটাই আমরা উপস্থাপন করি। অন্যদিকে ডিপ স্কাই বা মহাকাশের ভেতর যে বস্তু আছে (যেমন নীহারিকা, গ্যালাক্সি), এগুলোর ছবি লম্বা সময় ধরে তুলতে হয়। আমরা যখন গ্রহ বা চাঁদের ছবি তুলি, তখন ফাস্ট এক্সপোজার ব্যবহার করি। আর যখন আমরা নীহারিকার ছবি তুলি, তখন আমাদের লম্বা (দীর্ঘ) এক্সপোজার নিতে হয়।
প্রথম আলো :
সম্প্রতি তোলা আলোচিত ছবিগুলো সম্পর্কে জানতে চাই?
যে ছবিগুলো নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, এগুলোর কিছু এ বছর তুলেছি, কিছু গত বছর তুলেছি। চাঁদের ছবি যেটা তুললাম, এটা আমার বানানো টেলিস্কোপ দিয়েই। আমি জুপিটার বা বৃহস্পতির টাইম-ল্যাপস নিয়েছি, যেখানে জুপিটার ঘুরছে। মঙ্গলগ্রহের ছবি ও শুক্রগ্রহের পর্যায় (ফেজ) পরিবর্তনের ছবি তুলেছি। ১২ নভেম্বর যে ছবিটা শেয়ার করলাম, এটা সূর্যের ছবি। মে মাসে তোলা। তখন সূর্যে বিশাল চুম্বকীয় (ম্যাগনেটিক) ঝড় হয়েছিল।
প্রথম আলো :
ছবি তোলার সরঞ্জাম কিনতেও তো অনেক টাকা লাগার কথা...
আমি একজন অ্যানিমেটর, ভিএফএক্স আর্টিস্ট ও ফিল্মমেকার। পেশাগতভাবে প্রায় ২০ বছর এগুলো নিয়ে কাজ করছি। আমার রোজগার থেকে যে জমানো টাকা থাকে, সেটা অ্যাস্ট্রোনমিতে খরচ করি। এটা করতে আমার ভালো লাগে।
প্রথম আলো :
আপনার নামের ‘কেওলিন’ অংশটা আনকমন...
এটা আমার আসল নাম। আমার সার্টিফিকেট, আইডি কার্ড—সব জায়গায় এই নাম। আমার মা–বাবা বেশ সৃজনশীল বলে আমার মনে হয়। এ কারণে এই নাম রেখেছেন। এই নামের অর্থ হচ্ছে মাটি। এই জমিন থেকে আমরা উঠে এসেছি। আমরা এই পৃথিবীর প্রাণী। হয়তো ওখান থেকে নামটা এসেছে।
প্রথম আলো :
আপনার তোলা ছবিগুলো নিয়ে নিশ্চয় কোনো পরিকল্পনা আছে...
আমি ছবিগুলো নিয়ে প্রদর্শনী করতে চাই। একটা বই লেখার ইচ্ছা আছে। আমি প্রচুর চাঁদের ছবি তুলি। শুধু চাঁদের ছবি দিয়েই দু-তিনটা বই করা যাবে। পুরো মহাকাশ নিয়েও বই করার ইচ্ছা আছে, যেখানে সৌরজগৎ ও এর বাইরের বিভিন্ন বিষয় থাকবে। কীভাবে টেলিস্কোপ বানান, আমি কীভাবে বানাতে পারব—এ ধরনের প্রশ্ন আমার কাছে অনেক বেশি আসে। তাদের জন্য কিছু করার চেষ্টা করব।