ঘর দেখে অঞ্চল চেনা যায়
এক দেশের সঙ্গে যেমন আরেক দেশের বাড়িঘরের ফারাক আছে, তেমনি দেশের ভেতরেও একেক অঞ্চলে দেখা যায় একেক ধরনের বাড়ি। এটা সাধারণত সেই অঞ্চলের ভূপ্রকৃতির ওপর নির্ভর করে। আছে আরও নানা নিয়ামক। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বসতির যে বৈচিত্র্য, তা নিয়ে লিখেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও নগর–পরিকল্পনাবিদ ড. আকতার মাহমুদ
বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকার বসতি, অবকাঠামোসহ সামগ্রিক ভূচিত্রে একটা রূপান্তর লক্ষ করা যাচ্ছে। পৌর এলাকায় তো বটেই, এমনকি গ্রামগঞ্জ, হাটবাজার, উপজেলা সদর—সর্বত্রই অপরিকল্পিতভাবে পাকা বাড়িঘর ও বসতি এলাকা সম্প্রসারিত হচ্ছে। অথচ কিছুদিন আগপর্যন্তও গ্রামীণ এলাকা ঘরবাড়ি নির্মাণে নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য ধরে রেখেছিল। যুগ যুগ ধরে স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য উপকরণ দিয়ে বাড়িঘর তৈরি করার রেওয়াজ ছিল। স্থানীয় পরিবেশ, জলবায়ু, ভূমিরূপ, কারিগরদের নির্মাণকৌশলের দক্ষতা ইত্যাদি বাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলত। আর সেই কারণে ছোট এই দেশের ভেতরেও বিভিন্ন অঞ্চলে বাড়ি নির্মাণে বৈচিত্র্যপূর্ণ স্থাপত্য ও ঐতিহ্য এখনো পরিলক্ষিত হয়।
ভারতীয় উপমহাদেশের এই অঞ্চলে সুপ্রাচীনকাল থেকে বাড়িঘর নির্মাণ করার ক্ষেত্রে নানা ধরনের রীতিনীতি, কলাকৌশল মেনে চলতে দেখা যায়। এমনকি ঘরের ভেতরে রান্নাঘর, শোবার ঘর, বৈঠকখানা ইত্যাদি রুমের বিন্যাস করতেও লোকজ বিশ্বাস, ধ্যানধারণাকে পরিপূর্ণভাবে মেনে চলা হতো। আবহমানকাল থেকে খনার বচন বাংলার মানুষের যাপিত জীবনের অনুষঙ্গ হয়ে টিকে আছে। এ অঞ্চলের সূর্যের আলো, বাতাসের প্রবাহ, ঋতু পরিবর্তন, ঝড়–বৃষ্টির ধরনকে প্রাধান্য দিয়ে খনার বচন তৈরি হয়েছে, যা মানুষ ঘর তৈরিতে যুগ যুগ ধরে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছে।
‘দক্ষিণ দুয়ারী ঘরের রাজা
পুব দুয়ারী তার প্রজা
পশ্চিম দুয়ারীর মুখে ছাই
উত্তর দুয়ারীর খাজনা নাই।’
বাস্তু বিষয়ে এ অঞ্চলের মানুষের নানা ধরনের রিচ্যুয়াল পালন করতেও দেখা যেত। বসতভিটা তৈরিতে বাস্তুদোষ, শুভাশুভ নানা ধরনের বিশ্বাস কাজ করত, এখনো করে। বাড়ির কোথায় কোন ধরনের গাছ লাগাতে হবে, এ বিষয়েও বাড়িতে বসবাসকারী মানুষের কল্যাণ-অকল্যাণ, শুভ-অশুভ গাছ বিবেচনা করা হতো। বাড়ির পাশে নিমগাছ লাগানোর কথা বলা হয়ে থাকে, যা বাতাস বিশুদ্ধ করে। নারকেল, সুপারি ও বেলগাছ ঘরের সঙ্গে লাগালে কল্যাণ হয়। নারকেল–সুপারির গাছ কল্যাণ করুক আর না করুক, এর শিকড় যে ভিটার মাটিকে সুরক্ষিত করে, এটা নিশ্চিত।
গ্রামীণ বসতিতে ‘বাড়ি’ বলতে শুধু ঘর নয়। ঘর, বাড়ির উঠান, পুকুর, কাছারিঘর, গোলাঘর ইত্যাদি মিলেই তৈরি হয় গ্রামীণ বাস্তু। দেশের সমতল এলাকায় উঁচু জমিতে উঠানকে ঘিরে তৈরি হয় গ্রামীণ ঘরবাড়ি। যেখানে উঁচু জমি থাকে না, সেখানে পুকুর কেটে সেই মাটি দিয়ে তৈরি করা হয় উঁচু ভিটা। সামাজিক পর্দাপ্রথা ও ধর্মীয় আচার–অনুষ্ঠানভেদে বাড়ির পরিসরের বিন্যাস ও এর ব্যবহারও আলাদা হয়ে থাকে। অনেক বাড়িতে সামনে ও পেছনে দুটো আলাদা পুকুরও থাকে।
নদীমাতৃক বাংলাদেশ প্রধানত সমতল হলেও এখানে কিছু বিশেষায়িত অঞ্চল আছে। যেমন পাহাড়, হাওর, চর, দ্বীপ, উপকূল। এসব এলাকার বাড়িঘর নির্মাণের উপকরণের প্রাপ্যতার যেমন ভিন্নতা আছে; তেমনি বাড়িঘর নির্মাণের বিভিন্ন নিয়ামক, যেমন ভূমিরূপ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত ইত্যাদিরও বিভিন্নতা আছে। ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাড়িঘরের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ স্বাতন্ত্র্য লক্ষ করা যায়। তেমনই কিছু ধরনের
কথা বলি।
মাচাং ঘর, পাহাড়ি এলাকা
পাহাড়ি এলাকার বসতবাড়ি সমতলের বসতবাড়ি থেকে আলাদা। বাড়ি তৈরির সময় তারা পাহাড় কেটে সমতল করে ফেলে না। বরং কাঠ ও বাঁশ দিয়ে মাচাং তৈরি করে। মাচার ওপর বাঁশ, বেত, ছন দিয়ে ঘর তৈরি করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ১১টি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীই এভাবে ঘর তৈরি করে থাকে। বন্য প্রাণীর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে তারা এমন কৌশল গ্রহণ করেছিল। বন্য প্রাণী বা সরীসৃপ যেন বিনা বাধায় নিচ দিয়ে চলে যেতে পারে, এভাবে বাড়ি বানানোর এটাও একটা কারণ। অনেক পাহাড়ি পরিবার মাচাংয়ের নিচে হাঁস–মুরগি ও গবাদিপশু পালন করে। ঝড়বৃষ্টিসহ যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে তাদের সুরক্ষা দেয় মাচাং।
সমতলের অনেক মানুষ আজকাল পাহাড়ে বাস করা শুরু করেছে। পাহাড় কেটে সমতল করে সেখানে বাড়িঘর তৈরি করে তারা। গাছপালা কেটে মাটির গঠন দুর্বল করে ফেলে। যার কারণে বর্ষায় পাহাড়ধসের মতো ঘটনা ঘটে।
উপকূল অঞ্চলের ঘর
ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগপূর্ণ এলাকায় মানুষ সাধারণত দুর্যোগসহনশীল বাড়িঘর নির্মাণ করে। সহজে স্থানান্তর করা যায় অথবা দুর্যোগে আর্থিকভাবে কম ক্ষয়ক্ষতি হবে, এমনভাবে বাড়ি তৈরি করে। যে কারণে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের মতো সুন্দরবনঘেঁষা উপকূলীয় এলাকায় ঘরের কাজে স্থানীয় গোলপাতা ও হোগলাপাতার ব্যবহার দেখা যায়। সহজলভ্য হওয়ায় এসব উপকরণে বাড়ি তৈরিতে খরচও কম।
টিনের ঘর, মুন্সিগঞ্জ
ঢাকার কাছেই মুন্সিগঞ্জ। এ অঞ্চলের ঘরের ডিজাইন, নির্মাণকৌশল, নির্মাণ উপকরণ ও সৌন্দর্য অনন্য অসাধারণ। হুমায়ুন আজাদের কবিতায় ও লেখায় রাঢ়ীখালের দোতলা টিনের এ অসাধারণ ঘরের বর্ণনা পাওয়া যায়। কাঠের বাড়িতে থাকা জাপানিজদের পুরোনো ঐতিহ্য। মূলত ভূমিকম্প ও সুনামির ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে ইট–কংক্রিটের পরিবর্তে কাঠের ঘর পছন্দ করে তারা। একইভাবে মুন্সিগঞ্জের মানুষ নদীভাঙনের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সহজে সরিয়ে নেওয়া যায়, এমন কাঠের ঘর তৈরি করে।
এই ঘরের নির্মাণকৌশলও অভিনব। ইস্পাত অথবা কাঠের কাঠামোর ওপর আলাদাভাবে তৈরি করা ছোট ছোট অংশ জুড়ে দেওয়া হয়। ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্য কোনো প্রয়োজনে সহজেই ঘরগুলোর প্রতিটি জোড়া খুলে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তর করা যায়। অবস্থাপন্ন ঘরের মানুষ বিশেষ ধরনের টিন দিয়ে বাড়ির ওপর দৃষ্টিনন্দন কারুকাজ করে থাকে।
ঐতিহ্যবাহী এসব ঘরবাড়ি বেচাকেনার জন্য হাট বসে। অন্যান্য পণ্যের মতো ঘর বিক্রি হয়। দাম পরিশোধের পর ক্রেতার জায়গায় ঘর বসিয়ে দেওয়া হয়।
মাটির ঘর, উত্তরবঙ্গ
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষত উত্তরবঙ্গে মাটির ঘর দেখা যায়। একজন অভিজ্ঞ কারিগর স্তরে স্তরে মাটির দেয়ালগুলো নির্মাণ করেন। কার্তিক থেকে চৈত্র—শুষ্ক মৌসুমের এই ছয় মাস সময়কালে মাটির ঘর নির্মাণ করেন কারিগরেরা। দেয়াল বেশ পুরু থাকে বলে শীতকালে ঘরের ভেতরটা বেশ উষ্ণ থাকে, আবার গরমের দিনে ঘরের ভেতরটা তুলনামূলক শীতল থাকে। টিনের ঘরের তুলনায় মাটির ঘরে বসবাস বেশ আরামদায়ক। এ অঞ্চলে বৃষ্টিবাদল অপেক্ষাকৃত কম বলে মাটির ঘর ও দেয়ালের ক্ষতিও হয় কম। চাঁপাইনবাবগঞ্জের মাটির বাড়িতে একধরনের আলপনার নকশা চোখে পড়ে।
মাটির বাড়ি আগে দোতলা–তিনতলা পর্যন্তও হতো। মাটির সহজলভ্যতা, প্রয়োজনীয় উপকরণের প্রতুলতা আর শ্রমিক খরচ কম হওয়ায় আগের দিনে মানুষ মাটির ঘর বানাতে আগ্রহী ছিল। কিন্তু বর্তমানে বাড়ি নির্মাণের আরও সহজ ও টেকসই উপকরণ পাওয়া যায় বলে ঐতিহ্যবাহী এই বাড়ি ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। গাজীপুর, চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের আরও কিছু জেলায় মাটির ঘর বানানোর চল ছিল।
গুচ্ছ বাড়ি, হাওরাঞ্চল
হাওর এলাকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বছরের একটা বড় সময় ধরে পানি থাকে। তাই এখানকার বসতিগুলো থাকে উঁচু জমিতে। কখনো সরু বাঁধের মতো উঁচু করে, কখনোবা উঁচু ঢিবির ওপর। হাওরাঞ্চলে অল্প স্থানে অনেক বাড়িঘর হতে দেখা যায়। উঁচু ভিটামাটির অভাবে এভাবে অল্প জায়গায় অনেকগুলো ঘরবাড়ি কেন্দ্রীভূত হয়ে গড়ে ওঠে। বর্ষাকালে সিলেট-সুনামগঞ্জের হাওর এলাকার এসব গ্রামীণ বসতিকে পানির ভেতর মাথা তোলা দ্বীপের মতো লাগে।
কিছুদিন আগে সুনামগঞ্জের শিমুলবাঁক গ্রাম দেখতে গিয়েছিলাম। দেখা গেল, বাঁধের মতো চিকন উঁচু টানা লম্বা একটা বসতি। তার ওপর গাদাগাদি করে কাঁচা–পাকা একতলা ঘরগুলো দল বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। দেখে স্মরণে আসে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসের জেলেপাড়ার কথা, ‘প্রথম দেখিলে মনে হয় এ বুঝি তাহাদের অনাবশ্যক সংকীর্ণতা, উন্মুক্ত উদার পৃথিবীতে দরিদ্র মানুষগুলি নিজেদের প্রবঞ্চনা করিতেছে। তারপর ভাবিয়া দেখিলে ব্যাপারটা বুঝিতে পারা যায়। স্থানের অভাব এ জগতে নাই তবু মাথা গুঁজিবার ঠাঁই এদের ওইটুকুই।’
শেষ করার আগে তাই বলা যায়, সম্প্রতি মানুষের চাহিদা বেড়েছে, ক্রয়ক্ষমতাও বেড়েছে। সেই সঙ্গে প্রাকৃতিক উপকরণও দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে। তাই মানুষ বাড়ি বানাতে সহজে পাওয়া যায় এমন শিল্পজাত উপাদান, যেমন টিন, কংক্রিটের পিলার, ইট, স্টিলের বার ইত্যাদি ব্যবহার করছে। এখন গ্রামেও এস এস পাইপ, টাইলসের ব্যবহার বাড়ছে। গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত রাস্তা, বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট চলে গেছে। গ্রামীণ এলাকার অনেক মানুষ নিত্যব্যবহার্য গৃহসামগ্রীতেও পরিবর্তন এনেছে। ফলে চেনা পরিচিত গ্রামীণ লৌকিক চেহারায় ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসছে। বাজার অর্থনীতি শুধু কোমলপানীয় আর চিপস নয়, গৃহনির্মাণসামগ্রীকেও শহর থেকে গ্রামে, সমতল থেকে পাহাড়, চর, দ্বীপ, হাওরের প্রত্যন্ত এলাকা পর্যন্ত ছড়িয়ে দিচ্ছে।