ঘূর্ণিঝড়ে মেঘনার চরে ৯ ঘণ্টা
বিয়ের দাওয়াত খেয়ে নৌকায় বাড়ি ফিরছিলেন তাঁরা। সিত্রাংয়ের মধ্যে মাঝমেঘনায় নৌকাটির ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। তারপর উত্তাল নদীতে ভাসতে থাকে নবদম্পতিসহ ৩৭ জন। নিকষ অন্ধকারে অনিশ্চয়তার মধ্যে কাটে তাঁদের ৯টি ঘণ্টা। বর ফরহাদ মিয়ার কাছে সে রাতের গল্প শুনেছেন প্রণব কুমার দেবনাথ
বিয়েটা হুট করেই হয়ে গেছে। কনে দেখতে গিয়ে পছন্দ হয়ে গেছে। দুই পক্ষের মুরব্বিরাও রাজি। বিয়েটাও তৎক্ষণাৎ পড়ানো হয়ে যায়। তাই নিকটজনদের সেভাবে বলা হয়নি। এই মানুষদের নিয়েই পরে ২৫ অক্টোবর কনের বাড়িতে আলাদা করে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধব নিয়ে আমি শ্বশুরবাড়ি যাই।
আমাদের বাড়ি নরসিংদীর পলাশ উপজেলায়। আর আমার স্ত্রী সাবিনা আক্তারের বাড়ি নরসিংদী সদর উপজেলার কাজীরকান্দি। গ্রামটা নরসিংদী সদরে হলে কী হবে, চলাচলের জন্য কোনো সড়কপথ নেই। একদম দ্বীপের মতো। চারপাশে থইথই পানি। শহর থেকে নৌযানে প্রায় দুই ঘণ্টার পথ।
নরসিংদী শহরের থানারঘাট এলাকায় মেঘনা নদীর পাড়ে যখন আমরা পৌঁছাই, তখন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হলেও তেমন বাতাস ছিল না। আকাশও মোটামুটি পরিষ্কারই ছিল। ঘাট থেকে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা রিজার্ভ করে রওনা হই। বেলা আড়াইটার দিকে সাবিনাদের বাড়িতে পৌঁছাই। দুই পক্ষের সবাই মিলে হইহল্লা করে খাওয়াদাওয়া করি। যখন ফেরার পথ ধরব, তখন শুরু হয় বৃষ্টি। সঙ্গে বাতাস।
মাঝির ওপর ভরসা
বিকেল চারটার দিকে বাতাসের বেগ একটু কমে আসে। দেরি না করে আমরা ৩৭ জন নৌকায় চড়ে বসি। আমাদের নৌকাটা ছইওয়ালা। পাটাতনের দুই পাশে বসার জায়গা। ওপরে ছই থাকলেও দুই পাশটা খোলা। ঝিরঝির বৃষ্টিতে গা ভিজে যাচ্ছিল।
ঘাট ছাড়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই একটা ডুবো চরে আটকা পড়ে নৌকা। চর থেকে নৌকাটা সরাতে মাঝিকে বেশি বেগ পেতে হলো না। শুধু বললেন, ‘বিসমিল্লাতেই বাধা পড়ল।’ তাঁর কথা শুনে মাঝিকে বললাম, ‘আপনি চাইলে আমরা থেকে যেতে পারি।’ মাঝি বললেন, ‘আপনারা চাইলে থাইকা যান, আমার যাইতেই হইব।’ মাঝির কথা শুনে আমাদের লোকজনও বলল, ‘মাঝি যেতে পারলে আমাদের সমস্যা কী?’
প্রায় ৩০ মিনিট যাওয়ার পর মূল মেঘনায় পড়ল নৌকা। বাতাসের গতিবেগ দ্রুত বাড়ছিল। সঙ্গে প্রচণ্ড বৃষ্টি। বাতাসের তোড়ে পানি এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে গা। তীরের গাছগুলোকে দেখছি বাতাসে প্রচণ্ড দুলছে। নদীপথে যাতায়াতের তেমন অভিজ্ঞতা আমাদের নেই। তাই এমন বৈরী আবহাওয়া দেখে সবাই ভয় পেয়ে গেল। মাঝিকে বললাম, ‘চলেন ফিরে যাই।’ অভয় দিলেন মাঝি, ‘এত দুশ্চিন্তা কইরেন না, ইনশা আল্লাহ চলে যাব।’
ঠিক তখনই নৌকার ইঞ্জিনটা বন্ধ হয়ে গেল। বড় বড় ঢেউয়ে দোল খেতে থাকল নৌকা। ভয়ে সবাই চিৎকার দিয়ে উঠল। আমাদের অভয় দিয়ে ইঞ্জিন ঠিক করতে গেলেন মাঝি। নিয়ন্ত্রণহীন নৌকাটা গিয়ে একটি ড্রেজারের সঙ্গে ধাক্কা খেল। ইঞ্জিন সারাইয়ের কাজ ফেলে নৌকার কোথাও ভেঙেছে কি না দেখতে চলে গেলেন মাঝি। তাঁর আচরণে আরও ভয় ধরে গেল। আমাদের সঙ্গে শিশুরা আছে। তাদের অনেকে ভয়ে কাঁদতে থাকল।
ইঞ্জিনটা আর চালু হলো না
অনেক চেষ্টার পরও নৌকার ইঞ্জিনটা আর চালু করা গেল না। স্রোতের অনুকূলে ভাসতে থাকল। মাঝির মুখে আর কোনো কথা নেই। আমাদের ভাগ্য এখন নিয়তির ওপর। ভাসছি তো ভাসছি। একসময় একটি বালুচরের কাছে জমে থাকা কচুরিপানায় আটকা পড়ে নৌকা। ঘড়িতে বাজে তখন বিকেল ৫টা।
সিত্রাংয়ের প্রভাবে সন্ধ্যার আগে থেকেই চারপাশ অন্ধকার। কচুরিপানায় আটকা পড়লেও ঢেউয়ের ঝাপটায় নৌকা দুপাশ থেকে ক্রমাগত দুলছে। ঝোড়ো বৃষ্টিতে কমবেশি সবাইই ভিজেছে। এখন শীতে কাঁপছে। নৌকার ভেতরে পানি উঠছে। পানি বাইরে ফেলার কাজে হাত লাগিয়েছে কয়েকজন। শিশু ও নারীরা ভয়ে দোয়া-দরুদ পড়তে পড়তে কান্নাকাটি করছিল।
পরিস্থিতি একসময় এমন দাঁড়াল, দুজনের দাঁত কপাটি লেগে গেল। একজন তো অজ্ঞানই হয়ে গেলেন। কেউ কেউ তাঁদের চোখে-মুখে পানি দিচ্ছে। অনেকের বমি হলো। অবস্থা দেখে আমরা যাঁরা এতক্ষণ অন্যদের অভয় দিচ্ছিলাম, তাঁদেরও ভয় ধরে গেল।
এদিকে স্বজনেরা মোবাইলে কল দিয়ে খোঁজ নিচ্ছেন। তাঁরাও চিন্তিত। কিন্তু আমরা কোথায় আছি, ঠিক করে বলতে পারছি না, আর তাঁরাও এই ঝড়ের সময় কোনো নৌকা পাচ্ছেন না। তাই উদ্ধার করতেও কেউ আসতে পারছেন না।
ভেবেছিলাম কোনো যাত্রীবাহী নৌকা বা বালুবাহী বাল্কহেড আশপাশ দিয়ে গেলে সাহায্য পাব। কিন্তু কোনো নৌকাই পেলাম না।
সন্ধ্যা ৭টা। কোনো উপায় না পেয়ে আবার স্বজনদের ফোন করি, ‘আমাদের বাঁচান।’ প্রতিবারই তাঁরা সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, চেষ্টা করছি। একটু পরপর তাঁদের ফোন আসে, ‘ঝড়বৃষ্টিতে কোনো নৌকা পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ ঝুঁকি নিয়ে আসতে চায় না।’
নানা চিন্তা আমাদের মনের ভেতর বাসা বাঁধে। মনে হতে থাকে, আমরা হয়তো আর বেঁচে ফিরতে পারব না। একজন আরেকজনকে সান্ত্বনা দিতে থাকি। ওদিকে বৃষ্টিতে ভিজে দুজন করে পালাক্রমে গিয়ে নৌকার হাল ধরে থাকি। যাতে করে নৌকাটা অন্য কোথাও ভেসে না যায়।
আশীর্বাদের মতো পরামর্শ
রাত ১০টা বাজে। বাতাসের গতি কিছুটা কমে এসেছে। ফেরার মতো কোনো আশার আলো দেখি না। তখনই লোকমান হোসেন নামের আমাদের এক আত্মীয় কল করেন। আমার ভয়ার্ত কণ্ঠ শুনে বলেন, ‘৯৯৯-এ কল দিয়ে ঘটনা জানাও।’
এরপর জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯-এ কল দেন আমার চাচা। কিন্তু অপর প্রান্তে কেউ কল রিসিভ করে না। প্রায় সাত মিনিট ধরে চেষ্টা করেও তিনি সংযোগ পান না। পাঁচ মিনিটের মতো আমিও চেষ্টা করলাম। হতাশ হয়ে কলটা যখন কাটব, তখনই ওই প্রান্ত থেকে কল ধরেন এক নারী পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি সমস্যার কথা জানতে চান। ঘটনার বিস্তারিত জানাই আমরা। আমাদের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চান। সেটা জানানোর পর ওই কর্মকর্তা আমাদের সাহস দেন এবং অপেক্ষা করতে বলেন।
আমাদের অবস্থা জানার জন্য দফায় দফায় যোগাযোগ করতে থাকে ৯৯৯। নরসিংদী মডেল থানা ও করিমপুর নৌ ফাঁড়ি থেকেও যোগাযোগ করে। তবে বিপত্তি বাধায় ঘূর্ণিঝড়। ঝড়ের কারণে তাঁরাও কোনো নৌকা পাচ্ছিলেন না। তবে আশ্বস্ত করতে থাকেন যেকোনো মুহূর্ত চলে আসবেন।
রাত পৌনে ১২টার দিকে নৌ পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, উদ্ধারকারী বোট চলে এসেছে। তাঁরাও রওনা হয়ে গেছেন। আমরা অপেক্ষা করতে থাকি। রাত একটার দিকে আমাদের কাছাকাছি একটা নৌকা আসে। আশায় বুক বাঁধি সবাই। কিন্তু কাছে এসেও আমাদের তাঁরা দেখতে পান না। আমাদের হাঁকডাকও শুনতে পান না। নদীর এমন এক নির্জন জায়গায় আমরা আটকে পড়েছি, যেখানটায় নৌকার যাতায়াত একদমই কম। একে একে চারবার আমাদের কাছ দিয়ে ঘুরে চলে গেল উদ্ধারকারী বোট। বুঝলাম আমাদের অবস্থান নিশ্চিত হতে পারছেন না তাঁরা। এরপর একজনের মাথায় বুদ্ধি এল, মোবাইল জ্বালিয়ে হাত নাড়ালেই তো হয়।
কয়েক মিনিট মোবাইলে আলো জ্বালিয়ে ধরে থাকার পর তাঁরা আমাদের অবস্থান ধরতে পারলেন। আলো জ্বালিয়ে এগিয়ে আসতে থাকল একটা নৌকা। কচুরিপানার জঞ্জাল ঠেলে ধীরে ধীরে আমাদের কাছে চলে এলেন উদ্ধারকারীরা।
সেই সময়টার কথা কোনো দিন ভুলব না। মনে হচ্ছিল, নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে এসেছেন কয়েকজন দেবদূত। জেলা ও নৌ পুলিশের সদস্যরা একে একে আমাদের উদ্ধারকারী বোটে তুলে নেন। নিয়ে যান করিমপুর নৌ পুলিশ ফাঁড়িতে। বাকি রাতটা আমরা সেখানেই থাকি।