৬ বার বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে অবশেষে শিক্ষা ক্যাডারে প্রথম রাশেদুল
শুরু থেকেই বিসিএসের প্রতি প্রবল আগ্রহী ছিলেন রাশেদুল হাসান। অন্য কোনো চাকরি করবেন না, একরকম সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিলেন। তাই স্নাতকোত্তর যখন শেষ হলো, টিউশনি, চাকরির প্রস্তুতি—সবকিছু মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেন। লক্ষ্য তখন শুধুই বিসিএস। কিন্তু কে জানত, সামনে তাকে দীর্ঘ এক পথ পাড়ি দিতে হবে। ৩৫তম থেকে বিসিএস যাত্রা শুরু করেছিলেন রাশেদুল। এরপর ৪১তম পর্যন্ত তাঁকে লড়তে হয়েছে। মাঝের সময়টুকুতে যে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন, তা কিন্তু বলা যাবে না। এক্সিম ব্যাংকে কয়েক বছর চাকরি করেছেন। ৩৫, ৩৬, ৩৮ ও ৪০তম বিসিএসে হয়েছিলেন নন-ক্যাডার। তবে চূড়ান্ত সফলতার দেখা পান ৪১তম বিসিএসে। এটি ছিল তাঁর জীবনের শেষ বিসিএস। এই শেষ বিসিএসে অংশ নিয়েই শিক্ষা ক্যাডারে (ইংরেজি) প্রথম হয়েছেন রাশেদুল।
২০১৫ সাল থেকে বিসিএসের জন্য পড়ছি। পুরোপুরি সময় যদি বিসিএসের জন্য দিতে পারতাম, হয়তো কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে আরও আগে পৌঁছাতাম।রাশেদুল হাসান
ছয়বার চেষ্টা করেছেন, সত্যিই কি বিষয়টা তা-ই? মুরাদ বলেন, ‘স্নাতক পড়ার সময়ই আমি ৩৫তম বিসিএসে অংশগ্রহণ করি। তা ছাড়া খুব অল্প বয়সে লেখাপড়া শুরু হয় আমার। চার বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম। মনে পড়ে ক্লাসের সবচেয়ে কম বয়সী শিক্ষার্থী ছিলাম আমি।’
ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে প্রথম আলোর সংবাদটি তাঁর চোখে পড়ে। জানতে পারেন, বৃহস্পতিবার ফল বের হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আগে থেকে সেভাবেই প্রস্তুত ছিলেন। ফল ঘোষণার দিন বারবার ওয়েবসাইটে ঢুঁ মারছিলেন। বাড়তি একটা দুশ্চিন্তাও কাজ করছিল, আগের মতো নন-ক্যাডার না হয়ে যান। রাশেদুল বলেন, ‘আমার ভাই স্বাস্থ্য ক্যাডারে আছেন। রেজাল্ট সাধারণত ও-ই দেখে। এবার আমি নিজেই দেখতে বসেছিলাম। বারবার স্ক্রল করছিলাম। যেন সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পাই। অবশেষে কাঙ্ক্ষিত ফলের দেখা পেলাম।’ অনুভূতি প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, ‘অনেকে শিক্ষা ক্যাডার শেষ পছন্দ হিসেবে দেয়। আমি কিন্তু তা করিনি। আবেদনের সময় শিক্ষা ক্যাডারকে ওপরের দিকেই রেখেছিলাম। পছন্দের বিষয়ে ক্যাডার হলে ভালো লাগে। অনুভূতি অসাধারণ।’
রাশেদুল লেখাপড়া করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। বিশ্ববিদ্যালয়টির ২০০৬-০৭ সেশনের শিক্ষার্থী তিনি। স্নাতক-স্নাতকোত্তরের পরপরই পুরোদমে শুরু করেন বিসিএস প্রস্তুতি। এভাবে ২০১৫ সাল থেকে বিসিএসের পেছনে ছুটছেন তিনি। দীর্ঘ এ–যাত্রায় কখনো ক্লান্তি ভর করেনি? উত্তরে বলেন, ‘আমি আহত যোদ্ধার মতো চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছি। ৩৫ থেকে শুরু করে ৩৮ পর্যন্ত কোনো বিসিএসেই যখন কাঙ্ক্ষিত ফল পেলাম না, তখন ৩৮তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার মার্কশিটটা তুলি। সেখানে আবিষ্কার করি, কয়েকটা বিষয়ে অনেক ভালো করলেও আমার নিজের বিষয়—ইংরেজিতেই সবচেয়ে কম নম্বর পেয়েছি। অথচ এই বিষয়েই আমার বেশি পাওয়ার কথা। সেদিনই ধরে নিয়েছিলাম, আমার ভাগ্যে বিসিএস নেই। এরপর পরিবারের সদস্যরা বোঝাল, “কিছু না হোক। শুধু পরীক্ষাটা দাও।” এই পরীক্ষার ফল যদি ২০৩০ সালেও দিত, তাতে আমার কোনো মাথাব্যথা থাকত না।’
বিসিএসে আগ্রহীদের উদ্দেশে রাশেদুল বলেন, ‘অনেক বেশি এফোর্ট দিতে হবে। এর মধ্যে পুরোপুরি ডুবে যেতে হবে। ধৈর্য ধারণ করতে হবে। ধৈর্য ধরার সামর্থ্য যাঁর নাই, তাঁর জন্য বিসিএস নয়।’ তাঁর পরামর্শ, ‘ষষ্ঠ থেকে দশম অর্থাৎ মাধ্যমিক স্তরের যে বইগুলো বিসিএসের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক; যেমন বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়, বিজ্ঞান, আইসিটি—এগুলো যদি স্নাতক পর্যায়েও পড়ে ফেলা যায়; আমার মনে হয় এটা খুব ভালো কাজে দেয়।’
বাবা ছিলেন অসুস্থ। টানাটানির সংসার। এমন অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ থেকেই রাশেদুল টিউশনি শুরু করেন। নিজের খরচ তো চালাতেনই, পরিবারেও টাকা পাঠাতেন। তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় বাবা মারা গেলে বড় ছেলে হিসেবে সব দায়িত্ব এসে পড়ে রাশেদুলের ওপর। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘২০১৫ সাল থেকে বিসিএসের জন্য পড়ছি। পুরোপুরি সময় যদি বিসিএসের জন্য দিতে পারতাম, হয়তো কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে আরও আগে পৌঁছাতাম। ব্যাংকে চাকরি পাওয়ার পর সারাটা দিন অফিসে চলে যেত। অফিস থেকে আসতে আসতে রাত ৭-৮টা, ৯টা বাজত। এরপর বাসায় যতটুকু সময় পেতাম পড়তাম। ব্যাংকে যাওয়া-আসার সময় বাসের মধ্যে, বাসের জন্য অপেক্ষা করতে করতে পড়তাম। এভাবেই প্রিলিমিনারি পরীক্ষা দিয়েছি। আমি কখনো থামিনি। আমার এই প্রাপ্তিটা আমার মায়ের চরণে নিবেদন করতে চাই। তাঁর ঋণ কখনো শোধ হওয়ার নয়।’