এই প্রথম নবীন শিক্ষার্থীদের জন্য হলে ২০ শতাংশ আসন ফাঁকা রাখা হয়েছে
ঈদুল আজহার ছুটিতে বাড়ি ফেরার সময় শিক্ষার্থীরা ভাবতেও পারেননি, সশরীরে আবার তাঁদের ক্লাস শুরু হতে হতে পাক্কা ১৪৬ দিন লেগে যাবে। প্রথমে শিক্ষকদের আন্দোলন, পরে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের কারণে দীর্ঘ বন্ধের পর ক্যাম্পাস খুলেছে গত ২০ অক্টোবর। এরই মধ্যে বদলে গেছে অনেক কিছু। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে রদবদল হয়েছে। পড়াশোনার পরিবেশ, ক্যাম্পাসে স্থিতিশীলতা, শিক্ষার্থীদের বাক্স্বাধীনতা, জবাবদিহিতা, শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক, নতুন অবকাঠামোসহ নানা বিষয়েই এখন সরব শিক্ষার্থীরা।
কেটেছে ‘দাপটের সংস্কৃতি’
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের অন্তত ১০ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হলো গত ২৯ অক্টোবর। তাঁদের ভাষ্য, ক্যাম্পাসে ভয়ের রাজত্বের অবসান হয়েছে। প্রশাসনের ‘একনায়কতান্ত্রিকতা’র কারণে ক্যাম্পাসে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অনেকেই কোণঠাসা ছিলেন। কদিন আগেও দলীয় ও প্রশাসনিক লেজুড়বৃত্তির চর্চা এতটাই প্রকট ছিল যে সামাজিক যোগযোগমাধ্যমে সামান্য ‘রিঅ্যাকশন’ বা মন্তব্যের জন্যও হেনস্তার শিকার হতেন শিক্ষার্থীরা। এখন পরিস্থিতির পরিবর্তনের কথা বলছেন তাঁরা।
ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী জুনন সালেক বলেন, ‘ক্যাম্পাস এখন অনেকটাই স্থিতিশীল। আগে যেমন ছাত্রলীগের বিভিন্ন গ্রুপের দাপট থাকত সব সময়, এখন তা নেই।’ পরীক্ষা থাকায় এখন আড্ডা, খেলাধুলা বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান খুব একটা চোখে পড়ছে না। তবে শিক্ষার্থীদের আশা নভেম্বর থেকে ক্যাম্পাস উৎসবমুখর হয়ে উঠবে। বর্তমান প্রশাসনকে ‘শিক্ষার্থীবান্ধব’ উল্লেখ করে জুনন সালেক বলেন, ‘এই চর্চা ধরে রাখতে হবে।’
বদলেছে হলের পরিবেশ
সফটওয়্যার প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী আসিফ আনোয়ার বললেন, ‘ছাত্রদের হলগুলো ঘুরে দেখছিলাম। দেখলাম সবাই-ই নিজের বিছানায় বা স্টাডি রুমে পড়ালেখায় ব্যস্ত। কেউ ল্যাপটপে মুখ গুঁজে আছে, কেউ খাতা-কলম নিয়ে। কয়েকজনকে দেখলাম গ্রুপ স্টাডি করছে। ১৭ জুলাইয়ের আগে এ রকম চোখে পড়ত না। পরীক্ষা শুরুর আগের দিনও ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হতো। কিছু বলার সুযোগ ছিল না। বললেই হলছাড়া হতে হতো।’
শিক্ষার্থীদের কয়েকজন জানালেন, বিভিন্ন সময়ে রাতভর দুই পক্ষের সংঘর্ষ আর অস্ত্রের মহড়ায় ক্যাম্পাসে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ত। এই আতঙ্কে অনেক সময়ই নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়েছে। ছিল পরিচয় পর্বের নামে র্যাগিং, ক্যানটিনে ‘ফাও খাওয়া’, হলের মালামাল চুরি, গণরুমে গাদাগাদি, সিট দখল, দল বেঁধে ফেসবুকে পোস্ট কিংবা কমেন্টের ছড়াছড়ি। হল কর্তৃপক্ষও ছিল এসব ব্যাপারে উদাসীন। এখন পরিবেশ বদলাতে শুরু করেছে। ইতিবাচক পরিবর্তনগুলো বজায় থাকুক, এমনটাই শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা।
ছাত্রদের হলে আসনবণ্টনের ক্ষেত্রে যে সংস্কার হয়েছে, তাতে শিক্ষার্থীরা খুশি বলে জানালেন শিল্প ও উৎপাদন প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী পলাশ বখতিয়ার। তিনি জানান, গত ৩ থেকে ৬ অক্টোবর আবাসিক ছাত্র হলগুলোয় নতুন নীতিমালার আলোকে মেধার ভিত্তিতে ও বিশেষ ব্যবস্থায় বৈধভাবে আসন বণ্টন করেছে হল কর্তৃপক্ষ। এতে হলগুলোয় প্রায় এক যুগের বেশি সময় ধরে চলে আসা ছাত্রসংগঠনের আধিপত্যের অবসান হয়েছে। জানা গেছে, এই প্রথম নবীন শিক্ষার্থীদের বরাদ্দ দিতে ২০ শতাংশ আসন ফাঁকা রাখা হয়েছে।
তৈরি হচ্ছে নতুন অবকাঠামো
হলগুলোতে শিক্ষার্থীদের ৩৫ শতাংশের আবাসনব্যবস্থা আছে। অনেকেই তাই ক্যাম্পাসের বাইরে বাসা ভাড়া করে, কিংবা মেসে থাকছেন। যে ছাত্রীরা ‘সাবহলে’ (আসন–সংকট থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে একটি ভাড়া ভবনে ছাত্রীদের থাকার জায়গা) থাকেন, তাঁদেরও নানা সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। এসব সমস্যা নিরসনে ১ হাজার আসনের একটি ছাত্রহল নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আহমেদ মাহবুব ফেরদৌসী। তিনি বলেন, ‘অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্প-২ এর আওতায় আরও ১৬টি ভবন নির্মাণ হবে। এর মধ্যে আবাসিক হল, একাডেমিক ভবনও আছে। সেগুলোর টেন্ডার প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। শিগগিরই কাজ শুরু হবে।’ ছাত্রীদের জন্যও ক্যাম্পাসে আবাসনের ব্যবস্থা হবে বলে তিনি জানান।
টংদোকানে আবার জমেছে আড্ডা
একসময় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের টংদোকানকেন্দ্রিক আড্ডার একটা আলাদা সংস্কৃতি ছিল। একজন দোকানি জানালেন, সাবেক উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের নির্দেশে তাঁর দোকানের বেঞ্চগুলো সরিয়ে নেওয়া হয়, যেন শিক্ষার্থীরা বসতে না পারেন।
অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা জানান, ২০২০ সালের সমাবর্তনের ‘অজুহাতে’ ক্যাম্পাস থেকে অনেকগুলো টংদোকান উচ্ছেদ করে তৎকালীন কর্তৃপক্ষ। ২০২২ সালে সাবেক উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বিরোধী আন্দোলনের একটি অন্যতম প্রতিবাদের মঞ্চ হয়ে উঠেছিল এসব টংদোকান। প্রতিবাদের অংশ হিসেবেই টংদোকানের সামনে ‘চাষাভুষার টং’ লিখে রেখেছিলেন শিক্ষার্থীরা। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী কৌশিক মজুমদার বলেন, ‘আমাদের টং সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনা দরকার। এখানে পারস্পরিক মতবিনিময়, আলোচনা-বিতর্কের মধ্য দিয়েই নতুন নতুন ভাবনা উঠে আসে।’
মায়ের চেষ্টায় বিশ্ববিদ্যালয়ে
আজ রোববার থেকে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের পাঠ কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা। অনেক স্বপ্ন নিয়ে শাবিপ্রবির প্রাঙ্গণে পা রাখবেন একদল নতুন মুখ। তাঁদের মধ্যে তংসই খুমির গল্পটা একটু অন্য রকম।
বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার দুর্গম মংঞো পাড়ায় তংসই খুমির বাড়ি। খুমি সম্প্রদায়ের নারীদের মধ্যে তিনিই প্রথম পা রেখেছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২৪ অক্টোবর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছেন তংসই।
অনেক বাধা পেরিয়ে, মায়ের চেষ্টায় উচ্চশিক্ষালয়ে পা রাখার সুযোগ হয়েছে, জানালেন তংসই। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় তাঁর বাবা মারা যান। ধরেই নিয়েছিলেন, এরপর দুই বোনের পড়াশোনা আর হবে না। ৩০ অক্টোবর মুঠোফোনে তিনি বলেন, ‘ভেবেছিলাম মেয়েদের বাদ দিয়ে মা হয়তো শুধু আমার ভাইদেরই পড়ালেখা করাবে। কিন্তু না, মা আমাদের পড়াশোনার ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন। মায়ের চেষ্টা না থাকলে এখানে আসতে পারতাম না।’ তংসই খুমির মা লিংসাই খুমি বলেন, ‘ছেলেমেয়েরা যেন ভবিষ্যতে দেশের কল্যাণে কাজ করতে পারে, সেই চেষ্টাই করব।’
সুখবর অব্যাহত
প্রোগ্রামিং চর্চার একটা আলাদা সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে শাবিপ্রবিতে। দীর্ঘদিন ক্যাম্পাস বন্ধ থাকলেও এই চর্চায় ছেদ পড়েনি, বোঝা গেল সাম্প্রতিক এক প্রতিযোগিতার ফল দেখে। ১ নভেম্বর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সিএসই ফেস্ট ২০২৪’ এ ১১৩টি দলকে পেছনে ফেলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে শাবিপ্রবির ‘সাস্ট ফ্যানাটিকস’। প্রতিযোগিতায় মাত্র ৫ ঘণ্টায় ১২টি জটিল সমস্যার সমাধান করতে হয়েছে প্রতিযোগীদের। জানা গেছে, শিগগিরই বিজয়ী দলগুলোর হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হবে। সাস্ট ফ্যানাটিকসের সদস্যরা হলেন শাবিপ্রবির কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের নাজমুল হাসান, আলফেহ সানি ও সারওয়ার রিফাত। দলের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে ছিলেন বিভাগের প্রভাষক এ কে এম ফখরুল হোসাইন।