চমৎকার পোস্টার প্রেজেন্টেশনের যত কৌশল: আয়মান সাদিক
স্কুলে কখনোই আমাদের প্রেজেন্টেশন দেওয়ার সুযোগ ছিল না। আমরা স্কুল-কলেজ শেষ করেছিলাম প্রেজেন্টেশন ছাড়াই। প্রথম প্রেজেন্টেশন দিই বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে। আর এখনকার শিক্ষার্থীরা স্কুল থেকেই পোস্টার বানানো ও প্রেজেন্টেশন শিখে ফেলার চমৎকার একটা সুযোগ পাচ্ছে। যেহেতু এই পোস্টার বানানো আর প্রেজেন্টেশন দেওয়ার পুরো বিষয় একদম নতুন, তাই শুরুর দিকে একটু ভয় পাওয়াই স্বাভাবিক। তাই এ লেখায় শিক্ষার্থীদের কিছু পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দিতে চেষ্টা করব।
চার ধাপে কাজ
পোস্টার প্রেজেন্টেশনে প্রথম কাজ হলো পোস্টার বানানো। একটি পোস্টার বানানোর প্রক্রিয়াকে তুমি চার ভাগে ভাগ করে নিয়ে কাজ শুরু করতে পারো।
১. পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি
২. মার্জিন ও লে-আউট
৩. লেখা ও ছবি
৪. অলংকরণ বা সাজানো
প্রথম ধাপ
স্কুলে সাধারণত দুভাবে পোস্টার বানানোর কাজ দেওয়া হয়—একক ও দলগত। এককভাবে পোস্টার বানানোর সময় তো নিজের কাজ পুরোটা একাই নিজের মতো গুছিয়ে করা যায়। কিন্তু দলগতভাবে করতে হলে দলের সব সদস্যের সঙ্গে কথা বলে নিজেদের মধ্যে কাজ ভাগ করে নিয়ে তারপর শুরু করতে হবে। প্রয়োজনে শিক্ষকের পরামর্শ নিয়ে দলনেতা নির্বাচন করতে হতে পারে, যার সাহায্য ও দিকনির্দেশনায় পুরো দল কাজ করবে।
পরিকল্পনা অংশে তুমি তোমার পোস্টারটা কীভাবে চিন্তা করছ, পোস্টার দেখতে কেমন হবে, কী কী উপকরণ ব্যবহার করবে, মার্জিন কীভাবে করবে, পোস্টারে কী কী লিখবে, পোস্টারের ইনফরমেশন কোথা থেকে নেবে, কী কী আঁকবে, পোস্টারটা কীভাবে সাজাবে—এই সবকিছু আগে থেকে ভেবে, গুছিয়ে একটা খাতায় খসড়া করে ফেলো।
এরপর পরিকল্পনা অনুযায়ী কী কী উপকরণ দরকার, সেটার একটা তালিকা করে ফেলতে হবে। পোস্টার বানানোর অনেক উপকরণ আসলে আমাদের হাতের কাছেই থাকে। পুরোটাই নির্ভর করে পোস্টারের বিষয় ও সৃজনশীলতার ওপরে। সাধারণত হালকা রঙের বড় আর্ট পেপার, কলম, পেনসিল, কাঁচি, স্কেল, রঙিন কাগজ, আঠা, স্কচটেপ, স্টিকি নোটস, রং—এগুলোতেই কাজ হয়ে যায়। দোকানে অনেক ধরনের, অনেক রঙের কাগজ দেখে দ্বিধায় পড়ে যাওয়া খুব স্বাভাবিক। পোস্টার বানাতে ‘A0’ সাইজের বড় কাগজই বেশি ব্যবহৃত হয়; এটা মাথায় রাখলে কাগজ বাছাই সহজ হয়ে যাবে। আর হালকা রঙের কাগজ ব্যবহার করতে বলার কারণ, হালকা রঙের কাগজে রঙিন আঁকা ও লেখা খুব সুন্দর করে ফুটে ওঠে। দেখতে ভালো দেখায়।
দ্বিতীয় ধাপ
‘A0’ সাইজের আর্ট পেপার হাতে পেয়েই চারদিকে ৩ ইঞ্চি জায়গা রেখে মার্জিন করে ফেলতে হবে। খসড়ার সঙ্গে মিলিয়ে লে-আউট ঠিক করে পোস্টারের কোথায় কী বসাতে হবে, সেটা ভাগ করে নাও।
তৃতীয় ধাপ
পোস্টারে মূলত তিন ধরনের লেখা থাকে—শিরোনাম, উপশিরোনাম ও ব্যাখ্যা। এই তিন ধরনের লেখার ধরন ও আকৃতি যেন আলাদা হয়। শিরোনাম মূলত তোমার পোস্টারের বিষয়। উপশিরোনাম হলো দু-একটি বাক্যে তোমার বিষয়টির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। আর ব্যাখ্যা অংশে থাকবে মূল লেখা।
শিরোনাম লিখতে হবে সবচেয়ে বড় করে, উপশিরোনাম তার চেয়ে ছোট এবং ব্যাখ্যা উপশিরোনামের চেয়ে ছোট অক্ষরে লিখতে হবে। তিন ধরনের লেখা তিনটি আলাদা কালিতে লেখা ভালো। লেখাগুলো দূর থেকে দেখা যাচ্ছে কি না, তা যাচাই করে নিয়ো। আর হ্যাঁ, পোস্টারে অনেক বেশি লেখা উচিত নয়। সব পোস্টারেই লেখা থাকলে প্রেজেন্টেশনে তুমি কী বলবে!
লেখা শেষে পোস্টারে ছবি দিতে হবে। ছবি দুভাবে দেওয়া যেতে পারে—এঁকে অথবা অন্য কোনো মাধ্যম থেকে। নিজে বা দলের কেউ ভালো আঁকতে পারলে দারুণ হয়। আর আঁকতে না চাইলে ইন্টারনেট থেকে ছবি ডাউনলোড করে প্রিন্ট করে একইভাবে আকৃতি অনুযায়ী কেটে পোস্টারে লাগিয়ে ফেলতে পারো। মূল বইয়ের কোনো ছবি পোস্টারে দিতে চাইলেও সেগুলো ইন্টারনেটে এই ওয়েবসাইটে পেয়ে যাবে।
চতুর্থ ধাপ
এবার পোস্টার সাজানোর পালা। তুমি বিষয়ের সঙ্গে মিল রেখে যেকোনোভাবেই পোস্টারটা সাজাতে পারো। ধরো, বাংলাদেশের কৃষিজ সম্পদ নিয়ে পোস্টার বানালে; সেখানে সত্যিকারের কৃষিজ ফসলের বীজ লাগিয়ে দিতে পারো। বৃক্ষরোপণ নিয়ে পোস্টার বানালে, গাছের পাতা দিয়ে পোস্টারটা সাজাতে পারো।
মনে রাখতে হবে, পোস্টার বানানো ও সাজানোর আসলে কোনো নির্ধারিত নিয়ম নেই। নিজের সৃজনশীলতা কাজে লাগিয়ে বিষয়ের সঙ্গে মিল রেখে যেকোনোভাবেই পোস্টার তৈরি করা যাবে।
পোস্টার উপস্থাপনের জন্য ১০ পরামর্শ
১. পোস্টার উপস্থাপন বা প্রেজেন্টেশনে কী কী নিয়ে কথা বলা হবে, কোনটার পেছনে কতটুকু সময় দেবে, সব ঠিক করে আগে থেকেই প্রচুর চর্চা করতে হবে। প্রেজেন্টেশনের দিন গোছানো, পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি ইউনিফরম পরে গেলে আত্মবিশ্বাস বাড়বে।
২. প্রেজেন্টেশনের শুরুতে ক্লাসের সবার মনোযোগ থাকে সবচেয়ে বেশি। তাই এমন কিছু করে প্রেজেন্টেশন শুরু করতে হবে, যেন ক্লাসের সবার মনোযোগ একবারে আকর্ষণ করা যায়।
৩. যেমন একটা গল্প বলে শুরু করতে পারো। বিজ্ঞানের কোনো বিষয়ে প্রেজেন্টেশন দিলে প্রাসঙ্গিক কোনো মজার গল্প বলতে পারো। বড় কোনো সংখ্যা বা মজার কোনো তথ্যও থাকতে পারে। প্রশ্ন করে শুরু করা যেতে পারে। বিখ্যাত কোনো উক্তি দিয়েও শুরুটা করতে পারো।
৪. পোস্টারের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলা যাবে না। পাশে দাঁড়িয়ে কোনো স্কেল বা এ ধরনের কিছু দিয়ে দেখিয়ে কথা বলতে পারো।
৫. বিষয়ের সঙ্গে মিলিয়ে বিভিন্ন উপকরণও প্রেজেন্টেশনের সময় হাতে রাখা যেতে পারে। যেমন ফসলের বীজ, ইলেকট্রনিক গেজেট, ফুল, ফল, বই, শোপিস। যেমন ধরো বায়ুদূষণ নিয়ে পোস্টার বানালে। গাড়ির কালো ধোঁয়ার ক্ষতিকর প্রভাবের কথা ব্যাখ্যা করার সময় হাতে একটা খেলনা গাড়ি রাখতে পারো।
৬. দলগত প্রেজেন্টেশনে সবাই একই গতিতে কথা বলার চেষ্টা করতে হবে। কেউ দ্রুত, কেউ ধীরে, কেউ জোরে, কেউ আস্তে কথা বললে প্রেজেন্টেশনের ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়। কথার মাঝে প্রয়োজনে বিরতি দিতে হবে। কারণ, এটা প্রেজেন্টেশন, মুখস্থ পড়া দেওয়া নয়।
৭. কথা বলার সময় দাঁড়ানোর ভঙ্গি, হাত-পা নেড়ে কথা বলা, এই ব্যাপারগুলোয় সতর্ক থাকতে হবে।
৮. ক্লাসের সবার চোখে চোখ রেখে কথা বলতে হবে। সরাসরি সবার চোখের দিকে না তাকাতে পারলে ক্লাসের চার কোনায় নিজের প্রিয় চার বন্ধুকে বসিয়ে রাখতে পারো। অথবা ক্লাসরুমের দুই কোনায় দুটি জায়গা ঠিক করে পুরো প্রেজেন্টেশনের সময় ঘুরেফিরে ওই দুই দিকে তাকালেও মনে হবে সবার দিকে তাকানো হচ্ছে।
৯. চিন্তার খোরাক দেওয়ার মতো কিছু বলে প্রেজেন্টেশন শেষ করা যেতে পারে। সব শেষে পুরো প্রেজেন্টেশনের মূল বক্তব্যটা আরও একবার মনে করিয়েও দিতে পারো। বলতে পারো সুন্দর কোনো উক্তি। আমি নিজে প্রায়ই যেটা করি—শপথ করিয়ে প্রেজেন্টেশন শেষ করি। ধরা যাক, কোনো বড় সামাজিক বা পরিবেশগত সমস্যা নিয়ে প্রেজেন্টেশন দেওয়া হচ্ছে। এখানে অবশ্যই সেই সমস্যা সমাধানে কী কী করণীয় ও বর্জনীয়, সেটা বলা হবে। প্রেজেন্টেশনের শেষে এই কাজগুলোই যেন আমরা সবাই ঠিকমতো করি, সে–বিষয়ক শপথ নেওয়া যেতে পারে।
১০. প্রশ্নোত্তর পর্বের জন্য আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। শিক্ষক ও ক্লাসের অন্য শিক্ষার্থীরা নিশ্চয়ই শেষে প্রশ্ন করবে। প্রস্তুতি নেওয়া থাকলে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে উত্তর দেওয়া যায়।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, টেন মিনিট স্কুল