যাঁদের পরিচর্যার কেউ নেই, এমন অসুস্থ মানুষের যত্ন নেন রাফী
মানুষের সেবা করার ইচ্ছা থেকেই কেয়ারগিভার বা পরিচর্যাকারীর পেশা বেছে নিয়েছেন ঢাকার আব্দুল্লাহ রাফী। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের হয়ে বাড়িতে গিয়ে অসুস্থ মানুষের যত্ন নেন তিনি। কেয়ারগিভার রাফীর গল্প শুনেছেন সজীব মিয়া
কাকডাকা ভোরে শুরু হয় আমার দিন। পরিবারের অন্যরা যখন ঘুমিয়ে থাকে, আমি তখন কাজের জন্য তৈরি হই। তারপর নাশতা করে বনানী টিঅ্যান্ডটি কলোনির বাসা বের হয়ে পড়ি। ইদানীং আমার গন্তব্য ধানমন্ডির একটি বাড়ি।
ওই বাড়ির একজন আমার জন্য অপেক্ষা করেন। প্রতিদিন সকাল আটটার মধ্যে পৌঁছে যাই। আমি গেলে ৮০ ছুঁই ছুঁই মানুষটার সকাল শুরু হয়। তাঁকে বিছানা থেকে আলগোছে তুলে বাথরুমে নিয়ে যাই। সকালের জরুরি কাজ সারেন। তাঁর দাঁত ব্রাশ করিয়ে দিই। এরপর নিয়ে যাই নাশতার টেবিলে।
খাবারে তাঁর ভীষণ অরুচি, সহজে খেতে চান না। নানা কথা বলে বুঝিয়ে–সুঝিয়ে খাইয়ে দিই। তারপর দরকারি ওষুধ মুখে তুলে দিই। রক্তচাপ, রক্তে শর্করার পরিমাণসহ শারীরিক নানা তথ্য ঘণ্টায় ঘণ্টায় তাঁর দুজন ডাক্তারসহ পরিবারের সদস্যদের জানাতে হয়। এই কাজটাও আমাকেই করতে হয়। তাঁর স্ত্রী এ সময় পাশেই থাকেন। সত্তরোর্ধ্ব বয়সের কারণে তাঁরও শারীরিক অবস্থা সুবিধার নয়। তবু মনের জোরে নিজের কাজ নিজেই করেন।
সকালের সব কাজ শেষ করে মানুষটাকে নিয়ে তাঁর ঘরে আসি। দিনের পত্রিকা হাতে নিয়ে পড়ে শোনাই। বাইরে কোথায় কী হচ্ছে, যা আমি জানি, সেসবও তাঁকে বলি। এ ধরনের মানুষকে সেবা-শুশ্রূষা দেওয়াই আমার কাজ, আমার পেশা, আমি একজন কেয়ারগিভার।
তবে পরিচর্যাদানের কাজটি আমি মন থেকেই করি। গত চার বছরে এ রকম ১৫ জনকে সেবা দিয়েছি। অনেকে সুস্থ হয়ে যখন নিজে নিজে চলাফেরা করার শক্তি ফিরে পান, আমাকে বিদায় জানান, সেই দিনটির মতো সুন্দর দিন আমার জীবনে খুব কমই আসে।
প্রায় ৮০ বছর বয়সী মানুষটি ক্যানসারসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। তাঁর সন্তানেরা সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত, কেউ কেউ দেশের বাইরে থাকেন। সশরীর বাবার যত্ন নিতে পারেন না, কিন্তু প্রতিমুহূর্তে খোঁজটা ঠিকই রাখেন। এই সন্তানেরাই বছরের শুরুতে আমার প্রতিষ্ঠান হোম অ্যান্ড কমিউনিটি কেয়ার লিমিটেডের (এইচসিসিএল) সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাঁদের কাছ থেকেই দায়িত্ব পেয়েছিলাম। আট মাস আগের সেই দিনটার কথা এখনো মনে আছে। বাসায় ঢুকে দেখি, কেমোথেরাপি নিয়ে একদম শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে আছেন। কথা বলে বুঝতে পারলাম, বেশ রাগী গোছের মানুষ। নিজে যা বলবেন, সেটাই শেষ কথা। তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়াই। বেশ সময় নিয়ে আমার সাক্ষাৎকার নিলেন। আমার খুঁটিনাটি জানলেন। একসময় বুঝতে পারি, আমার কথাবার্তা ও সেবার মনোভাব তাঁর পছন্দ হয়েছে।
আমি অবশ্য ওনার সম্পর্কে সামান্য জেনেছিলাম সন্তানদের কাছে। সবকিছু বুঝে তাঁর সঙ্গে আমি দাদা-নাতির সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করেছি। দিনকে দিন আস্তে আস্তে সম্পর্কটা গড়ে তুলেছি। আমার দাদাকে যেভাবে শুশ্রূষা দিতাম, তাঁর সেবাও সেভাবেই করার চেষ্টা করেছি। এতেই কাজ হয়ে গেল। এখন আমার কথা মেনে চলেন।
প্রতিদিন সকালের নাশতা শেষে তিনি সাড়ে ১০টার দিকে ঘুমিয়ে পড়েন। এরপর তাঁর জেগে ওঠার অপেক্ষা করি। এ সময় নিজের কিছু কাজ থাকলে সেসব সারি। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তাঁকে গোসল করিয়ে দিই। ডাক্তারসহ তাঁর ছেলেদের কাছে রিপোর্ট পাঠাই। কোনো ওষুধ পরিবর্তন হলে টুকে রাখি। এভাবেই চলতে থাকে দিন—বিকেল, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়।
রাত আটটা পর্যন্ত আমার দায়িত্ব পালনের সময়। এই সময়টুকু তাঁর সঙ্গেই থাকি। প্রতিদিন বিদায়ের বেলায় লক্ষ করি, এ সময় তাঁর মন খারাপ হয়। তাই খুব ধীরে বলেন, ‘আইচ্ছা, যাও।’
মানুষের সেবা করতে চেয়েছি
এসএসসি পাসের পরই সাজেদা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠান হোম অ্যান্ড কমিউনিটি কেয়ার লিমিটেডের (এইচসিসিএল) খোঁজ পেয়েছিলাম। এক বন্ধু বলেছিল, এই প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ নিয়ে পরিচর্যাকারী হিসেবে পেশাগত জীবন শুরু করতে পারি। তথ্য পেয়েই এইচসিসিএলের সঙ্গে যোগাযোগ করি। আমাকে তিন দিনের প্রশিক্ষণে অংশ নিতে বলে তারা। প্রশিক্ষণ শেষে পরীক্ষা। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর শুরু হয় ১৫ দিনের অ্যাডভান্সড প্রশিক্ষণ।
রোগীর সঙ্গে কী রকম আচরণ করতে হবে, কীভাবে একজন অসুস্থ মানুষকে সামলাতে হবে, আরও কী কী সেবা একজন কেয়ারগিভারকে দিতে হয়—সবই সে সময় শেখানো হয়। ১৫ দিনের প্রশিক্ষণ শেষে আমাকে পাঠানো হয় সাজেদা ফাউন্ডেশনের একটি হাসপাতালে। সেখানে হাতে–কলমে কাজ করি কিছুদিন। অসুস্থ মানুষের পাশে থাকি, সেবা দিই।
এভাবেই আমার কেয়ারগিভার জীবনের সঙ্গে পরিচয়। তারপর একজন রোগীর বাড়িতে আমার সেবা দেওয়ার সুযোগ হলো। ধাপে ধাপে অনেক কিছু শিখলাম। এখন আমি প্রতিষ্ঠানের লেভেল-১ শ্রেণির কেয়ারগিভার। এটা বিভিন্ন পর্যায়ের আছে। সেবা দিয়ে আমার লেভেল উন্নতি করার চেষ্টা করছি।
বাসায় আমার মা-বাবা, স্ত্রী আর এক বছরের সন্তান আছে। দায়িত্ব পালন শেষে প্রতিদিন বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ১০টা বেজে যায়। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে খুব কম সময়ই কাটাতে পারি। এর মধ্যে আবার উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে পড়ছি। তবে এসব নিয়ে আমার আক্ষেপ নেই। নিজের মনের মতো একটা কাজ করতে পারছি, যাঁদের পরিচর্যার কেউ নেই, এমন মানুষকে সেবা দিচ্ছি ভেবে প্রতিদিন নতুন করে শক্তি খুঁজে পাই।