প্রকৃতির ক্যাম্পাসে প্রযুক্তির ছোঁয়া
গাজীপুরের সালনায়, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের দুপাশে চোখে পড়বে সারি সারি গাছ। এই গাছের ছায়া ধরে কিছুদূর এগোলেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেমুরকৃবি)। জেলা শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে জাতীয় উদ্যানের ভেতর ১৮৭ একর জমির ওপর গড়ে উঠেছে ক্যাম্পাস। ১৩ অক্টোবর সকালে ক্যাম্পাসে পা রেখে একটু অবাকই হতে হলো। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়টির কোথাও চোখে পড়ল না কোনো পোস্টার, ব্যানার। পরিচ্ছন্ন পিচঢালা রাস্তা ধরে এগোতেই দূর থেকে বরণ করে নিল বাহারি রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া।
ফ্যাকাল্টি অব ভেটেরিনারি মেডিসিন অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্স বিভাগের শিক্ষার্থী আনোয়ার হোসেনের কথার সঙ্গে একমত হতেই হলো। বলছিলেন, ‘আমাদের ক্যাম্পাস আমাদের স্বস্তির জায়গা। রাজনৈতিক অস্থিরতা নেই। হল ও ক্যাম্পাস—দুটোতেই পড়ার পরিবেশ আছে। হলে থাকতে কোনো সমস্যা হয় না। আর পুরো ক্যাম্পাসের পরিচ্ছন্নতা তো রীতিমতো রোল মডেল। কোথাও ময়লা-আবর্জনা দেখতে পাবেন না। এই পরিবেশটাই আমাদের সবচেয়ে প্রিয়।’
ক্যাম্পাসের কথা বলতে গিয়ে আনোয়ারের মতো যে শিক্ষার্থীদের মুখ ঝলমল করে, সিমাগো ইনস্টিটিউট র্যাঙ্কিং ২০২১ নিশ্চয়ই তাঁদের জন্য বড় একটা আনন্দের উপলক্ষ হয়ে এসেছে। এই প্রতিবেদন অনুযায়ী, গবেষণা, উদ্ভাবন ও সামাজিক অবস্থান—তিন সূচকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সেরার (প্রথম স্থান) স্বীকৃতি পেয়েছে।
১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বশেমুরকৃবি। শুরুতে নাম ছিল ইনস্টিটিউট অব পোস্টগ্র্যাজুয়েট স্টাডিজ ইন অ্যাগ্রিকালচার (ইপসা)। এটি ছিল বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএআরআই) একাডেমিক অংশ। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেও যুক্ততা ছিল। পরে এটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা লাভ করে। ১৯৯১ সালে কোর্সভিত্তিক এমএস এবং পিএইচডি প্রোগ্রাম শুরু হয়। বর্তমানে বশেমুরকৃবিতে আছে পাঁচটি অনুষদ—কৃষি, মৎস্য, ভেটেরিনারি মেডিসিন ও প্রাণিবিজ্ঞান এবং কৃষি অর্থনীতি ও গ্রামীণ উন্নয়ন।
যত অর্জন
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) মূল্যায়ন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। চুক্তির আওতায় আসা ৪৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মূল্যায়নে প্রথম হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। আর দ্বিতীয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে দেশে এপিএ ব্যবস্থা চালু হয়। এতে সরকারি দপ্তরগুলো কী কী করবে, তার কথা উল্লেখ থাকে। এরপর সেগুলো কতটুকু অর্জন হলো, তার ভিত্তিতে ১০০ নম্বরের মধ্যে মূল্যায়ন করা হয়। ইউজিসির সূত্রমতে, ৪৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে প্রথম হওয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ৯৯ দশমিক ৪৭ নম্বর পেয়েছে। দ্বিতীয় হওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাপ্ত নম্বর ৯৪
দশমিক ৪৮।
সিমাগো ইনস্টিটিউট র্যাঙ্কিং ২০২১-এ দেশসেরা হওয়াটাও বশেমুরকৃবির বড় অর্জন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৪১২৬টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে এ জরিপ করে স্পেনের সিমাগো-স্কোপাস। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ বিভাগ সূত্রে জানা গেল, জরিপে কৃষি ও জীববিজ্ঞান শাখায় বশেমুরকৃবি বিশ্বের ৪৭২তম, এশিয়া অঞ্চলে ২০৬তম এবং বাংলাদেশে প্রথম স্থান লাভ করেছে। অন্যদিকে জীব রসায়ন, জেনেটিকস ও মলিকুলার বায়োলজি শাখায় বিশ্ববিদ্যালয়টির অবস্থান বিশ্বে ৫৪১তম, এশিয়া অঞ্চলে ২৪৭তম এবং বাংলাদেশে প্রথম।
শালবন ঘেরা সবুজ ক্যাম্পাস
চারদিকে শালবন। ১৮৭ একরের ক্যাম্পাসে এক–চতুর্থাংশেরও বেশি জায়গাজুড়ে আছে গবেষণা খামার। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক (গবেষণা) এ কে এম আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘শুরু থেকেই আমরা গবেষণার ওপর জোর দিয়ে আসছি। কৃষকদের ফসলের উন্নত জাত এবং নতুন নতুন কৃষি প্রযুক্তি সরবরাহ করা ছিল আমাদের মূল লক্ষ্য। তারই ধারাবাহিকতায় এ পর্যন্ত ১০টি ফসলের ৫০টি জাত এবং ১৪টি কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছি আমরা। এসব জাত ও প্রযুক্তি আমরা কৃষকের হাতে পৌঁছে দিতে চাই।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি কন্ট্রোলার এ এইচ এম আসাদুর রহমান জানালেন, গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামের অধীনে বর্তমানে ১২টি বিষয়ে পিএইচডি ও ২৬টি বিষয়ে এমএস চালু আছে। সব মিলিয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ হাজার ৭৬৮। তাঁদের মধ্যে ৫৫ শতাংশ ছাত্রী আর ৪৫ শতাংশ ছাত্র। শিক্ষক আছেন ২১৭ জন।
ক্যাম্পাসের স্থাপনাগুলোর মধ্যে আলাদা করে বলতে হয় অত্যাবশ্যকীয় সেবাকেন্দ্রের কথা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আশপাশের বাজার যেহেতু বেশ দূরে, তাই এখানে আছে ব্যাংক সেবা, সঙ্গে দোকানপাট।
জিআইএস ও রিমোট সেন্সিং ল্যাব
আন্তর্জাতিক ভুট্টা, গম গবেষণা কেন্দ্র ও বশেমুরকৃবির যৌথ উদ্যোগে ২০১৫ সালে ক্যাম্পাসে প্রতিষ্ঠিত হয় জিআইএস ও রিমোট সেন্সিং ল্যাব। ল্যাবটিতে ১০জন স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থীর গবেষণার সুযোগ রয়েছে। এই ল্যাবে উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন ও সেন্সরযুক্ত ড্রোন রয়েছে, গবেষণায় যা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ‘মাল্টিস্পেকট্রাল’ ও ‘থার্মাল ইমেজিং’-এ সক্ষম ড্রোনগুলোর রয়েছে নানা ধরনের ব্যবহার। যেমন ফসলের খেতে কোথাও কোনো ঘাটতি (সার, সেচ) রয়েছে কি না, তা সহজে শনাক্ত করা। বীজ বপনের ক্ষেত্রে চারা গজানোর হার অথবা গাছের সংখ্যা ইমেজিংয়ের মাধ্যমে সহজেই নির্ণয় করা। ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি), কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ড্রোনের সমন্বয়ে কাজ করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষার্থীরা। লক্ষ্য—ডিজিটাল কৃষি বাস্তবায়নে ও চতুর্থ কৃষি বিপ্লবের জন্য মানবসম্পদ তৈরি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বনায়ন ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হাসান মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ বলেন, ‘অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা পরামর্শ বা গবেষণা সহায়তার জন্য শিক্ষকদের কাছে যেতে পারে না বা সেই সুযোগ থাকে না। আমরা আমাদের ছাত্রছাত্রীদের জন্য সব সময় আছি। যতটা সম্ভব ছেলেমেয়েদের সাহায্য করার চেষ্টা করি।’
মিউজিক ক্লাব
লেখাপড়ার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা নিয়মিতই আয়োজন করে নানা উৎসব, অনুষ্ঠান। এই সব অনুষ্ঠানে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয় মিউজিক ক্লাব। বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো সাংস্কৃতিক আয়োজন মাতিয়ে দেন ক্লাবের সদস্যরা। ক্যাম্পাসের টিএসসির সামনে, কখনো লেকভিউতে জমে আড্ডা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান জানান, লেখাপড়ার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক চর্চাও এই ক্যাম্পাসে বেশ গুরুত্ব পায়। বলছিলেন, ‘খুব বড় পরিসরে না হলেও আমরা আমাদের মতো করে একটা মিউজিক ক্লাব গড়ে তুলেছি। মেট্রোলাইফ নামে একটি ব্যান্ডও গঠন করা হয়েছে।’
ক্যাম্পাসে সুপারশপ
গাজীপুর শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে, রাজেন্দ্রপুর জাতীয় উদ্যানের ভেতরে, ক্যাম্পাসটির অবস্থান হওয়ায় আশপাশে দোকানপাট বা বাজার নেই। কোনো কিছু কেনাকাটা করতে হলে যেতে হয় অনেক দূরে। তাই ক্যাম্পাসের ভেতরেই গড়ে তোলা হয়েছে একটি সুপারশপ। সুপারশপে মিলবে প্রায় সাড়ে চার হাজারের বেশি পণ্য। জানা গেল, সুপারশপের জন্য প্রায় ৬০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। সুপারশপটির উদ্যোক্তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় চাকরিজীবী সমবায় সমিতি (বেকস)।
সমিতির সাধারণ সম্পাদক নাহারুল ইসলাম বলেন, ‘মাত্র ৫-৬ শতাংশ লাভে এখানে মালামাল বিক্রি করা হয়। অবশ্যই বাইরের দোকান বা সুপারশপের চেয়ে কম দামে। লাভের অংশ থেকে ছয়জন কর্মচারী ও একজন ম্যানেজারের বেতনসহ অন্যান্য খরচ মেটানো হয়।’
শতভাগ আবাসিক
শুরু থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়টি শতভাগ আবাসিক হিসেবে পরিচালিত হয়ে আসছে। হলের আসন পেতে কোনো তদবিরের প্রয়োজন হয় না। ভর্তির শুরুর দিকে আসনের কিছুটা অভাব হলেও কয়েক মাসের মধ্যে সমস্যা মিটে যায়। আর এরই মধ্যে নতুন আরও হল তৈরির কাজ চলছে।
শহীদ আহসানউল্লাহ মাষ্টার হলের বাসিন্দা সাকিব ইবনে ওবায়ের বলেন, ‘যখন ভর্তি হয়েছি, তখনই একটি লকার, হলের রুমের চাবিসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। র্যাগিং শব্দটা শুনেছি, কিন্তু আমাদের ক্যাম্পাসে কখনো দেখিনি।’
বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্তর্জাতিক মানে গড়ে তোলা হবে
গিয়াসউদ্দীন মিয়া
উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় একটি গবেষণাভিত্তিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ পর্যন্ত ৩৩৬ জনকে আমরা পিএইচডি দিয়েছি। ২ হাজার ৩০৫ জনকে এমএস ডিগ্রি দিয়েছি। ১ হাজার ৮৬০ জনকে স্নাতক ডিগ্রি দিয়েছি। কৃষি ক্ষেত্রে আমরা যেমন দক্ষ মানবশক্তি তৈরি করছি; তেমনি ধান, তৈলবীজ (সয়াবিন), ফলমূলসহ বিভিন্ন ফসলের ৬৮টি জাত উদ্ভাবন করেছি, যা আমরা প্রযুক্তি বই আকারে প্রকাশ করেছি। বইগুলো বাংলাদেশের কৃষির বিভিন্ন অধিদপ্তর ও কৃষকদের মধ্যে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছি।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়টির মান আমরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত করতে চাই। এরই মধ্যে আমাদের ৫৭ জন শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য ভিনদেশে গেছে। আরও অনেক ছাত্রছাত্রী ভর্তির আবেদন করছে।
কানাডার ইউনিভার্সিটি অব সাসক্যাচুয়ানের সঙ্গে যৌথ/ডুয়েল ডিগ্রি ও গবেষণার জন্য সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর ফলে আমাদের আগ্রহী শিক্ষার্থীরা কানাডায় গিয়ে পড়তে পারবে। আমরা তাদের দুটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যৌথ ডিগ্রি দেব; ফলে দুই জায়গা থেকেই তারা সনদ পাবে। এটি একটি আন্তর্জাতিক মানের ডিগ্রি হবে।