তাঁর দৃষ্টিই বলে দিচ্ছিল, নিশ্চয়ই ভাবছেন, ‘গাধাটা করছে কী!’
তাঁর বাস্তব জীবনও অনেকটা থ্রি ইডিয়টস ছবির সেই ‘ফারহান’ চরিত্রের মতো। প্রকৌশলী হয়েও ভিন্ন খাতে ক্যারিয়ার গড়েছেন আর মাধবন। বক্তৃতাও করেন দারুণ। ইন্ডিয়ান স্কুল অব বিজনেসের লিডারশিপ সামিট ২০২২ -এও চমৎকার কিছু কথা বললেন এই বলিউড তারকা। পড়ুন নির্বাচিত অংশের অনুবাদ।
যত দূর মনে পড়ে, চলচ্চিত্রশিল্পে পা রাখার ইচ্ছাটা প্রথম দানা বেঁধেছিল ৭ কি ৮ বছর বয়সে। সে সময় শিল্পপতি রতন টাটা কিংবা ক্রিকেটার রুসি মোডিকে দেখতাম, তাঁরা কোনো হলরুমে পা রাখলেই সবগুলো চোখ ঘুরে যেত তাঁদের দিকে। স্পষ্ট মনে পড়ে, ছোটবেলায় আমার প্রথম অভিলাষ ছিল এটাই—কোথাও গেলে সবার চোখ যেন আমার দিকে থাকে। স্রেফ একঝলক তাকালেও চলবে!
আরেকটা ঘটনা বেড়ে ওঠার সময়ে বড় প্রভাব ফেলেছিল। রোটারির পক্ষ থেকে ‘এক্সচেঞ্জ স্টুডেন্ট (বিনিময় কর্মসূচির ছাত্র)’ হিসেবে একবার কানাডা যাওয়ার সুযোগ হলো। ছিলাম স্টেটলার নামের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে। কাউবয়দের সঙ্গে। আমি নিরামিষভোজী। অথচ এমন এক পরিবারের সঙ্গে থাকার ব্যবস্থা হলো, গরু জবাই করা যাঁদের জীবিকারই অংশ।
এর চেয়ে বড় ধাক্কা খেলাম বাস্কেটবল খেলতে গিয়ে। সে সময় বাস্কেটবল দলে সুযোগ পাওয়া ছিল বিরাট ব্যাপার। আমি তো অত লম্বাও ছিলাম না। সম্ভবত একরকম অনুগ্রহ করেই ওরা আমাকে দলে নিয়েছিল। একবার পাশের শহরে ম্যাচ খেলতে গেছি। ম্যাচ শেষে সবাই একসঙ্গে গোসল করা ওদের ওখানে খুব স্বাভাবিক ছিল। ছেলেদের গোসলখানাটা কেমন, সেটা একটু বলা দরকার। ধরুন একটা খাম্বা, তার চারদিকে ছয়টা ঝরনা। সবাই গোল হয়ে গোসল করে। আর গোসলের সময় পরনে কিছুই থাকে না।
অবস্থা এমন দাঁড়াল, খেলার চেয়ে গোসলটাই আমার জন্য বড় দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে উঠল। দক্ষিণ ভারতীয় পরিবারে অন্যের সামনে খালি গায়ে দাঁড়াতেও আমরা অভ্যস্ত নই। সেখানে এত মানুষের সামনে নগ্ন হয়ে গোসল করার তো প্রশ্নই ওঠে না। বাধ্য হয়ে জাঙ্গিয়া পরে গোসলখানায় হাজির হতে শুরু করলাম। মুশকিল হলো, গোসলখানায় ঢুকলে ওরা এমনভাবে তাকাত, যেন আমিই নগ্ন! কারণ, ওখানে তো কেউ কারও প্রতি ভ্রুক্ষেপও করে না। আমাকে দেখে বোধ হয় এরা ভাবত, এই ছেলে এমন কী লুকিয়ে রেখেছে! (হাসি)
টুর্নামেন্ট চলল সাত দিন। প্রতিদিনই ভাবতাম, নাহ, কাল থেকে ওদের মতো হয়ে যাব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই জাঙ্গিয়া পরেই হাজির হতাম। এভাবে তিন দিন পেরোনোর পর মেনে নিলাম—আমি তো আসলে ওদের মতো নই। আমি আমার মতো থাকতে চাই। অতএব টানা সাত দিন এভাবেই চললাম।
সেই সময়ই শিখেছিলাম, তোমার সহজাত প্রবৃত্তি যদি বলে—কোনো একটা কাজ তোমার জন্য অস্বস্তিকর, কোনো একটা চলতি ধারা তোমার সঙ্গে যায় না, তাহলে তুমি যেমন আছ তেমনভাবেই নিজেকে মানিয়ে নাও। চলচ্চিত্রের জগতে ঢোকার জন্য এই বৈশিষ্ট্যটা খুব জরুরি।
আমাকে সিনেমার দুনিয়ায় এনেছিলেন মণি রত্নম। সে সময় সবুজ প্যান্ট আর কমলা রঙের শার্ট পরে নাচের চল ছিল। হ্যাঁ, সেটাও আমি করেছি। সুইজারল্যান্ডের এক মনোরম লোকেশনে। সামনেই একটা কফির দোকান। সেখানে এক কৃষক বসে কফি খাচ্ছিলেন। তাঁর দৃষ্টিই বলে দিচ্ছিল, নিশ্চয়ই ভাবছেন, ‘গাধাটা করছে কী!’
তাঁর বিরক্তি স্পষ্ট ছিল। হবে না-ই বা কেন। কোরিওগ্রাফার তখন চিৎকার করে বলছেন, ‘ফাইভ, সিক্স, সেভেন, এইট…।’ ওদিকে আমি তাল মিলিয়ে কোমর দোলাচ্ছি, হাত-পা নাচাচ্ছি। ইচ্ছা করছিল কৃষক ব্যাটাকে গিয়ে বলি, ‘একবার আমার সঙ্গে চেন্নাই চলো। বুঝবে আমি কী!’
কিন্তু এই অভিজ্ঞতাই আমার মনোজগতে বড় পরিবর্তন এনে দিল। নিজেই নিজেকে বললাম, ‘এসব কী করছ ম্যাডি! তুমি ইলেকট্রনিকসে স্নাতক করেছ। প্লেন ওড়াতে জানো। গণযোগাযোগের ওপর তোমার ডিগ্রি আছে। তুমি বাইকার। রাজ্যের হয়ে বাস্কেটবল খেলেছ। অথচ এসব অভিজ্ঞতার কোনোটাই তুমি কাজে লাগাচ্ছ না! তুমি কিনা সবুজ প্যান্ট আর কমলা শার্ট পরে হাত-পা ছুড়ছ!’
সেই সময়ই সিদ্ধান্ত নিলাম, আমার সঙ্গে যেটা যায় না, সেটা করব না। নাচানাচি করে মানুষকে বিনোদিত করা আমার কম্ম নয়। এটা ‘আমি’ নই। অতএব জাঙ্গিয়াটা পরে নেওয়াই উত্তম!
হ্যাঁ, এরপর ইন্ডাস্ট্রিতে নিজের জায়গা করে নিতে একটু সময় লেগেছে। সাহস করতে হয়েছে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বুঝেছি, আমি কী করতে পারি। আমার মেধাটা আসলে কিসে। অনেকে বলেছিল চোখের আড়াল মানেই মনের আড়াল। কিন্তু আমি সেসব মাথায় নিইনি। সহজাত প্রবৃত্তির ওপরই ভরসা রেখেছি। (সংক্ষেপিত)
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মো. সাইফুল্লাহ