প্রতিটি ভুল নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করতে সাহায্য করে

মাত্র ১১ বছর বয়সেই অভিনয়জগতে পা ফেলেন। আর এখন গান দিয়ে বিশ্বময় গড়ে তুলেছেন বিরাট এক শ্রোতাকুল। ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম রিলস অথবা ইউটিউব শর্টসে গেলেই শোনা যায় তাঁর ‘প্লিজ প্লিজ প্লিজ’ অথবা ‘এসপ্রেসো’। মাত্র ২৫ বছর বয়সে টাইম সাময়িকীর প্রভাবশালী তালিকা থেকে শুরু করে গ্র্যামির মঞ্চ—সবখানেই আলোড়ন তুলেছেন সাবরিনা কার্পেন্টার। আজ অনুপ্রেরণায় থাকছে তাঁর কথা।

সাবরিনা কার্পেন্টার
ছবি: রয়টার্স

ছোটবেলা থেকেই একটা কথা আমি প্রায়ই শুনতাম। মা আমাকে ডাকতেন ‘কচ্ছপ’। ‘কচ্ছপ ও খরগোশ’-এর গল্পের সেই কচ্ছপ! কিছু হলেই বারবার করে মা মনে করিয়ে দিতেন, ‘সাবরিনা, অস্থির হয়ো না। তুমি কচ্ছপ। কচ্ছপের মতো হও। সব ঠিক হয়ে যাবে।’ তখন খুব বিরক্ত লাগত। কেন আমাকে ধীর আর স্থির হতে বলছে! কিন্তু বয়স যত বাড়তে থাকল, আমিও বুঝতে থাকলাম কচ্ছপ হওয়া আদতে খারাপ কিছু না। অনিশ্চিত সময়, হতাশার সময়, অথবা খারাপ সময়ে আমরা ভেঙে পড়ি, অস্থির হয়ে উঠি। কিন্তু খারাপ সময়গুলোয় স্থির থাকা, সেই সময় ও পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নেওয়া—আমাদের বড় হতে শেখায়। তাই সেই ছেলেবেলা থেকেই আমি কচ্ছপ হতে শিখছি, স্থির থাকতে শিখছি। সামনের দিনগুলোতেও এভাবেই শিখতে চাই, ধীরে ধীরে বড় হতে চাই।

আর এ জন্যই যখন যে কাজটি করি, ধীরস্থিরভাবে নিজের ওপর কোনো জোর না দিয়ে করতে চেষ্টা করি। তাই যখন যে কাজটা আমাকে টানে, তখন শুধু সেটাতেই নিজের পুরোটা ঢেলে দিই, সেটার দিকে ছুটি। অযথা অনেক দিকে মনোযোগ দিয়ে নিজেকে চাপে ফেলার পক্ষে আমি নই। 

ভুল থেকে ভালো

প্রতিটি ভুল আমাদের নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করতে সাহায্য করে। ভেবে দেখুন, ১৩ বছর বয়সে আমি যদি বিচ্ছিরি দেখতে পোশাক না পরতাম, তাহলে হয়তো কোন পোশাকে আমাকে সেরা দেখাবে, আত্মবিশ্বাসী দেখাবে, তা বুঝতাম না। অতীতের ভুলের কারণেই আমি আজকের ‘আমি’ হতে পেরেছি। পেছনে তাকিয়ে ভুলগুলোর কথা মনে করে বলতে পারি, ‘হ্যাঁ, আমি বদলে গেছি।’ এই উপলব্ধি আমাকে ভীষণ তৃপ্ত করে।

মাত্র ১১ বছর বয়সেই অভিনয়জগতে পা রাখেন সাবরিনা কার্পেন্টার
ছবি: রয়টার্স

গান গাওয়ার কারণে ছেলেবেলায় যথেষ্ট উপহাসের শিকার হতাম। অল্প বয়স থেকেই আমার স্বপ্নগুলো অনেক বড় ছিল। তাই স্কুলে পড়াশোনায় ভালো করলেও উপহাসের কারণে স্কুল ছাড়তে হয়েছিল। শুরু করতে হয়েছিল হোম স্কুলিং (বাড়ি থেকে পড়াশোনা)। হোম স্কুলিংয়েই নিজেকে অনেক সুরক্ষিত লাগত। যেহেতু গতানুগতিক রীতিতে আমার বেড়ে ওঠা হয়নি, যেহেতু কম বয়সেই কাজের মধ্যে ঢুকে ব্যস্ত হয়ে পড়ি, তাই স্বাভাবিক জীবনের অনেক স্মৃতিই আমার নেই। এসব নিয়ে কোনো আক্ষেপও আমার নেই।

ছোটবেলায় অনেকে আমাকে দেখে মায়া করত। তাদের ধারণা ছিল, আমি বুঝি মা-বাবার স্বপ্নপূরণের জন্য ছোটবেলা থেকেই কাজ করি। ১১ বছর থেকে আমি মানুষকে বুঝিয়ে আসছি, গান-অভিনয় আমি মা-বাবার জন্য নয়, নিজের জন্য করি।

ছোট থেকে বড় হওয়া

শিশুশিল্পী থেকে বড় হওয়া খুব সহজ কোনো কাজ নয়। মানুষ যাকে শিশুশিল্পী হিসেবে একবার গ্রহণ করে, তাকে হঠাৎ বড় হয়ে যেতে দেখলে ভালোভাবে নিতে পারে না। আমার বেলায়ও ব্যতিক্রম হয়নি। ছোট থেকে বড় হওয়ার যাত্রা আমার জন্যও বেশ কঠিন ছিল। তবে এ-যাত্রায়ও আমি কোনো তাড়াহুড়ো করিনি। যেমনটা শুরুতেই বলেছিলাম, আমি কচ্ছপ। পথটা কঠিন হবে বলে যে অস্থির হয়ে যেনতেনভাবে হুড়োহুড়ি করে পার করে যাওয়ার চেষ্টা করব, তা কিন্তু না। বড় হওয়ার এ-যাত্রায় আমার কাছে যখন যেটা উপযুক্ত হয়েছে, তখন তা-ই করেছি, ধীরেসুস্থে করেছি, সময় নিয়ে করেছি। আর এ সময় নিয়ে বড় হওয়ার কারণেই বেড়ে ওঠার যাত্রাটা আমি উপভোগ করতে পেরেছি।

মাত্র ২৫ বছর বয়সে টাইম সাময়িকীর প্রভাবশালী তালিকায় জায়গা পান সাবরিনা কার্পেন্টার
ছবি: উইকিপিডিয়া

ছেলেবেলার আমিকে যা বলতাম

বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা আত্মসচেতন হতে শুরু করি। ছোট বয়সে বাছবিচার করার ক্ষমতাও কম থাকে। ওই বয়সে আমাদের মনে চলতে থাকে, ‘জীবন তো আনন্দময়। সবকিছু দিব্যি চলছে। কী আর হবে!’ কিন্তু সুযোগ পেলে সেই ছেলেবেলার ‘আমি’কে বলব, ‘আরেকটু বিচক্ষণ হও। চারপাশের মানুষদের ব্যাপারে আরেকটু সচেতন হও। সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব হতে হবে, এটা জরুরি না। সব সময় সব মানুষের মন রক্ষা করে চলারও অত প্রয়োজন নেই।’ আমরা যত যা-ই করি না, পৃথিবীতে কিছু মানুষ থাকবে, যাদের মন আমরা কখনোই পাব না। কিন্তু অল্প বয়সে এই উপলব্ধিটাই আমাদের ভেতর আসে না। আমরা বাছবিচার ছাড়াই সবার বন্ধু হওয়ার চেষ্টা করি। দিন শেষে সেই ব্যর্থ চেষ্টা আমাদের মনে আঘাতের দাগ ফেলে যায়। সুযোগ পেলে আমি ছেলেবেলার ‘আমি’কে সেই আঘাত থেকেই বাঁচাতে চাইতাম। 

প্রত্যাখ্যানই নতুন পথনির্দেশনা

বিচক্ষণ হওয়াটা যে কতটা জরুরি, এই শিক্ষা আমি জীবনের প্রতিটা ধাপে উপলব্ধি করতে পারি। আমি চাই সবারই এই উপলব্ধি হোক। সবাই নিজের মনের কথাকে গুরুত্ব দেওয়া শুরু করুক। একটা কথা আছে—‘প্রত্যাখ্যানই নতুন পথনির্দেশনা’। একটা সময় ছিল যখন এই কথা আমার বড্ড ‘সেকেলে’ লাগত। তবে এখন বুঝি, এটা আসলে সব সময়ই প্রাসঙ্গিক এবং সত্য। প্রতিটি ব্যর্থতাই আমাকে আরেকটা নতুন চেষ্টার দিকে নিয়ে গেছে, সাফল্যের দিকে নিয়ে গেছে। প্রত্যাখ্যান মানেই পথনির্দেশনা—এই বিশ্বাস মন্ত্রের মতো আমাদের মনে ধারণ করে রাখতে হবে।

 সূত্র: ভ্যারাইটি, গ্ল্যামার ইউকে, ইন্টারভিউ ম্যাগাজিন