মেসির সঙ্গে দেখা করার জন্য কত কী–ই না করেছেন মেহেদী
মাঠের বাইরে কাছ থেকে লিওনেল মেসিকে একনজর দেখতে কত কী–ই না করেছেন মেহেদী জামান। বাংলাদেশ থেকে ছুটে গেছেন স্পেন, বার্সেলোনায় প্রিয় খেলোয়াড়ের বাড়ির সামনে বসে থেকেছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অবশেষে পূরণ হয়েছে তাঁর স্বপ্ন। ১৯ অক্টোবর সেলফি তোলার পাশাপাশি আর্জেন্টাইন মহাতারকার অটোগ্রাফও পেয়েছেন। এই পাঁড় মেসিভক্তের কাছ থেকে শুনে অনুলিখন করলেন মো. জান্নাতুল নাঈম
২০০০ সালের কথা। সবে চতুর্থ শ্রেণিতে উঠেছি। আমাকে একটা কম্পিউটার কিনে দিলেন আব্বু। ওই বয়সে যন্ত্রটার কাজ খুব একটা বুঝতাম না। কিন্তু জানতাম, আমার কম্পিউটারে ফুটবলের একটা গেম আছে। নাম ‘ফিফা ৯৮’। অবসরে এই গেম খেলতাম। আর্জেন্টিনা দল তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্বাচন করা থাকত, তাই এই দল নিয়েই খেলা হতো। খেলতে গিয়ে দেখলাম, গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা নামের এক খেলোয়াড়কে দিয়ে সহজেই গোল করা যায়। সেখান থেকেই আর্জেন্টিনা ও বাতিস্তুতার সঙ্গে পরিচয়। পরে ২০০২ সালে বিশ্বকাপে টিভিতে এই কিংবদন্তির খেলা দেখে মুগ্ধ হয়েছি। মন খারাপও হয়েছিল, কারণ সেটাই ছিল তাঁর শেষ বিশ্বকাপ।
বাসায় মা-বাবার রুমে ছিল টেলিভিশন। তাই নিয়মিত খেলা দেখার সুযোগ ছিল না। ফুটবল বিশ্বকাপ এলেই কেবল সবাই মিলে হইহুল্লোড় করে খেলা দেখা হতো। ২০০৬ বিশ্বকাপে আবারও প্রিয় দল আর্জেন্টিনাকে সমর্থন করি। তখন জানতে পারি, মেসি নামের একজন বিস্ময়বালক এই দলে যোগ দিয়েছেন। সেবার মাত্র এক ম্যাচ খেললেও মনে ধরেছিল তাঁর খেলার ধরন।
২০০৭ সালে মাঝমাঠ থেকে বল নিয়ে ৬ জন খেলোয়াড়কে কাটিয়ে এক অবিশ্বাস্য গোল করেন মেসি। সেই প্রথম জানলাম, বার্সেলোনায় খেলেন মেসি। এর আগে বার্সেলোনা মানে শুধু রোনালদিনহোকে চিনতাম। এভাবেই বিশ্বকাপের বাইরেও নিয়মিত ক্লাব ফুটবল দেখা শুরু করি। দিনে দিনে মেসি, বার্সেলোনা ও আর্জেন্টিনারও পাঁড়ভক্ত হয়ে যাই।
২০১১ সালে ঢাকায় মেসিরা এলেও নানা কারণে সেটা মিস করি।
২০১৫ সালে শেষ হয় আমার বিশ্ববিদ্যালয়জীবন। সে বছরই একটি সম্মেলনে অংশ নিতে ফ্রান্সে গিয়েছিলাম। পরে প্যারিস থেকে খেলা দেখতে চলে যাই স্পেনের বার্সেলোনা। ভক্ত হিসেবে মাঠের বাইরেও লিওনেল মেসিকে দেখার প্রবল ইচ্ছা ছিল। কিন্তু কীভাবে যে দেখা যায়, ধারণা ছিল না। তাই ক্যাম্প ন্যুতে ঘুরলেও মেসির ঠিকানা সংগ্রহ করতে পারিনি।
আস্তে আস্তে পারিবারিক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাই। ২০১৭ সালে বিয়ে করি। বিয়েতে এত এত মানুষ থাকবে আর মেসি থাকবে না! তাই মেসি আর তাঁর স্ত্রীর ছবির কাটআউট বানিয়ে আয়োজনে রেখেছিলাম। এই পাগলামো দেখে অনেকে তখন হাসাহাসি করেছে।
২০২০ সালের দিকে আবার স্পেনে যাই। হাতে এবার মেসির ঠিকানা। গেলাম তাঁর বাড়ির সামনে। অপেক্ষা করলাম প্রায় পাঁচ ঘণ্টা। কে জানে তিনি হয়তো বাড়িতে ছিলেন না। তাই দেখার ইচ্ছাও পূরণ হলো না।
মেসির দেখা না পেলেও বার্সেলোনার প্রতি ভালোবাসা থেকে আমি ফুটবল ক্লাবটির সদস্য হয়েছি। এখন ক্লাবের নির্বাচনে ভোট দিতে পারি, বিভিন্ন সিদ্ধান্তে অংশগ্রহণেরও সুযোগ থাকে।
২০২২ বিশ্বকাপে মেসিকে একঝলক দেখতে কাতার গিয়েছি। মন ভরে উপভোগ করেছি আর্জেন্টিনার ম্যাচ। জানতাম, এত বড় আসরে মেসির সঙ্গে দেখা হওয়া সহজ নয়। স্বাভাবিক কারণেই নিরাপত্তার জালে বন্দী থাকবে। কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন। স্টেডিয়ামে বসেই মেসির স্ত্রী আন্তোনেলা রোকুজ্জোর সঙ্গে সেলফি তোলার সুযোগ হলো। হাতের ইশারায় ‘হ্যালো’ বিনিময় করেছে মেসির ছেলে থিয়াগোও।
মা বললেন, দেখা পাবে
৮ অক্টোবর স্ত্রী-সন্তান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছাই। ফেরার সময় হিসাব-নিকাশ করে দেখি, হাতে মেসির একটা ম্যাচ দেখার সুযোগ আছে। ইন্টার মায়ামির ঘরের মাঠে খেলা। প্লে–অফের আগে শেষ ম্যাচ হওয়ায় মেসির খেলার সম্ভাবনা ছিল। আবার ইন্টার মায়ামি পয়েন্ট তালিকার শীর্ষে থাকায় মেসিকে বিশ্রাম দেওয়াটাও অসম্ভব না। এসব অনিশ্চয়তা মাথায় রেখেই টিকিট কাটি। এখন মেসির ঠিকানা জানা দরকার। ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করলাম। বাসার ঠিকানা পাওয়ার পর দেখা পাওয়ার আশা বাড়তে থাকে। নিউইয়র্ক থেকে ক্যালিফোর্নিয়ায় গিয়ে স্ত্রী-কন্যাকে ফুফির বাসায় রেখে ওই দিন রাতেই মায়ামির বিমান ধরি। সঙ্গে বউ-বাচ্চা থাকলে এত সময় ধরে ও ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করে মেসির সঙ্গে দেখা হওয়ার পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে পারে, তাই এই ব্যবস্থা।
১৮ অক্টোবরই মেসির বাড়ির সামনে যাই। টানা পাঁচ ঘণ্টার মতো অপেক্ষা করি। মেসিকে দূর থেকে দুবার দেখলেও ছবি তোলার সুযোগ হয়নি। পরের দিন সকালে আবারও যাই। এবারও দূর থেকে দেখা মিলেছে। একটু পর ওখানে বসে খাবার খেতে খেতে ভিডিও কলে মাকে বললাম, ‘মা, দেখা তো হয় না।’
মা বললেন, ‘যাও দোয়া করে দিলাম। দেখা পাবে।’
মেসি যেন খেয়াল করেন, এ জন্য আর্জেন্টিনার জার্সি পরেছিলাম। কাঁধে ছিল হলুদ ব্যাগ। অবশেষে মায়ের দোয়ায় কাজ হলো। ওই দিন দুপুরে মেসির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। খেয়াল করে আমার কাছে এসে গাড়ি থামালেন মেসি। গাড়ির গ্লাস নিচে নামিয়ে আমার সঙ্গে কথা বললেন। মেসির সঙ্গে সেলফি তুললাম। জার্সিতে অটোগ্রাফ দিলেন। এত দিনের অপেক্ষার পর মেসির সঙ্গে দেখা হওয়ার আনন্দ যেন বাঁধ মানছিল না। মেসি সেটা দেখে হাসলেন। পাগল ভক্তের কাণ্ড দেখে হয়তো খুশিও হলেন।
মেসির পাশে বার্সেলোনার আরেক কিংবদন্তি লুইস সুয়ারেজও ছিলেন। মেসিতে মগ্ন হয়ে থাকায় তাঁর সঙ্গে আর ছবি তোলা হয়নি!
সেদিনই ইন্টার মায়ামির খেলা ছিল। আমি শেষের দিকে টিকিট কেটেছি। তাই ভালো সিট পাওয়ার সুযোগ ছিল না। কিন্তু ভাগ্য ভালো, যে গোলপোস্টের পেছনে ছিলাম, মেসির তিনটা গোলই ওই দিক দিয়েই হয়েছে। ফলে চোখের সামনে একদম পরিষ্কারভাবে মেসির তিনটা গোল দেওয়া দেখেছি। এটা অবিশ্বাস্য অনুভূতি ছিল। কারণ, উনি প্রথম একাদশে ছিলেন না। তাই মন খারাপ করে ভাবছিলাম যে মেসি না–ও নামতে পারে। শুধু নামলেনই না, শেষ পর্যন্ত হ্যাটট্রিকও করলেন।