ঘর সাজাবেন কোন রঙে
ঘরের অন্দরের রং কী হবে, সেটা অনেক কিছুর ওপর নির্ভরশীল। এই যেমন ঘরের আসবাব, লাইট থেকে শুরু করে বাসিন্দাদের মেজাজ–মর্জি। পুরো ঘরে একই রং ব্যবহার না করে নানা ধরনের থিম ব্যবহার করতে দেখা যায় আজকাল। কেউ কেউ দেয়ালে চিত্রকর্মও করান। ঘরের অন্দরে কোন রং ব্যবহার করবেন,
বেশ কিছুদিন আগে ফটোশুটের জন্য গিয়েছিলাম নারায়ণগঞ্জের একটি বাসায়। খুব সাদাসিধে আসবাব আর অনুষঙ্গে সাজানো বাসাটির মূল আকর্ষণ ছিল দেয়ালের রং। ঘরে যে বিশেষ কোনো রং ব্যবহার করা হয়েছে, তা কিন্তু নয়। পুরো বাসার দেয়ালজুড়েই ছিল সাদার প্রাধান্য। তবে ভিন্ন ভিন্ন রঙের পর্দার ব্যবহার করে, তার ভেতর দিয়ে দিনের আলো দেয়ালে প্রতিফলিত করে ঘরে আনা হয়েছে নতুন এক আবহ। যেমন একটি ঘরের জানালায় ব্যবহার করা হয়েছে হলুদ পর্দা। এই পর্দার ভেতর দিয়ে বাইরের আলো দেয়ালে প্রতিফলিত হয়ে ঘরটা হয়ে গেছে হলদেটে। একইভাবে গোলাপি পর্দার ব্যবহারে ঘরে এসেছে গোলাপি আভা।
নানাভাবে দেয়াল রাঙানো এখন অন্দরসজ্জার এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কখনো এক রঙের ব্যবহারে, কখনো মোটিফ ধরে ঘরের দেয়াল রাঙানো হচ্ছে। আবার ওপরে বর্ণিত পর্দার মতো অনুষঙ্গে আলোর প্রতিফলন ঘটিয়েও দেয়ালের রং পাচ্ছে নতুন ভাষা।
ফেসবুকের জনপ্রিয় ঘর সাজানোর পেজ ‘ডেকোর আপা: অন আ বাজেট’–এর স্বত্বাধিকারী নাজিয়া নাফ বলেন, ‘আপনার ঘরের আয়তন কেমন দেখাবে, তা কিন্তু নির্ভর করে দেয়ালের রঙের ওপর।’ ঘর বড় দেখাতে অনেকেই পুরোটাজুড়ে সাদা রং ব্যবহার করেন। নাজিয়া নাফের মতে, এই ভাবনা একেবারেই ঠিক নয়। পরিবর্তে দেয়ালে ব্যবহার করতে পারেন হালকা সাদা বা ক্রিম রং। চাইলে প্যাস্টেল রঙের ব্যবহারও করতে পারেন। হালকা গোলাপি, হালকা টিয়া–সবুজ—এসব রঙের ব্যবহার ঘরের পরিবেশকে শান্ত করে তুলতে সাহায্য করে।
ডেকোর আপা নামে পরিচিত নাজিয়া নাফের ঘর সাজানোর ভিডিওগুলোতে দেখা যায়, তার ঘরজুড়েও এসব রঙের প্রাধান্য। জানালেন, সম্প্রতি তাঁর শোবার ঘরের দেয়াল পুনরায় রাঙিয়েছেন। ঘরের তিনটা দেয়ালে ছিল হালকা সাদার প্রাধান্য। একটা দেয়াল রাঙিয়েছেন মভ কালারে। সেই দেয়ালে প্রাণবন্ত আবহ আনতে কালার ব্লক করেছেন। নিজে পেনসিল দিয়ে দেয়ালজুড়ে এঁকেছেন বৃত্ত। বৃত্তগুলোর বাইরের চারদিকে স্কচটেপ পেঁচিয়ে নিয়েছেন, যাতে রং বাইরে না যায়। এরপর বৃত্তগুলোর ভেতর পছন্দের রঙের ব্যবহার করে রাঙিয়েছেন ঘরের দেয়াল।
নিজের ঘর নিজেই রাঙাই
আজকাল দেখা যাচ্ছে, ফ্ল্যাটের দেয়াল রাঙাতে অনেকে রংমিস্ত্রি বা অন্দরসজ্জাবিদের ওপর নির্ভর না করে নিজেরাই হাতে তুলে নিচ্ছেন রঙের ডিব্বা, ইচ্ছেমতো রাঙিয়ে নিচ্ছেন নিজের ঘর। নিজের ঘরটা কখনো যাতে একঘেয়ে হয়ে না ওঠে, তার জন্য কিছুদিন পরপরই বাসার দেয়ালের রঙে পরিবর্তন আনেন কস্টিউম ডিজাইনার জাকিয়া উর্মি। সব সময় তো আর রংমিস্ত্রির শরণ নেওয়া সম্ভব নয়। খরচ তো একটা বিষয়, সময় মেলানোটাও কঠিন। নিজের অবসর সময়ে নিজেই তাই ঘরের দেয়াল রাঙান।
রাজধানীর নিকেতনে একটি ভাড়া বাসায় থাকেন উর্মি। প্রথম দিকে এই বাসার দেয়ালগুলো ছিল একেবারেই ‘ম্যাড়মেড়ে’। যেভাবেই ঘরগুলোকে সাজাতে চাইতেন, দেয়ালের এহেন রং শক্ত বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। একপর্যায়ে হার্ডওয়্যারের দোকান থেকে প্লাস্টিক পেইন্ট কিনে নিয়ে পরিমাণমতো পানি মিশিয়ে উর্মি নিজেই রাঙিয়ে নিলেন ঘরের দেয়াল। দুই রুমের ফ্ল্যাট বাসা পুরোপুরি রাঙাতে দুই হাজার থেকে তিন হাজার টাকার রং কিনলেই হয়ে যাবে, জানালেন তিনি।
নিজেই যদি নিজের বাসার দেয়াল রাঙাতে চান, তবে বিশেষ কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে বলে জানালেন ইন্টেরিয়র ডিজাইনার আবদুল্লাহ মিরাজ। এই যেমন সরাসরি সূর্যের আলো পড়ে, এমন দেয়ালে রং করলে সেই রং খুব বেশি দিন টেকসই হয় না। তাই সূর্যের আলো কম পড়ে বা পড়ে না, রং করার জন্য এমন দেয়াল বেছে নেওয়াই ভালো। দেয়াল ড্যামেজ থাকলে সেই দেয়ালে রং দীর্ঘস্থায়ী হবে না। তাই ঘরের দেয়াল রাঙানোর আগে দেয়ালের অবস্থা বুঝে নেওয়াটা খুব জরুরি। বিশেষজ্ঞ দিয়ে রং করালে অবশ্য অন্য কথা।
থিম ধরে আঁকা
অনেকেই বাসায় থিম ধরে দেয়ালচিত্র আঁকিয়ে নেন। সাদামাটা ঘরের দেয়াল পায় ভিন্ন ভাষা। অঙ্কনচিত্র করানোর আগে পুরোনো দেয়াল হলে ভালোভাবে ঘষে পরিষ্কার করে নিন। প্রথমেই দেয়ালে বেজ রং ব্যবহার করবেন। এর ওপরে আঁকতে হবে দেয়ালচিত্র। যদি গাঢ় রঙের ব্যবহার করতে চান, তাহলে তিনবার রঙের প্রলেপ বসাতে হবে। অন্যদিকে গাঢ় রঙের দেয়ালকে হালকা করতে হলে এক কোট প্লাস্টিক পেইন্ট ব্যবহার করলেই চলবে। এবার দেয়ালে কী আঁকাবেন বা আঁকবেন, তা ভাবছেন? ঘরটি কোন কাজে ব্যবহার করবেন, তা আগে ঠিক করে নিন। সামনে আসবাব নেই, এমন ফাঁকা দেয়াল অঙ্কনের জন্য বেছে নিন। চিত্র আঁকার সময় আরেকটি বিষয় মনে রাখবেন, ঘরের দেয়ালটা খুব বড় না হলে ওয়াল পেইন্টিংয়ে বেশি রঙের ব্যবহার না করাই ভালো।
অঙ্কনচিত্রে অনেকেই নানা ধরনের প্রপস (যেমন বইয়ের তাক, শোপিস, ফটোফ্রেম) ব্যবহার করেন। পেইন্টিংয়ে এ ধরনের প্রপসের ব্যবহার করতে চাইলে ঘরের আসবাবের সঙ্গে তা যাতে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, সেদিকেও বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে।
আর বাসার সব ঘরের দেয়ালে চিত্র না এঁকে, এক বা কয়েকটি বিশেষ দেয়াল বেছে নেওয়াই ভালো। অঙ্কনের থিম কী হবে, নির্ভর করবে আপনার রুচি ও ঘরের আসবাব–অনুষঙ্গের ওপর। ঘরে যদি দেশি ঢঙের আসবাবের প্রাধান্য থাকে, তবে দেয়ালে আঁকতে পারেন লোকজ মোটিফ। চাইলে আল্পনাও করতে পারেন। এদিকে ঘরে যদি বেত বা বাঁশের আসবাব থাকে, সে ক্ষেত্রে গাছপালার থিম ব্যবহার করতে পারেন। একটু ভিন্টেজ লুকের অন্দরসাজে দেয়ালচিত্রে থাকতে পারে সেই আবহ।
অন্দরের রং হিসেবে কোন ধারা চলছে, সেটা তো জানলেন; সঙ্গে জেনে নিন বছরের কোন সময়টা দেয়াল রাঙানোর জন্য উপযুক্ত। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি—স্থাপত্যবিদ্যায় এই চার মাসকে দেয়াল রাঙানোর উপযুক্ত সময় বলে ধরে নেওয়া হয়। এই সময় বৃষ্টি হয় না বললেই চলে, যে কারণে দেয়াল থাকে আর্দ্রতামুক্ত।
বেশ কয়েক বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে, মানুষ ঘর সাজানোর ব্যাপারে বেশ সচেতন। শুধু আসবাব, পর্দা, কুশন কাভার, বিছানার চাদরের মতো অনুষঙ্গেই নয়, দেয়াল রাঙানোর বিষয়টিতেও তাঁরা দিচ্ছেন বাড়তি মনোযোগ। কারণ, ঘরের অন্যান্য অনুষঙ্গে যত পরিবর্তনই আনুন না কেন, দেয়াল যদি হয় রংচটা, তবে ঘর সাজানো ষোলো আনাই মাটি। তাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঘরের দেয়াল করে তুলুন বর্ণিল।
এ বছর কোন রং
প্রতিবছরই একটা রংকে বৈশ্বিক রং নির্ধারণ করে প্যানটোন। ২০২২ সালের জন্য প্রতিষ্ঠানটি বেছে নিয়েছে ‘ভেরি পেরি’। রাজকীয় এই রংটি উজ্জ্বল আলোয় বেগুনি দেখায় আর ম্লান বদ্ধ জায়গায় গভীর নীল। নতুন বানানো এই রংটি এই যুগের ধারা, মানসিকতা এবং পরিবর্তনকে তুলে ধরে।
উল্লেখ্য, ২৩ বছর ধরে প্যানটোন ফ্যাশন, বাড়ির আসবাব, শিল্পনকশা, পণ্য প্যাকেজিং, গ্রাফিক ডিজাইনসহ একাধিক শিল্প পণ্যের বিকাশ ও ক্রয়ের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করছে।