সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর সময়টায় দেশের পাখির আলোকচিত্রীদের অনেকের ফেসবুক প্রোফাইলজুড়ে প্রধানত লাল মুনিয়ার ছবি দেখা যায়। যাঁরা এ পাখির ছবি তুলেছেন, দেখেছেন, তাঁদের ভালো লাগার সীমা নেই। আর যাঁরা তুলতে পারেননি কোনো দিন কিংবা এ পাখি দেখেননি, তাঁদের পরম আগ্রহের বিষয় লাল মুনিয়া। প্রতিবছর একই স্থানে পাওয়া যায়, তা-ও নয়। গত বছর দেখা গেছে ঢাকার দিয়াবাড়িতে। এ বছর ঢাকার আফতাবনগরে। রাজশাহীতে সামান্য সময় দেখা গেছে। এ বছর অনেকেই সারা দেশ থেকে ঢাকায় এসেছেন শুধু এই পাখির ছবি তোলার জন্য।
অনেক দিন ধরে পাখির ছবি তুললেও মূলত করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে আমি পাখির ছবি তোলায় বিশেষভাবে মনোনিবেশ করেছি। ফলে গত বছর দৃষ্টিনন্দন অপার সৌন্দর্যের এই পাখিটি ফেসবুকে শুধু দেখেছি। করোনার জন্য ঢাকায় আসা সম্ভব ছিল না। রংপুরের সম্ভাব্য বিভিন্ন স্থান ঘুরেও পাখিটি দেখতে পাইনি। এ বছরও রংপুরে সন্ধান করা বৃথা গেছে। শুধু দেখছিলাম সেপ্টেম্বর মাসেই ফেসবুকে লাল মুনিয়া জেঁকে বসেছে। কী মায়াবী, কী আকর্ষণীয় পাখি! মনে মনে স্থির করেছিলাম, এ বছর মুনিয়া দেখতে হবে, ছবিও তুলতে হবে।
গত নভেম্বরে পারিবারিক কাজে ঢাকায় গিয়েছিলাম। মনে হয়েছিল ছবি তোলার মতো অফুরন্ত সময় আমি পাব না। তবু ক্যামেরা আর ভারী লেন্স—সবই নিয়েছিলাম। মনে মনে ঠিক করেছিলাম, এক বেলা সময় পেলেই রাজধানীর আফতাবনগরে যাব।
সেদিন ছিল শুক্রবার। মৌসুমী সিরাজ নামের একনিষ্ঠ একজন পাখির আলোকচিত্রীকে ফোন দিলাম। তিনি ঠিকানা বলে দিলেন। বন্ধু লিটনসহ গেলাম আফতাবনগরের নিরিবিলি কাশবনঘেরা জলাশয়সংলগ্ন সেই মুনিয়ার ঠিকানায়। যখন পৌঁছলাম, তখন বেলা প্রায় ১১টা। ততক্ষণে কয়েক দফায় মুনিয়াপ্রেমীরা ছবি তুলে চলে গেছেন। মূল স্থানে পৌঁছার আগে দেখলাম কয়েকজন ক্যামেরা হাতে চলে যাচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে দুজন পরিচিত পেলাম। ফেসবুক সূত্রে পাখির ছবিকেন্দ্রিক পরিচয় তাঁদের সঙ্গে। একজন বললেন, আজ আর মুনিয়া মনে হয় আসবে না। অনেকক্ষণ ধরে আসছে না দেখে চলে যাচ্ছি। তবু ১৫-২০ জন টেলিফটো লেন্সসহ ক্যামেরা নিয়ে বসে আছেন, যদি আসে, সেই অপেক্ষায়। তাঁরা সবাই আছেন আরও ভালো ছবি তোলার অপেক্ষায়। আর আমি প্রথমবারের মতো। অনেকেই বলাবলি করছিলেন ‘লাল্টু’ আর আসবে না। বলতে বলতেই লাল মুনিয়া হাজির।
আফতাবনগরে লাল মুনিয়া মূলত বিলের পাশে সামান্য একটু জমে থাকা পানির শেওলা খেতে আসে। প্রথমবার যখন মুনিয়া এল, তখন কচুরিপানার কারণে ভালো করে দেখতে পেলাম না। সামান্য দেখা দিয়েছিল। ওইটুকু দেখাতেই বুঝলাম কী দারুণ এর রূপ। কয়েক মিনিট পরই আরও পরিষ্কার জায়গায় এসে মুনিয়া বসল। মুনিয়া আসামাত্রই উপস্থিত পাখির আলোকচিত্রীরা মাটিতে সটান হয়ে শুয়ে পড়লেন। ক্যামেরায় তখন কেবলই শাটারের শব্দ। মুনিয়া পাখিগুলো ভয়ও করছে না। প্রতিদিন অসংখ্য আলোকচিত্রী তাদের ছবি তোলে। তারাও অভ্যস্ত। এতজন মানুষ, সবার হাতে হাতে বড় বড় ক্যামেরা, লেন্স কিন্তু মুনিয়া নির্ভীক। শুধু তা-ই নয়, কখনো কখনো কয়েকটি মুনিয়া একসঙ্গে আসে। কোনো কোনোটি অনেক কাছে চলে এল। আমি ছবি তোলা বাদ দিয়ে অনেক সময় ধরে মুনিয়া পাখির দিকে তাকিয়ে থাকলাম। এত সুন্দর পাখি। এত বর্ণিল! মুনিয়ার দিকে তাকিয়ে বুঝলাম প্রেমিক-প্রেমিকারা কেন পরস্পরকে ‘মুনিয়া’ কিংবা ‘পাখি’ নামে ডাকে।
মৌসুমভেদে ভিন্ন ভিন্ন পাখি পাওয়া যায়। পাখিদের ভৌগোলিক সীমারেখা নেই। তারা নিজেদের অনুকূল তাপমাত্রা আর খাদ্যের প্রয়োজনে ঠিক করে নেয় তাদের ঠিকানা। এ কারণে আমরা যে পাখিগুলোকে সাধারণত অতিথি পাখি বলে থাকি, তারা আসলে অতিথি পাখি নয়। এরা পরিযায়ী পাখি। যত দিন তারা এ দেশে থাকে, তত দিন এটাই তাদের আবাস। এটাই তখন তাদের আপন ভূমি। আর লাল মুনিয়া আমাদের আবাসিক পাখি।
মৌসুম বিবেচনায় সবচেয়ে বেশি পাখি আসে শীত মৌসুমে। পাখি পর্যবেক্ষক, পাখির আলোকচিত্রী তথা পাখিপ্রেমীদের জন্য এই মৌসুম অনন্য। গ্রীষ্মে যে কটি পাখির প্রতি পাখিপ্রেমীদের বেশি আগ্রহ দেখা যায়, তার মধ্যে অন্যতম লাল মুনিয়া। বাংলাদেশে বেশ কয়েক ধরনের মুনিয়া পাওয়া যায়। এগুলো প্রায় সারা বছর থাকে। কিন্তু লাল মুনিয়া দেখা যায় শুধু জুলাই-আগস্ট থেকে নভেম্বর-ডিসেম্বর পর্যন্ত।
তবে যেভাবে ঢাকায় নগর সম্প্রসারিত হচ্ছে, তাতে যেকোনো বছর থেকে লাল মুনিয়া আর দেখা না-ও যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে যাঁরা এ পাখি দেখেছেন, তাঁরা সত্যি ভাগ্যবান।
লেখক: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর