৭.
দ্বিতীয় দিন। গ্যাঁট হয়ে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেকচার শুনে প্রায় ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। পাশের কারও ধাক্কায় ধড়ফড় করে উঠলাম। পোস্টার সেশনে ছুট দিতে হলো। সেখানে গোল আলুর মতো কেতরে থাকার জো নেই। বরং ভুট্টার খই হয়ে ফুটতে হবে। সুতরাং, যত প্রকারে হাত-পা নেড়ে, ঘাড়-মাথা ঝাঁকিয়ে, কথার তুবড়ি ছুটিয়ে মুখে ফেনা তুলে ফেললাম। অতি আগ্রহের বনামে বুড়ো বুড়ো বিজ্ঞ প্রফেসর মুচকি হাসলেন। এতটুকু দমে না গিয়ে শূন্য কলসির মতো বাজতেই থাকলাম। অল্প বিদ্যার এমনই তেজ।
একটা ভয় কাজ করছে আসলে। পর্তুগাল আসার আগে বাজখাঁই তুর্কি সুপারভাইজার ডক্টর ইলদ্রিম হাসতে হাসতে গলায় পোঁচ দেওয়ার ভঙ্গি করে ছেড়ে দিয়েছে। রিসার্চের কাজ তুখোড়ভাবে মেলে ধরতে না পারলে এক কোপে কল্লা কেটে নেবে। নিজে না এলেও কনফারেন্সের আসরে তাঁর অনেক ‘কান’ আছে। ভালো-মন্দ সব সে শুনতে পায়। ভজকট পাকিয়ে মিউনিখ ফিরে গেলে গর্দান সে নিতেও পারে। আতঙ্ক আর ত্রাসের অপর নাম ডক্টর আলী ইলদ্রিমের অসাধ্য কিছুই নেই।
যা হোক, সব ভালোয় ভালোয় সেরে হোটেলে ফিরে গেলাম বিকেল নাগাদ। তৈরি হয়ে নেওয়ার তাড়া আছে। রাতে গালা ডিনার। জাঁকজমক পার্টি হবে। সেখানে ছাত্র-প্রফেসর সবার সেজেগুজে আসার রেওয়াজ। গতবার ডক্টর মেলানি ক্যোনিগসহফ তাক লাগিয়ে দিয়েছিল ঘেরওয়ালা গাউন পরে। গম্ভীর, রাশভারী প্রফেসর আইকেলবার্গও নাকি চরম স্যুটেড-বুটেড হয়ে নারীমহলের কলিজা কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। ডিসকো বাতি জ্বেলে ম্যাড়ম্যাড়ে কনফারেন্স হল বদলে গিয়েছিল ঝলমলে বল রুমে। সে এক দেখার মতো দৃশ্য।
গল্পগুলো মিউনিখে বসে ভারতীয় বান্ধবী বার্খার কাছ থেকে শুনেছিলাম। বার্খা পোস্টডক্টরাল ফেলো। গতবারের কনফারেন্সে সে এসেছিল। সেবার কেন যে স্যুটকেসে ঢুকিয়ে একখানা শাড়ি নিয়ে যায়নি—এই আফসোসের তার শেষ নেই। বার্খার জবরদস্তিতে ব্যাকপ্যাকে একখানা নীল শাড়ি পুরে এনেছি। সেটা এখন হোটেলের সফেদ বিছানায় এলোমেলো পড়ে আছে। এই তেরো হাতি কাপড় নিয়ে বিরাট দ্বিধায় পড়ে গেছি।
কখন যে ফ্রান্সি এসে পাশে দাঁড়িয়েছে, টের পাইনি। নীল জমিনে রুপালি সুতোর মিহি কারুকাজ দেখে তার মুখে কথা সরে না। ‘আরেব্ববাহ, শাড়ি দেখছি। তুমি পরতে জানো?’ ফ্রান্সির গলায় বেজায় কৌতূহল। কোন ফাঁকে সে চটজলদি তৈরি হয়ে নিয়েছে। তার বেশভূষাও বেশ ইন্টারেস্টিং। কালো স্ট্রাইপ ট্রাউজার, ফরমাল সাদা শার্ট আর ব্যাক ব্রাশ চুলে ফ্রান্সিকে পুরো টমবয় লাগছে। ‘দেখো, বেশি সময় নিয়ো না, আমরা নিচে অপেক্ষা করছি। তাড়াতাড়ি নেমে এসো।‘ তাগাদা দিয়ে বাদামি ড্রেস সু মচমচিয়ে ফ্রান্সি চলে গেল।
মিনিট পনেরো পর। শাড়ি পেঁচিয়ে জড়ভরত সেজে সিঁড়ির হাতল ধরে ধরে খুব সাবধানে নেমে এলাম। পেনসিল হিলটা এই বুঝি একদিকে টশকে গেল। টালটামাল দৃশ্য দেখে সঙ্গের মেয়েগুলো আমোদ পাচ্ছে। তাদের পরনে ফরমাল মিডি স্কার্ট আর হালকা রঙের টপ। গলায় বড়জোর রঙিন শাল। ছিমছাম সাজ। টাল সামলে রওনা দিলাম ওদের সঙ্গে। কিন্তু শাড়ির কুঁচি পায়ের তলে পড়ে ঠিকই টশকে গেলাম।
নেতা গোছের ফ্রান্সি এগিয়ে এল মুশকিল আসান হয়ে। ‘অ্যাই, সোজা হয়ে দাঁড়াও তো। পড়ে গিয়ে মাথা ফাটিয়ে ফেলবে আর তোমাকে কাঁধে নিয়ে ঘুরব আমরা? ধ্যাত্তেরি!’ গজগজ করতে করতেই জার্মান মেয়েটা পকেট থেকে সেফটিপিন বের করে ভীষণ দ্রুততায় অবাধ্য শাড়ির ভাঁজগুলোকে দারুণ শাসনে নিয়ে এল। এই মেয়ের জন্ম বাংলাদেশে হওয়া উচিত ছিল। শাড়ি-টিপে কী সুন্দর টিএসসি, কার্জন হলো ঘুরে বেড়াত। তা না, খামোখাই জার্মান দেশে জন্মে শার্ট-প্যান্ট চাপিয়ে শুষ্কং কাষ্ঠং টমবয় সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
৮.
কোথায় গালা ডিনার? আমাদের ছোট্ট দলটা ছাড়া বাকি সবাই দিনের বেলার সেই একই কাপড় পরে চলে এসেছে। পোশাকের ভাঁজে সারা দিনের স্পষ্ট ক্লান্তি। তার মাঝে নিজেকে নিদারুণ বেখাপ্পা লাগছে। বার্খার কথা শুনে এমন সং সেজে এখন হাসির পাত্র হতে যাচ্ছি মনে হচ্ছে।
শাড়ি নামক এই উপমহাদেশীয় বস্ত্রের জেল্লা একবার চাক্ষুষ দেখতে অনেকেই উৎসুক এগিয়ে আসছে। কোনোমতে সামনের সারির আসনে পালিয়ে বাঁচলাম। সম্মেলনগুলোতে প্রথম সারি চিরকাল ফাঁকা পড়ে থাকে। ঘুমিয়ে গেলে ধরা পড়ার ভয়ে।
ডিসকো বাতি জ্বলে ওঠার বদলে হতাশ করে দিয়ে মোচওয়ালা এক প্রৌঢ় মঞ্চে উঠে এল। পোশাকের প্রতি লোকজনের উদাসীনতার কারণ বোঝা গেল এতক্ষণে। কিসের নৃত্যসন্ধ্যা, আজকে হবে সংগীত রজনী। পর্তুগালের ঐতিহ্যবাহী ফাদো সংগীত। ভদ্রলোক ছোট্ট করে গলা খাঁকারি দিয়ে কথা শুরু করলেন। ‘ফাদো মানে ভাগ্য বা পরিণতি। বয়ে চলা সময়ের পরিণতিকে এই গানে বেঁধে ফেলা হয় এক মনোটোনিক সুরের বাঁধনে...’। ফাদো সংগীতের বিশাল ইতিহাসের বনামে বোয়াল মাছের হাঁ মেলে আমিও বিশালতর এক হাই তুলে ফেললাম।
অপ্রয়োজনীয় ইতিহাস কপচানোর পর এবার শুরু হলো গান। অপেরা সংগীতের স্টাইলে উঁচু তানে সুরের নামে অসুর ধরল শক্তিশালী মোটাসোটা মাঝবয়সী গায়ক। কী গান বাবা রে! দুই কানে ভয়ংকর অত্যাচার ঠেকছে। কী ভুল করেই যে প্রথম সারিতে বসেছি। কানের পর্দা ফেটে চৌচির হওয়ার জোগাড়। ওদিকে গায়কের সবুজ রগ গলা থেকে কপাল অবধি চড়ে গিয়েছে। নিরুপায়ের মতো এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলাম।
পাঁচ মিনিটের মাথায় আমাদের সবাইকে বিধ্বস্ত করে দিয়ে রগ ফুলানো গায়ক বড় একটা বাউ করে বিদায় নিল। নিঃশব্দে হাঁপ ছাড়লাম, ‘ফিউউহ্!’। মঞ্চে এবার এল কালো গাউন পরা এক নারী। আধো আলোতে তার বয়স ঠাহর হয় না। গাঢ় মাশকারায় ঢাকা চোখ দুটো আধবোজা। স্প্যানিশ গিটার আর তানপুরার আদলে গড়া পর্তুগিজ গিটার হাতে উঠে এল আরও দুজন। ধীর লয়ে শুরু হলো অপূর্ব সুরের রিনিঝিনি। না জ্যাজ, না ব্লুজ, না ফোক। সংগীতের জানাশোনা কোনো ধারাতে তাকে ফেলা গেল না। উসখুস করা এক হল লোক যেন আচমকাই শান্ত হয়ে বসল।
কেউ যেন সুরেলা গলায় গল্প বলে চলেছে। এক বর্ণ পর্তুগিজ জানা নেই, অথচ মন বলছে এ যেন দেশ–দেশান্তর ঘুরে আসা বোহেমিয়ানের ভ্রমণ, ঘাটে ঘাটে নোঙর ফেলা নাবিকের যাত্রা, আটপৌরে মানুষের সরল গল্প। কিন্তু কাহিনিগুলো যেন দুঃখ দিয়ে গাঁথা। সম্মোহনী ভঙ্গিতে গেয়েই চলছে গায়িকা। তার কাঁধে কেউ যেন সেসব মানুষের দুঃখের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে। বেদনাকে ধারণ করে এমন করে গাইতে কাউকে আর দেখিনি।
গান শেষ হলো একসময়ে। শিল্পী নিচু গলায় কী যেন বলছে। আশ্চর্য হয়ে শুনলাম, ফাদো গানের আদি শিল্পীরা কেউ ছিল পেশায় নাবিক, কেউ বা পর্যটক। গানের যে ভাষার দরকার নেই, আরেকবার স্বীকার করতেই হলো।
লেখক: গবেষক, ইনস্টিটিউট অব প্যাথলজি, টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি মিউনিখ, জার্মানি