প্রথম দিন তো গেল। আমাদের দ্বিতীয় দিনের অ্যাকটিভিটি আইস ফিশিং। গাইডেড ট্যুর। আজকের গাইড দিমিত্রি। ইউক্রেনিয়ান। আমরা চারজন, দিমিত্রি, আরও একজন আছেন। মঙ্গোলিয়ান উঅন। দিমিত্রিই ড্রাইভ করছিল। সেই সঙ্গে নানান প্রশ্নে ওকে জর্জরিত করছিলাম আমরা। আবারও টর্নেট্রাস্ক হ্রদের পাশ ঘেঁষে যাচ্ছি।
আবিস্কো থেকে যেদিকেই যাই, পূর্বে বা পশ্চিমে, টর্নেট্রাস্ককে পাশে রেখেই যেতে হয়।
হ্রদটা বেশ বড়সড়ই বলতে হবে। দৈর্ঘ্যে প্রায় ৭০ কিলোমিটার। ল্যাপল্যান্ডের কেবনেকাইসে, সারেকটিয়াক্কা, কাস্কাসার্কজাক্কা পর্বতের হিমবাহ গলে টর্নেট্রাস্ক হয়েছে। ওপর থেকে পানি গড়িয়ে পড়ায় গভীরতাও অনেক, কোথাও কোথাও ১৬০ মিটারের চেয়েও বেশি।
সুইডেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কোনো পক্ষ নেয়নি। দ্বিতীয় বা প্রথম কেন, ১৮১৪ সালের পর থেকে কোনো যুদ্ধেই না জড়ানো একমাত্র দেশ সুইডেন। তাদের আপত্তি অগ্রাহ্য করেই ব্রিটিশ নৌবাহিনী ১৯৪৪–এ জার্মান রণতরি টারপিট্জ ধ্বংসের প্রস্তুতি নেয় এই টর্নেট্রাস্কেই। হ্রদের প্রায় ৭০ শতাংশই বরফ জমে রয়েছে। চাইলে হ্রদের ওপর দিয়ে দৌড়ে আসা যায়। কোনো কোনো বছর অন্তত দুই মাস পুরো হ্রদই জমে থাকে, জানাল দিমিত্রি।
লেকের পাশে এমন কিছু জায়গা আছে, দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে সাব–জিরো তাপমাত্রায় থাকে। তার মানে, অনেককাল ধরে সূর্যালোক দেখার সুযোগ পায় না সেই মাটি। এমন ভূমিকে বলে পামফ্রিস্ট। এক ইঞ্চি থেকে শুরু করে কয়েক মাইলও নাকি হতে পারে জমে থাকা বরফের পুরুত্ব। মিনিট বিশেকের মধ্যে আমরা পৌঁছে যাই, যেখানে মাছ ধরব, সেই জায়গায়। মাঝারি সাইজের দিঘি।
দিমিত্রি বলল, চলো!
—কোথায়? ওটা তো বললে দিঘি।
—দিঘি হয়েছে তো কি? ওখানে বরফ জমে আছে, ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া যাবে।
ভয়ে ভয়ে, দুই পা এগোই তো এক পা পিছিয়ে পৌঁছালাম দিঘির একেবারে মাঝখানে। দিমিত্রি বলল, এখানে নিশ্চিন্তে হাঁটতে–দৌড়াতে পারো। বরফের পুরুত্ব ১৫ ইঞ্চির বেশি। ৬ ইঞ্চি হলে হাঁটা যায়, আর ২০ ইঞ্চি হলে তো এর ওপর দিয়ে ড্রাইভও করা যাবে। তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু এই তুষারমরুতে মৎস্যশিকার কীভাবে হবে?
দিমিত্রি এবার তার ট্রাঙ্ক দেখিয়ে বলল, এ জন্যই তো এসব আয়োজন। বরফের পুরু প্রলেপ ছিদ্র করতে বের করল কয়েকটা ড্রিলিং ডিভাইস। আইস অগার বলে এগুলোকে। দুই হাতে ঘোরাতে ঘোরাতে মিনিট চারেক পর ‘খট’ করে শব্দ হয়। তৈরি হয়ে গেল ছয় ইঞ্চি ব্যাসের ছিদ্র। এবার এখান থেকে বরফ কুচি তুলতে হবে। ছাঁকনি আছে কয়েকটা। রোদেলা–বিভোর ব্যস্ত হয়ে পড়ল ছাঁকনি দিয়ে বরফকুচি তুলতে।
দিমিত্রি বলে দিয়েছে, পুরোপুরি পরিষ্কার করা না গেলে মাছ থাকলেও দেখতে পাবে না।
প্রস্তুতি চলল ঘণ্টাখানেক। সময়টা মন্দ কাটল না কিন্তু। সবাই মিলে ড্রিল করছি, বরফকুচি তুলে আনছি। অবশেষে সবার জন্য একটি করে ছিদ্র হয়ে যাওয়ার পর বড়শি ফেলার পালা। ছোট বড়শিতে কেঁচোর মতো পোকা গেঁথে দিয়েছে দিমিত্রি। আমরা দিমিত্রির দেওয়া চৌকোনাকৃতি কুশনের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে বড়শি গলিয়ে দিলাম ওই সব ছিদ্রে। চোখের পলক পড়তে দিচ্ছি না, মাছ যেন সটকে না যায়। মাছ একযোগে ছুটে আসবে।
তেমন কিছুই হলো না। সেকেন্ড যায়, মিনিট যায়, ১০ মিনিট যায়, মাছেদের দেখা নেই। ওরা সবাই কি তবে আজ মামাবাড়িতে বেড়াতে গেল?
সাত বছরের শিশু কি আর অমন ধৈর্যে অপেক্ষা করবে? আমাদেরও তেমন বসে থাকায় পোষাচ্ছিল না। দিমিত্রি বলল, মাঝে মাঝে কোনো এক জায়গায় না হলে অন্য জায়গায় চেষ্টা করা যায়। কয়েক মিটার দূরে নিয়ে নতুন করে ড্রিল করতে লাগল। আমরাও বরফকুচি কুড়াতে লাগলাম। তারপর আরও এক রাউন্ডের চেষ্টা।
বিভোর–রোদেলা ততক্ষণে বরফদিঘিকে প্লে গ্রাউন্ড বানিয়ে ফেলেছে। শুরু হয়ে গেছে ‘অতি প্রাসঙ্গিক’ বরফ–পানি খেলা। আর যথারীতি দৌড়ঝাঁপ। একটু পর রূপা যোগ দিল। তারপর আমিও।
উঅন তখনো বড়শি ফেলে প্রতীক্ষায়। আর দিমিত্রি ব্যস্ত খননকাজে। আমরা দৌড়াদৌড়িতে পুরোপুরি মেতে উঠেছি। বরফ আচ্ছাদিত দিঘির ওপর। ক্ষণিক পরে ক্লান্ত হয়ে সবাই শুয়ে পড়লাম। চিত হয়ে। আকাশের দিকে চোখ। আমরা এ ছয়টি প্রাণী ছাড়া যেন বিশ্ব চরাচরে আর কারও অস্তিত্ব নেই। আর কেউ নেই।
ধীরে ধীরে পশ্চিমাকাশ রাঙা হয়ে উঠছে। রোদেলা দৌড়ে যাচ্ছে সেদিকেই।
আকাশ ধরবে বলে।
রূপার সেলফোনে অবিরাম ক্লিক ক্লিক চলছে।
অবশেষে ঘণ্টা তিনেক কাটিয়ে, মৎস্যশূন্য ভাগ্য মেনে নিয়ে, অপরিসীম আনন্দ আর মিষ্টি স্মৃতি নিয়ে হোটেলে ফিরে আসি।
পরদিন সকালে ট্রেন। ব্যাক টু স্টকহোম। স্টেশনের দিকে যখন বাক্সপেটরা নিয়ে যাচ্ছি, তখন তুমুল তুষারপাত। কাল ঘণ্টা তিনেক যারা বরফদীঘির ওপর দৌড়েছে, ঘনশ্যাম জলপ্রপাতের গান শুনেছে, আর আকাশব্যাপী সবুজ–নীল আলোর নাচন যারা দেখেছে, এ তুষারপাত তাদের কাছে কিছুই না—‘অ্যাজ সিম্পল অ্যাজ স্নো’।
ট্রেন আসতে এখনো মিনিট দশেক বাকি। সময় ছিল, তাই ‘ইউ’ আকৃতির উপত্যকা—ল্যাপোনিয়ান গেটের দিকে যাওয়া হয়। স্টেশন থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মনে পড়ছে—এমনই এক পর্বত দেখেছিলাম তাসমানিয়ায় ক্র্যাডল মাউন্টেন। উত্তর মেরুবৃত্তের মাঝে বসে ভাবছি সর্বদক্ষিণের নিসর্গ নিয়ে।
ভাবনার পায়ে শিকল পরানো যায় না। (শেষ)
লেখক: জেনেভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদর দপ্তরে কর্মরত।