জলের জীবন, ফুলের জীবন

এ গল্পে জড়িয়ে আছে ভালোবাসার গন্ধ।

শ্রীনগর ছিল মুঘল সম্রাটদের গ্রীষ্মকালীন আবাসস্থল। এ জনপদের আবহাওয়া গ্রীষ্মকালে থাকে আরামদায়ক ও মনোরম। গ্রীষ্মকালে মুঘল সম্রাটেরা শ্রীনগর থেকে রাজকার্য পরিচালনা করতেন। এ জন্য নগরটিতে নির্মাণ করেছিলেন দুর্গ, মনোরম উদ্যান, মসজিদ ইত্যাদি।

শালিমার গার্ডেন
ছবি: লেখক

শালিমার শব্দের অর্থ ‘ভালোবাসার নিলয়’। সম্রাট জাহাঙ্গীর তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী নূরজাহানের জন্য ১৬১৯ খ্রিষ্টাব্দে নির্মাণ করেছিলেন এই ভালোবাসার নিকেতন। সম্রাট জাহাঙ্গীরের গ্রীষ্মকালীন অবকাশকেন্দ্র এতখানিই পছন্দ ছিল যে তিনি প্রতিবছর কাশ্মীর চলে আসতেন। এমনকি মৃত্যুর আগে তিনি বলে গিয়েছিলেন, ‘একমাত্র কাশ্মীরই সুন্দর, বাকি সব অর্থহীন।’  

সম্রাট জাহাঙ্গীর তাঁর এই অবকাশকেন্দ্রে বসে রাজকার্য পরিচালনা করতেন, তাই মুঘল স্থাপত্যশৈলী এই বাগানবাড়িতেও স্থান করে নিয়েছিল। দিওয়ান-এ-আম বা জনসাধারণের সঙ্গে সাক্ষাতের কক্ষ, দিওয়ান-এ-খাস বা রাষ্ট্রীয় অতিথি অভ্যর্থনা কক্ষ, জেনানা মহল বা রানি ও প্রাসাদের অন্য নারীদের কক্ষ ইত্যাদি। একে একে বলা যায় মুঘল শাসনামলের শান–শওকতের কথা। আর এসব ভবন ঘিরে রয়েছে সুবিশাল বাগান, যাতে দোল খাচ্ছে নানা রঙের ফুল। শালিমার গার্ডেনে ফুলবাগান ঘিরে রয়েছে কয়েকটি তোরণ, যা বাগানের শোভা বাড়িয়ে দিয়েছে। বাগানের ঠিক মাঝখানে পানির ফোয়ারা। পারস্যের স্থাপত্যকলার অনুকরণে নির্মিত এ বাগানবাড়ি মোট ৩১ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত। আর চত্বর শেষ হয়েছে ডাল লেকে গিয়ে। লাল, গোলাপি, হলুদ ফুলে শালিমার এখন ঝলমল করছে। এখানকার কিছু ফুলের নাম জানি, কিছু ফুল অজানা।

নিশাত গার্ডেন
ছবি: লেখক

পরবর্তী গন্তব্য নিশাত গার্ডেন।
মুঘল উদ্যানগুলো প্রায় কাছাকাছি সময়ে নির্মাণ করা হয়েছে। নিশাতবাগের আক্ষরিক অর্থ ‘আনন্দ উদ্যান’। নিশাতবাগ নির্মিত হয় ১৬৩৩ খ্রিষ্টাব্দে। সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্ত্রী নূরজাহানের বড় ভাই আসিফ খান শালিমারবাগ দেখে তারচেয়েও বড় আকারের একটি বাগান নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। যত দূর জানা যায়, এই উদ্যানটি ভারতে মুঘলদের স্থাপন করা সবচেয়ে বড় উদ্যান। নিশাতবাগের ধাপ বা মোট চত্বরের সংখ্যা বারো। ৪৬ একর এলাকাজুড়ে নির্মিত নিশাতবাগ আসলে শালিমারবাগের অনুকরণ, তাই দেখতে প্রায় একই রকম। আসিফ খান এ উদ্যানে সপরিবারে আসতেন অবকাশযাপনে। এ উদ্যানে জনসাধারণের ও পরিবারের নারীদের জন্য আলাদা আলাদা ভাগ করা ছিল। উদ্যানের মাঝে আছে পানির ফোয়ারা এবং অন্যান্য মুঘল উদ্যানের মতো ফুলবাগান। কাশ্মীরে সারা বছর থাকে ফুল ফোটার মৌসুম, শীতকাল ছাড়া।

এ উদ্যানের পাদদেশেও ডাল লেক জড়িয়ে আছে পরম মমতায়।

নিশাতবাগ থেকে চললাম ‘পরিমহল’।

শালিমার, নিশাত কাছাকাছি হলেও পরিমহল এখান থেকে খানিক দূরে।

পরিমহলের রাস্তা ধরতেই মনে হলো যেন অচেনা এক দেশে চলে এসেছি। আগে তো প্রকৃতির এমন কোমল রূপ দেখিনি। পথের দুধারের সিলভার, চিনার গাছগুলো হলুদ হয়ে আলো ঝরাচ্ছে। ঝরে যাওয়ার আগে যেন মনের সব না–বলা কথা বলে যাচ্ছে। পাতা ঝরছে আর পথকেও এই আলোর নেশা করতে বলছে। আহা, নেশা করলে তো এমন নেশাই করতে হয়।

পরিমহল
ছবি: লেখক

আমেরকে গাড়ি থামাতে বললাম। এখানে অবশ্য একটু কড়াকড়ি আছে সেনাবাহিনীর। তাই খানিক এগিয়ে গাড়ি যখন থামাল, তখন আমি সত্যিই নেশাতুর। চারদিকে যেন আগুন ঠিকরে পড়ছে অথচ সে আগুন নমনীয়, সহনীয় আর আপন।

যত দূর চোখ যায় পাহাড় আর জঙ্গলের মধ্যে হলুদ ফুলের বিশাল বিছানা। অথচ এখানে একটি ফুলও নেই, আছে শুধু পাতা। হিম হিম হয়ে আচ্ছন্ন থাকার বেলা।

পরিমহল নির্মাণ করা হয়েছিল শাহজাদা দারাশিকোর জন্য
ছবি: লেখক

পরিমহল নির্মাণ করা হয়েছিল শাহজাদা দারাশিকোর জন্য। শাহজাদার বিশাল লাইব্রেরি ছিল এখানে। দারাশিকো ছিলেন কবি, এ ছাড়া আগ্রহ ছিল জ্যোতির্বিদ্যায়। নিরালায় পড়াশোনা আর কবিতা লেখার জন্য উদার চিত্তের, অসাম্প্রদায়িক ক্রাউন প্রিন্স পাহাড়ের মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন এই উপঢৌকন।

শাহজাদার লাইব্রেরি পেলাম না খুঁজে, শুধু পড়ে রয়েছে পাথরের তৈরি মহলের ফিসফাস। যদিও ভেতরের কক্ষে প্রবেশের অনুমতি নেই।

মুঘল উদ্যান চশমে শাহি
ছবি: লেখক

সাতটি ধাপে পরিমহল নেমে গেছে নিচে ডাল লেককে জড়িয়ে ধরতে। সাতটি তোরণে ধাপে ধাপে পার হয়ে একেবারে ওপর থেকে শ্রীনগর শহর দেখা যায়। এ বাগানেও ফুলের কমতি নেই। সুবাসেও কৃপণতা নেই কারও। ঠিক কাশ্মীরের মানুষের মতো।
আরেকটি মুঘল উদ্যান চশমে শাহি। দেখতে পরিমহলের মতো। এই উদ্যানও নির্মাণ করা হয় শাহজাদা দারাশিকোর জন্য। তখতের রাজনীতির পাকে পড়ে ভাই আওরঙ্গজেবের হাতে অল্প বয়সে নিহত হওয়ার আগে শাহজাদা এখানে জীবনের শেষ সুন্দর সময়গুলো কাটিয়েছিলেন।

ডাল লেকের ফেরিওয়ালা
ছবি: লেখক

এসব বাগানে ঢুকতে টিকিট প্রয়োজন এবং করোনাকালে কাশ্মীরের অন্য কোথাও মাস্ক না পরলেও বাগানে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক।

চারটি বাগানই এখন বলতে গেলে ফাঁকা। দু–চারজন যাঁরা এসেছেন, তাঁরা স্থানীয়। আমার মতো বাইরের ভ্রমণকারী নয়।

সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডাও জাঁকিয়ে পড়ে। রাতে এখন তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে যায়।

সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেল, বাইরে খুব ঠান্ডা থাকলেও হাউসবোটের বারান্দায় বসে চা পানের সঙ্গে সঙ্গে হিম হিম সকালের ডাল লেকের সৌন্দর্য হয়ে ওঠে অপার্থিব। আমি আর কণিকা ততক্ষণে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছি।

প্রতিটি হাউসবোটে একটা ড্রয়িংরুম ও ডাইনিংরুম থাকে। কিন্তু ডাল লেকের শোভা কে উপেক্ষা করতে চায়! তাই বারান্দায় বসে থাকা যেন উৎসুক শিশুকে আরও প্রশ্রয় দেওয়া।

ডাল লেকের ফুল সওদাগর। এঁরা বিভিন্ন জাতের ফুলের বীজ বা চারা বিক্রি করেন
ছবি: লেখক

নাশতা পর্ব সারতে সারতে দেখা মিলতে পারে ফুল সওদাগরের, যিনি নৌকাভরে ফুল আনেন। আসলে তিনি আসেন বিভিন্ন জাতের ফুলের বীজ বা চারা বিক্রি করতে, চারাগাছে ফুটে থাকে নানা রঙের ফুল। বাণিজ্য শেষে হাউসবোটের অতিথির হাতে গুঁজে দেন কয়েকটি পদ্ম, ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে। এই প্রথম দেখা, এই হয়তোবা শেষ। তাই পরদেশি যেন মনে রাখে তাদের চিরতরে। একজোড়া পদ্মফুল হাতে পেয়ে আমি এখনো অভিভূত হয়ে যাই, প্রতিবারই যেন নতুন করে ভালোবাসায় ভরপুর হই। ফুলের বীজ কেনা কোনোবারেই হয় না। ভবঘুরে মানুষ, গাছপালা রাখব কোথায়! শুধু পদ্মফুল নিয়ে ঋণী থাকি।

ডাল লেকে নারীরাও শিকারা চালিয়ে যাতায়াত করেন
ছবি: লেখক

কখনো দাঁড় বেয়ে হরেক জিনিসের পসরা সাজিয়ে আসেন অন্যান্য ফেরিওয়ালা। কেউ ফল, কেউ সবজি, কেউবা জামাকাপড় বিক্রি করেন শিকারা বেয়ে বেয়ে ডাল লেকবাসীর মধ্যে। নারী–পুরুষ সবাই দাঁড় বেয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়া–আসা করেন। শিকারা তাঁদের বাহন। কারণ, এক হাউসবোট থেকে আরেক হাউসবোটে যেতে হলে বা বাজার করতে হলে শিকারা ছাড়া অন্য যানবাহন নেই। ভাসমান মুদি দোকানও আছে লেকের বুকের মাঝখানে।

কাশ্মীরি হস্তশিল্পের একটা বিশাল ভাসমান বাজার ছিল দুবছর আগেও এখানে। গত বছর দীর্ঘমেয়াদি কারফিউ শুরু হওয়ার পর থেকে বাজারটি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অনেক মানুষ জীবিকা হারিয়েছে। এমনকি মূল পর্যটন এলাকা বোলভার্ড রোড ধরে সারি সারি হস্তশিল্পের দোকানের বেশির ভাগই বন্ধ দেখলাম গতকাল।

বোলভার্ড রোডে মাছ বিক্রেতা
ছবি: লেখক

অবশ্য ফেরার পথে গতকাল আমেরকে বলেছিলাম এখানকার ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে নিয়ে যেতে। তিন বছর আগে যখন এসেছিলাম, তখন সেখানকার একটা চায়ের দোকানে বসে ট্যাক্সিচালকদের সঙ্গে অনেক আলাপ হয়েছিল। দোকানমালিকের ছেলে মুসা তখন পড়ালেখার সঙ্গে সঙ্গে বাবাকে সাহায্য করে কাজে। আমার মূল উদ্দেশ্য ছিল মুসাকে খুঁজে বের করা। গত বছর যখন এসেছিলাম, তখন কারফিউ থাকার কারণে হাউসবোট থেকে ঝুঁকি নিয়ে শুধু দুবার বের হয়েছিলাম।

মুসার চায়ের দোকানের আড্ডা
ছবি: লেখক

মুসাকে পেলাম আগের জায়গায়, একটুও বদলায়নি। সে রকমই উচ্ছ্বসিত। চা, সমুচা খাওয়াল। সন্ধ্যা হয়ে আসছিল, তাই ফেরার তাড়া ছিল। কারণ, ঠান্ডা পড়েছে খুব আর আমি বোলভার্ড রোড মানে ডাল লেকের সঙ্গের রোডে একটা হস্তশিল্পের দোকানে যেতে চাইছিলাম। দোকানটার মালিক আকবর আঙ্কেল। কয়েক বছর আগে হাতে এমব্রয়ডারি করা জামা, ব্যাগ, ওয়াল হ্যাংগিং কিনেছিলাম। কয়েক দিন আগে কল করেছিলাম, জানলাম তার দোকান খোলা আছে। এবার আমার কিছু কেনার নেই। শুধু মানুষগুলোর সঙ্গে দেখা করাই মূল উদ্দেশ্য। কে জানে আবার দেখা হয় কি না!
আকবর আঙ্কেলের দোকান প্রায় বন্ধ হয়েই যাচ্ছিল, যখন আমি পৌঁছালাম। একথা–সেকথায় আধা ঘণ্টা পার হলো। আশপাশে সব দোকান এর মধ্যে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মানুষ দেখার, চেনার, তাদের জীবন জীবিকা জানার কৌতূহল শেষ হওয়ার নয়।

কাশ্মীরের বিখ্যাত হস্তশিল্প
ছবি: লেখক

এখানকার হাউসবোট অ্যাসোসিয়েশনের সব সদস্যই হাউসবোটে সপরিবারে থাকেন। জলে ভাসমান জীবন তাঁদের, তবুও কত স্বাভাবিক।

কাশ্মীরি কার্পেট
ছবি: লেখক

যে উদ্যেশ্যে এবার কাশ্মীর আসা, আমার মনের সবচেয়ে কাছের স্থান প্যাহেলগাম যাওয়া বাস্তবে পরিণত হচ্ছে একটু বাদেই। হাউসবোটের সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শিকারায় বসলাম। হুসেইন আঙ্কেল নিজেই নিয়ে এলেন ডাল গেটে নৌকা বেয়ে। অনেক আগে আমের এসে অপেক্ষা করছে ডাল গেটে আমার জন্য গাড়ি নিয়ে। আঙ্কেলকে বিদায় জানিয়ে আমি চললাম প্যাহেলগামের ইন্দ্রজালে আটকে পড়তে।