কাশ্মীরে ফিরে ফিরে

প্লেনের জানালায় মাথা রেখে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। দিল্লি থেকে ফ্লাইট ছিল ভোর পাঁচটায়। দিল্লি এয়ারপোর্টে বসে ছিলাম রাত দুইটা থেকে। যে করেই হোক কাশ্মীর যেতে হবে, প্যাহেলগাম যেতে হবে।

গত বছর প্যাহেলগাম যাওয়ার পরিকল্পনা ভেস্তে গিয়েছিল কারফিউ থাকার কারণে। শুধু শ্রীনগরে হাউসবোটে রোমাঞ্চকর সাত দিন পার করেছি। এবার করোনা পরিস্থিতির কারণে ভ্রমণে বিস্তর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু যার জন্য প্রাণ ছটফট করে তাকে দেখার ইচ্ছে কেউই দমিয়ে রাখতে পারে না।

করোনাকালীন ভ্রমণের নিয়ম অনুযায়ী গত দুই সপ্তাহে তিনবার কোভিড-১৯ টেস্ট করিয়েছি। কিন্তু তা–ও প্লেনের সিটে বসলাম দুরু দুরু বুকে। না, করোনা পজিটিভ হওয়ার ভয়ে নয়। শ্রীনগর এয়ারপোর্টে যদি টেস্টের রিপোর্ট পজিটিভ আসে! তাহলে তো এবারও প্যাহেলগাম যাওয়া হবে না। প্যাহেলগাম আমার কাছে যেকোনো জায়গার চেয়ে প্রিয়, প্রাণের খুব কাছাকাছি জায়গা। পৃথিবীর যেখানেই টো টো করে ঘুরে বেড়াই না কেন, আমার কাছে কাশ্মীরই শ্রেষ্ঠ।

প্লেনে কোনো ভ্রমণকারী যাত্রী নেই। বেশির ভাগ কাশ্মীরের নাগরিক আর বাকিরা এসেছেন বিহার, উত্তর প্রদেশ থেকে কাজ করতে। প্লেনে সিট কিন্তু ফাঁকা নেই। এয়ারলাইনস কোম্পানি পিপিই, মাস্ক, ফেসশিল্ড পরিয়ে, হাতে সেনিটাইজার গছিয়ে দিয়ে তবেই প্লেনে ঢুকিয়ে উড়াল দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। সবাই যেন একেকজন স্পেস শিপের যাত্রী। ঘাড় নাড়াতে গেলেও রোবটের মতো আচরণ করতে হবে।

প্ল্যান ল্যান্ড করার পর কিছু ফরমালিটি করতে হয়। দেখা গেল ট্যুরিস্ট ডেস্কের সামনে আমি একা দাঁড়িয়ে আছি। এদের সঙ্গে বোঝাপড়া শেষ করে পাঠিয়ে দিল পরের কক্ষে কোভিড-১৯ টেস্ট করাতে। কয়েক সেকেন্ডে স্যাম্পল নেওয়া হয়ে গেল। আমি অপেক্ষা করেছিলাম ৩–৪ মিনিটের মতো।

শ্রীনগরে রাস্তায়
ছবি: লেখক

এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষের একজন বললেন, ‘দাঁড়িয়ে আছেন কেন?’
আমি বললাম, ‘রিপোর্ট না পেলে যাব কীভাবে?’
তিনি হেসে বললেন, ‘রিপোর্ট হয়ে গেছে, পজিটিভ হলে আমরা আটকে রাখি, নেগেটিভ হলে চলে যেতে দেই।’
কয়েক মিনিটের মধ্যে মুক্তির স্বাদ মিলল, মনে হলো যেন আমাকে কয়েক বছর আটকে রাখা হয়েছিল।
আগে থেকে ফোন করে হুসেইন আংকেলকে বলা ছিল, তিনি গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন নিশ্চয়ই।

হুসেইন আংকেল ও তাঁর পরিবার কাশ্মীরে আমার সুখ–দুঃখের সাথি। ডাল লেকে হাউসবোটের মালিক। কয়েক বছর আগে প্রথম তাঁর হাউসবোটে উঠি, তখন থেকেই সখ্য। শ্রীনগরে আমার স্থায়ী ঠিকানা।

আংকেল পরিবার নিয়ে নিজেও থাকেন পাশের হাউসবোটে। বাইরে তখন ঠান্ডার ঝাপটা এসে গায়ে লেগেছে। নভেম্বর মাস, বরফ পরবার আগমুহূর্তের ঠান্ডা। ঢাকা, কলকাতা, বেঙ্গালুরু, দিল্লির গরম আবহাওয়া (কাশ্মীরের আবহাওয়ার ভাষায়) গায়ে মেখে এলে এখন নাক, মুখ, হাত ঠান্ডায় জমে যাবেই।

ডাল লেক
ছবি: লেখক

গাড়ি পার্কিংয়ের স্থানে দুটি গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। ততক্ষণে অন্য যাত্রীরা এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে পড়েছেন। একটা বাচ্চা ছেলে আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল, ‘আপনি কি ফাতিমা? হুসেইন আংকেল আমাকে পাঠিয়েছেন।’ আমি ভাবলাম হয়তোবা ড্রাইভারের সঙ্গে এসেছে। গাড়িতে বসে দেখি ছেলেটি নিজেই স্টিয়ারিং ধরে আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী নাম তোমার?’
‘আমের।’
‘আমের, তুমি কি হুসেইন আংকেলের আত্মীয় হও?’
‘না।’
‘তাহলে এত সকালে আমাকে পিক আপ করতে এলে যে। দেখে তো ট্যাক্সিচালক বলে মনে হচ্ছে না। আর কত বয়স তোমার? ১৭–১৮? লাইসেন্স আছে?’

আমি ভাবলাম আংকেল তো কখনো বাচ্চা কোনো ছেলেকে পাঠায় না। এ নিশ্চয়ই ট্যাক্সিচালক নয়। দেখতেও একদম ইরানি সিনেমার চকলেট হিরোর মতো।
আমের বলল, ‘আমিই ট্যাক্সিচালক। আমার বয়স ২৩।’
আমি চুপ হয়ে গেলাম। হাউসবোটে গিয়ে আংকেলের সঙ্গে কথা হবে এ ব্যাপারে। আমের আমাকে ডাল গেটে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল।

ডাল লেকের শিকারা। এ সবে চড়েই হাউস বোটে যেতে হয়
ছবি: লেখক

এখান থেকে নৌকা বা শিকারা ধরে হাউসবোটে যেতে হয়। পানির ওপর নৌকার জীবন আমি খুব উপভোগ করি, স্বাভাবিক জীবন থেকে একদম আলাদা। শ্রীনগরে বেড়াতে আসা কোনো ভ্রমণকারী হাউসবোটে থাকার অভিজ্ঞতা খোয়াতে চান না। বাইরে যেমন ঠান্ডা, ডাল লেকের জলের কাছাকাছি ঠান্ডা দ্বিগুণ। এখন সকাল নয়টা, বাইরের তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অথচ এর কোনো কিছুই ডাল লেককে স্পর্শ করতে পারছে না। সে আছে শান্ত, স্থির নয়ন মেলে।

করোনার কারণে এখানকার স্কুল–কলেজ বন্ধ। অবশ্য গত বছরের আগস্ট মাসে কারফিউ জারি করার পর যে বন্ধ হয়েছে আর খোলেনি। সে জন্য ডাল লেকেও শিকারার আনাগোনা কম। লেকে বসবাসকারী শিশুরা শিকারা বেয়ে স্কুল–কলেজে যায়।

হাউসবোটে পৌঁছে যথারীতি সাদর সম্ভাষণ জানাল আংকেল ও তার দুই পুত্র। মেয়েরা সাধারণত ঘর থেকে বের হয় না তেমন। তাই আমি ভেতরে গিয়ে আন্টি ও তাঁদের মেয়ের সঙ্গে দেখা করলাম। কাশ্মীরে গত বছর থেকেই পড়ালেখা বন্ধ, তাই ছেলেমেয়েরা সবাই ঘরে বসে আছে।

এবার হাউসবোটের অন্য দুই রুমের অতিথি দিল্লি ও মুম্বাই থেকে আসা দুজন মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হলো। কনিকা একজন সাংবাদিক। কাজ করে কাশ্মীর অবজারভার পত্রিকায়। আপাতত এই হাউসবোটই তার ঘরবাড়ি এখন, এখানে আছে মাসখানেক ধরে। আরেকজনের নাম দিব্যা, মুম্বাইয়ে আমেরিকান কোম্পানিতে কাজ করে। কাশ্মীরি ছেলের প্রেমে পড়েছে, তাই এসেছে দেখা করতে।

শ্রীনগরের মানুষ
ছবি: লেখক

আমি ভারতে নারী সোলো ট্রাভেলার এই প্রথম দেখছি যে তা নয়৷ আগেও বিভিন্ন জায়গায় দেখেছি। আমাদের দেশে ভারত ভ্রমণ সম্পর্কে যে ভীতি কাজ করে, তা আসলে দেশে রেখে আসাই কল্যাণকর। কারণ, আমি ভারতের প্রতিটি প্রদেশে ঘুরে বেড়িয়েছি একা, একা হোটেলে থেকেছি, একা ট্যাক্সি করে বহু দূরের পথ পাড়ি দিয়েছি।
নাশতার পর দেখি বাজে সবে সকাল দশটা৷ ঠিক করলাম আজকের দিনটায় পুরো শ্রীনগর শহর ঘুরে বেড়াব। আংকেলকে বলতেই তিনি দেখি আমেরকে ফোন করে আনালেন। আমি বললাম, ‘আংকেল আমের তো খুব ছোট, অন্য কোনো ড্রাইভার নেই?’

তিনি বললেন, ‘তোমার মেহরাজের কথা মনে আছে? তিন বছর আগে যখন এসেছিলে, তখন মেহরাজের ট্যাক্সি চড়ে তুমি ঘুরে বেড়িয়েছিলে। মেহরাজ দুই মাস আগে ইন্তেকাল করেছেন। আমের তারই ছেলে। সংসারের হাল ধরেছে এখন। ছেলেটা খুবই সাবধানে গাড়ি চালায়।’

মেহরাজ আংকেলের মৃত্যুসংবাদ শুনে আঁতকে উঠলাম। আমাকে অনেক জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন। ট্যাক্সিচালক সম্পর্কে তাই আর কথা বাড়ালাম না। শিকারায় ডাল লেক গেটে এসে দেখি আমের দাঁড়িয়ে আছে।

চিনার গাছ
ছবি: লেখক

উঠে পড়লাম ট্যাক্সিতে। প্রথমে শালিমার গার্ডেন যাব বলে ঠিক করলাম। কাশ্মীরে করোনায় মৃত্যুহার খুবই কম বলে শহরে তেমন কোনো বিধিনিষেধ নেই। প্রায় মানুষই মাস্ক পরে নেই। আর জনসংখ্যা কম বলে রোগ ছড়াতেও পারেনি।

শহরের চিনার গাছগুলো খুব করে সাজে এ সময়। পুরো শহরে উৎসবের আমেজ এনে দেয়। কৃত্রিম সজ্জা ছাড়াই সে অপার্থিব।

শ্রীনগরের রাস্তার দুই ধারে চিনার গাছের সারি। কিছু পাতা হলুদ হয়েছে, কিছু কমলা, কিছু এখনো সবুজ আছে। কয়েক দিন পর সব ঝরে যাবে। তখন বরফ পরবে জোরেশোরে। চিনার গাছকে আমার কাশ্মীরি বটগাছ বলে মনে হয়। বিশাল বাহু ছড়িয়ে ছায়া দিচ্ছে, মায়ায় জড়িয়ে আছে কাশ্মীরের জনজীবন।

আমি আমেরকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি শালিমার গার্ডেনের গল্পটা জানো?
আমের লাজুক হেসে বলল, না।