ভ্রমণের অভিজ্ঞতায় যুক্ত হয় অনেক কিছুই। কেবল দেখার সুখ নয়, মানুষের সুখদুখও এই অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করে। গ্রিসের থেসালুনিকি ভ্রমণে সেটাই হয়েছে লেখকের। একই সঙ্গে তিনি উল্লেখ করেছেন সে দেশের কৃষিকাজের জন্য জনশক্তি রপ্তানির সম্ভাবনার কথাও।
পুরো থেসালুনিকি ভ্রমণে আমাকে সঙ্গ দিয়েছিলেন মনিউর রহমান ভাই। জানতে চেয়েছিলাম, কেমন আছে থেসালুনিকিতে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা?
এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, রাজধানী এথেন্সের তুলনায় থেসালুনিকিতে জীবনযাত্রা অনেকটা সহজ। তা ছাড়া এথেন্সে প্রায়ই প্রবাসী বাংলাদেশিদের অনেকে পাকিস্তানি কিংবা আফগানি অথবা আরবদের দ্বারা হামলার শিকার হন। থেসালুনিকিতে এ সমস্যা খুব বেশি একটা প্রকট নয়। বর্তমানে তাই এথেন্সের পাশপাশি অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি বসবাসের জন্য থেসালুনিকিকে বেছে নিচ্ছেন।
বাংলাদেশ সরকার চাইলে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে মৌসুমভিত্তিক কৃষিকাজে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রপ্তানির জন্য গ্রিসের সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করতে পারে।
থেসালুনিকিতে বর্তমানে বাংলাদেশি মালিকানাধীন বেশ কিছু দোকান রয়েছে; এমনকি বাংলাদেশিদের পরিচালিত একটি মসজিদও আছে। আমরা দুপুরে সে মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে গ্রিস এবং স্লোভাকিয়ায় স্বীকৃত কোনো মসজিদ নেই। কয়েকজন মুসল্লি একত্র হয়ে কোনো একটা বাড়ির নিচের অংশ ভাড়া নিয়ে মসজিদের কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগেও থেসালুনিকিসহ বর্তমান গ্রিসের বিভিন্ন অংশে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ ছিল মুসলমান। প্রায় ৫০০ বছর গ্রিস শাসন করেছিল তুরস্কের অটোমান সুলতানেরা। অটোমান শাসন আমলে গ্রিসের বিভিন্ন স্থানে নির্মিত হয়েছিল অসংখ্য মসজিদ। আজকের দিন গ্রিসে গেলে এসব মসজিদ খুঁজে বের করাটা কষ্টসাধ্য হবে। বলকান যুদ্ধের পর আনুষ্ঠানিকভাবে আধুনিক গ্রিস রাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশ ঘটলে এসব মসজিদ তো বটে এমনকি অটোমানদের স্মৃতি বহন করে এমন সব নিদর্শন সে সময় গ্রিস সরকার ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টা করে। অনেক মসজিদকে চার্চে রূপান্তর করা হয়; অনেক মসজিদকে আবার জাদুঘর কিংবা পানশালা অথবা থিয়েটারে পরিণত করা হয়।
গ্রিক জাতীয়তাবাদে তুরস্ক এক চিরবৈরীর প্রতিশব্দ। গত শতাব্দীর আশির দশকের পর গ্রিসে পাড়ি জমানো আফ্রিকান ও আরব অভিবাসী মুসলমানদের অনেকে চেষ্টা করে আসছেন অন্তত রাজধানী এথেন্সে নিজেদের জন্য একটি মসজিদ নির্মাণ করার। বিভিন্ন সময়ে গ্রিস সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে তাঁদের আশ্বাস দেওয়া হলেও দেশটিতে আনুষ্ঠানিকভাবে মসজিদ নির্মাণের বিষয়টি এখনো ঝুলে আছে। গ্রিসের সাধারণ মানুষের অনেকে মসজিদের সঙ্গে তুরস্ক এবং অটোমান সাম্রাজ্যের সম্পর্ক খোঁজে; এ কারণে হয়তো স্বাধীনতা অর্জনের এক শ বছরের মধ্যে দেশটিতে কোনো মসজিদ নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয়নি।
পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর তুলনায় গ্রিসের সমাজব্যবস্থা অনেকটা রক্ষণশীল। দেশটির মানুষের জীবনে এমনকি গ্রিসের রাজনীতিতেও ধর্মের বড় প্রভাব রয়েছে, যেটা সচরাচর পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতে দেখা যায় না। প্রতিটি বাড়ি, দোকান কিংবা রেস্তোরাঁয় গেলে দেখা মিলবে যিশুখ্রিষ্টের ছবি।
মনিউর রহমানের ডাকনাম সুমন। আমি সুমন ভাই বলি। তিনি আরও বললেন, থেসালুনিকির অবস্থান মেসিডোনিয়া এবং বুলগেরিয়ার সীমান্তের অনেকটা নিকটে; তুরস্কের সীমান্তবর্তী অঞ্চল থেকে শুরু করে গোটা উত্তর গ্রিসে থেসালুনিকি সবচেয়ে বড় নগরী; তাই প্রায়ই এ শহরটিকে ঘিরে বিভিন্ন ধরনের মানব পাচারের অভিযোগ ওঠে। এ কারণে এ শহরে পুলিশের তৎপরতা থাকে অনেক বেশি।
এ ছাড়া তুরস্ক কিংবা বুলগেরিয়া অথবা মেসিডোনিয়া থেকে যেসব অভিবাসনপ্রত্যাশী গ্রিসে প্রবেশ করেন, তাঁদের অনেকেরই প্রথম গন্তব্য থাকে থেসালুনিকি। ফলে এ শহরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশসহ পাকিস্তান, আফগানিস্তান কিংবা বাংলাদেশের অনেক অভিবাসনপ্রত্যাশীর দেখা মেলে। কেউ গ্রিসে থেকে যান, অনেকে আবার মেসিডোনিয়া হয়ে সার্বিয়া এবং বসনিয়া-হার্জেগোভিনার মধ্য দিয়ে ক্রোয়েশিয়া এবং ক্রোয়েশিয়া থেকে স্লোভেনিয়া হয়ে ইতালি, স্পেন, ফ্রান্সসহ পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতে পাড়ি জমানোর জন্য এক ভয়ংকর জীবনযুদ্ধে পা রাখেন।
মানোলাদাতে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের দুরবস্থার কথা তুলে ধরে তাই তিনি বাংলাদেশ সরকারের নিকট অনুরোধ জানিয়েছেন যাতে তাঁদের প্রাপ্য অধিকারটুকু নিশ্চিতের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে তাঁদের সহায়তা করা হয়।
সুমন ভাইয়ের সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে আর গল্প করতে করতে কীভাবে যে চোখের পলকে সময় কেটে গেল সেটা টেরই পেলাম না। স্থানীয় এক পাকিস্তানি রেস্তোরাঁয় আমরা দুপুরে খেয়ে নিই। সেখানে আরও এক বাংলাদেশি ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনিও সিলেটের মানুষ। খুব বেশি দিন হয়নি থেসালুনিকিতে এসেছেন। এর আগে তিনি মানোলাদাতে বসবাস করতেন। মানোলাদা রাজধানী এথেন্স থেকে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার দূরের ছোট একটি গ্রাম। এ গ্রামে বসবাসরত অভিবাসীদের সিংহভাগই বাংলাদেশি। আনুমানিক ১০ হাজারের মতো বাংলাদেশি মানোলাদাতে বসবাস করেন বলে তিনি জানান। তাঁরা মূলত মৌসুমভিত্তিক কৃষিকাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেন।
তিনি আরও জানালেন, যেহেতু মানোলাদাতে কয়েক হাজার অভিবাসী শ্রমিকের সমাগম, তাই সেখানে কাজের ক্ষেত্রে প্রত্যেক মালিকের একেকজন বাংলাদেশি মাস্তুরা বা ফোরম্যানের আওতায় ৫০ থেকে ৫০০ জন পর্যন্ত লোক কাজ করে থাকেন। আগত সব প্রবাসীদের কতিপয় মস্তুরা বা ফোরম্যানরা নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। তাঁদের কাজের হিসাব, থাকা–খাওয়া এবং মজুরি বণ্টন থেকে শুরু করে সবকিছু এই মাস্তুরাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। মালিক তাঁর অধীনে কাজ করা সব শ্রমিকদের দেখভাল করার জন্য একজন মাস্তুরা নিয়োগ দিয়ে থাকেন। শ্রমিকদের যাবতীয় মজুরি এ মাস্তুরার মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়। যে শ্রমিকেরা এখানে কাজ করেন, তাঁদের বেশির ভাগই তেমন একটা গ্রিক ভাষায় পারদর্শী নন। অন্যদিকে মাস্তুরাদের প্রায় সবাই গ্রিক ভাষায় পারদর্শী হয়ে থাকেন।
অন্যদিকে গ্রিসে পাড়ি জমানো অভিবাসীদের অনেকের কাছে বৈধ কাগজপত্র থাকে না। এসব দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে মাস্তুরারা অভিবাসী শ্রমিকদের ওপর বিভিন্ন ধরনের অত্যাচার চালান। তাঁদের ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত করা হয়। মালিকের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের জন্য যে মজুরি কিংবা বোনাস ধার্য করা হয়, অনেক সময় তার প্রায় পুরোটা চলে যায় এসব মাস্তুরার পকেটে। কেউ প্রতিবাদ করলে তাঁকে অনেক সময় শারীরিকভাবে লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়। মানোলাদাতে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের দুরবস্থার কথা তুলে ধরে তাই তিনি বাংলাদেশ সরকারের নিকট অনুরোধ জানিয়েছেন যাতে তাঁদের প্রাপ্য অধিকারটুকু নিশ্চিতের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে তাঁদের সহায়তা করা হয়।
এ ছাড়া তিনি বলেছেন যে বাংলাদেশ সরকার চাইলে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে মৌসুমভিত্তিক কৃষিকাজে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রপ্তানির জন্য গ্রিসের সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করতে পারে। হয়তোবা খুব সামান্য সময়ের জন্য এ দুজন মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে, কিন্তু এ দুজন মানুষের আন্তরিকতা আমাকে এতটাই মুগ্ধ করেছে, আমার যেন ফেরার সময় এ দুজনকে কোনোভাবেই বিদায় বলতে ইচ্ছা করছিল না; বারবারই থেসালুনিকিতে থেকে যেতে ইচ্ছা করছিল।
করোনাকালে বরেণ্য মানুষদের দেশেএই ছিল মোটামুটি থেসালুনিকির পর্ব। এরপর সেদিন সন্ধ্যা সোয়া ছয়টার ট্রেনে থেসালুনিকি থেকে রাজধানী এথেন্সের উদ্দেশে রওনা দিই। থেসালুনিকি থেকে এথেন্সের দূরত্ব ৫০০ কিলোমিটারের কাছাকছি। ট্রেনে থেসালুনিকি থেকে এথেন্স পৌঁছাতে পাঁচ ঘণ্টার মতো সময় লাগে। যাতায়াত খরচ ৪৩ ইউরো। করোনার প্রভাব দেখা গিয়েছিল গোটা ট্রেনযাত্রায়। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার জন্য ট্রেনের অর্ধেক সিট ফাঁকা রাখা হয়েছিল। ট্রেনের আসন বণ্টন এভাবে করা হয়েছিল যদি কোনো সিটে যাত্রী বসে থাকে, তাহলে তাঁর পাশের সিটটি ফাঁকা রাখার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। দুজন যাত্রীকে মুখোমুখি না বসিয়ে কোনাকুনিভাবে বসানো হয়েছিল। পুরো ট্রেনযাত্রায় সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরতে হয়েছিল।
গ্রিসের আইন অনুযায়ী গণপরিবহনগুলোতে মাস্ক না পরলে ১৫০ ইউরো জরিমানা গুনতে হয়; যদিও গ্রিস কিংবা বলকান দেশগুলোর মানুষ আইনের প্রতি তেমন একটা শ্রদ্ধাশীল নয়। আরও একটা জিনিস আমার কাছে আশ্চর্য লেগেছে, গ্রিসে সময়ের ব্যাপারে মানুষজনের তেমন একটা মাথাব্যথা নেই। তাই সোয়া ছয়টায় ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও সেটা যেমনভাবে সঠিক সময়ে ছেড়ে যেতে পারেনি, অন্যদিকে এথেন্স পৌঁছাতেও নির্ধারিত সময়ের চেয়ে এক ঘণ্টা বিলম্ব হয়েছিল।
লেখক: শিক্ষার্থী, ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন ফিজিকস অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিকস, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিসা, স্লোভেনিয়া।