চীনের গুয়াংজু ইয়ুসিউইউ পার্কে যেন আলোর মেলা বসেছে। যেদিকে চোখ যায়, শুধু রংবেরঙের আলোর খেলা। মুহূর্তেই যে কাউকে মোহাবিষ্ট করে ফেলে। আলোর সাজে ফুল, ফল, পাখি, বৃক্ষ, ড্রাগন যেন চীনের প্রাচীন সংস্কৃতিকেই ফুটিয়ে তুলতে প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
পার্কের মাঝে বিভিন্ন বয়সী চীনারা ফানুস ওড়াচ্ছে। ফানুসগুলোকে সুন্দরভাবে সজ্জিত করা হয়েছে। এগুলোর অধিকাংশই কাল্পনিক প্রাণী ও ফুলের ছবিতে অলংকৃত। এই ফানুসগুলো ভাগ্যের প্রতীক হিসেবে প্রায় সব সময় লাল রঙের থাকে। এর মাঝে দেখা গেল একদল তরুণী মোহনীয় সংগীতের তালে তালে হেঁটে বেড়াচ্ছে, কেউ কেউ ধাঁধার মতো একধরনের খেলা খেলছে আবার বড় একদল সুন্দর সাজপোশাক পরে ড্রাগননৃত্যে অংশ নিয়েছে।
স্থানীয় একজন জানাল, চীনা আলোক উৎসবে ড্রাগননৃত্য অন্যতম প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী লোকনৃত্য। এটি চীনের হান ডাইনেস্টির (১৮০-২৩০ এডি) গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাই প্রাচীন চীনের লোকজন ড্রাগনকে সাহসিকতা ও শক্তির প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করত এবং বিশ্বাস করত, এটি মন্দ সবকিছুকে দূরে সরিয়ে মানুষ এবং তাদের গৃহপালিত পশুপাখিকে সুরক্ষা দিতে পারে। তাই মন্দ কিছু থেকে রক্ষা পেতে সৌভাগ্য ও সুরক্ষার জন্য প্রার্থনার অংশ হিসেবে চীনের গুরুত্বপূর্ণ উৎসবসহ আলোক উৎসবেও ড্রাগননৃত্য পরিবেশন করা হয়।
ড্রাগননৃত্যের জন্য দুজন উচ্চ প্রশিক্ষিত ও দক্ষ অভিনয়কারী মূল ভূমিকা পালন করে। একজন মাথা এবং অন্যজন পা হিসেবে কাজ করে। কোরিওগ্রাফারের নির্দেশনায় ড্রাগন ড্রাম, গং ও সিম্বলগুলো বাজানোর জন্য নাচে। কখনো কখনো তারা লাফিয়ে, চক্রাকারে ঘুরে এবং সরু দণ্ড বা দড়িতে হাঁটার মতো কঠিন কাজ করে নৃত্য প্রদর্শন করে থাকে। ড্রাগননৃত্য ও অভিনয় আসলেই ভীষণ মনোমুগ্ধকর এবং দর্শকেরা তুমুল হাততালির মাধ্যমে তাদের আনন্দের বহিঃপ্রকাশ করছিল। জানতে পারলাম এই ঐতিহ্যবাহী ড্রাগননৃত্য চীনের গণ্ডি ছাড়িয়ে আরও অনেক দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এটি মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুরের মতো দেশে বেশ জনপ্রিয়। ইউরোপ ও আমেরিকায় বসবাসকৃত চীনা সম্প্রদায়গুলো প্রতি বসন্ত উৎসব, আলোক উৎসব এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান উদ্যাপনে ড্রাগননৃত্য আয়োজন করে থাকে।
যাহোক, আলোক উৎসবে কাউকে কাউকে দেখা গেল রঙিন লন্ঠন হাতে নিয়ে এতে কাগজের ছোট ছোট নোট বেঁধে দিচ্ছেন। কাছে গিয়ে জানা গেল, এতে তাঁরা ধাঁধা লেখেন। ধাঁধাটি অনুমান করার জন্য লোকজন ভিড় করে আছে। যদি কেউ মনে করে তাদের কাছে সঠিক উত্তর আছে, তবে তারা ধাঁধাটি টানে এবং লন্ঠনের মালিকের কাছে তাদের উত্তরটি পরীক্ষা করতে পারে। উত্তরটি যদি সঠিক হয়, তবে পুরস্কার হিসেবে সুন্দর উপহার দেওয়া হয়। উপহারে চকলেট, বিস্কুট এবং আলোয় মোড়ানো কৃত্রিম ফুল থাকে।
ধাঁধা অনুমানের এই খেলা চীনের সব সামাজিক স্তরের মধ্যে আকর্ষণীয় এবং তথ্যবহুল হিসেবে ভীষণ জনপ্রিয়। জানা গেল, আলোক উৎসবে এই ধাঁধার খেলা শুরু হয় সান রাজবংশের (৯৬০-১২৭৯ এডি) সময় থেকে। এখনো এটি আলোক উৎসবের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং জনপ্রিয় খেলা।
ইতিমধ্যে আলোক উৎসবের বিশাল ব্যাপ্তি ও নানা আয়োজনে চোখ ধাঁধিয়ে উঠেছে। এর মাঝে চীনা বন্ধু ওয়ানহ বড় বড় দুটি কাপে চা নিয়ে হাজির হলো। চারপাশের আলোর বর্ণময়তার মাঝে সবুজ গাঢ় চা পান করতে করতে গল্প জমে উঠল। বন্ধু জানাল ল্যান্টার্ন ফেস্টিভ্যাল বা আলোক উৎসবকে চীনে সানগুয়্যান ফেস্টিভ্যাল নামে ডাকা হয়। এটি মূলত লুনিসোলার চায়নিজ ক্যালেন্ডারে প্রথম মাসে আয়োজন করা হয়। সাধারণত গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে ফেব্রুয়ারি বা মার্চের শুরুর দিকে পড়ে এই সময়টা।
আলোক উৎসবের উৎস নিয়ে বিভিন্ন বিশ্বাস রয়েছে। তবে বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, ২০০০ বছর আগে সম্রাট মিংয়ের হান রাজবংশে এই প্রথার সূচনা হয়। বৌদ্ধধর্মে বিশ্বাসী সম্রাট মিং লক্ষ করেছিলেন যে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা প্রথম চান্দ্রমাসের পঞ্চদশ দিনে মন্দিরে লন্ঠন ও প্রদীপ জ্বালাতেন। ফলস্বরূপ তিনি সন্ধ্যায় সমস্ত পরিবার, মন্দির এবং রাজকীয় প্রাসাদকে আলোকিত করার জন্য লন্ঠন ও প্রদীপ জ্বালানোর নির্দেশ দেন। সেখান থেকেই এটি একটি লোকরীতিনীতিতে পরিণত হয়েছিল।
বন্ধু ওয়ানহকে যেন গল্পের আসরে পেয়ে বসেছে। এদিকে আমিও মন্ত্রমুগ্ধ শ্রোতার মতো শুনেই যাচ্ছি। বন্ধু এবার এই উৎসব ঘিরে নানান কিংবদন্তির কথা শোনাতে লাগল। তাইওয়ানের কিংবদন্তি অনুসারে এটি ছিল প্রাচীনকালে স্বর্গের দেবতা তাইয়ির উপাসনা করার সময়। বিশ্বাস ছিল যে তাইয়ি বিশ্বের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাঁর ইশারায় এবং ডাকে ১৬টি ড্রাগন সাড়া দিত। তিনি সেই ১৬টি ড্রাগন দিয়ে মানুষের ওপর খরা, ঝড়, দুর্ভিক্ষ বা মহামারি দিয়ে পরীক্ষা নিতেন। তাই সম্রাট কিন শি হুয়াং থেকে শুরু করে অন্যান্য সম্রাটও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে দেবতা তাইয়িকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য প্রতিবছর একটা নির্দিষ্ট সময়ে আলোক উৎসব আয়োজন করার। দেবতা তাইয়ির কাছে সম্রাট ও জনগণ এই উৎসবের মধ্য দিয়ে অনুকূল আবহাওয়া এবং সুস্বাস্থ্য চাইতেন।
আরেকটি কিংবদন্তি অনুসারে টিয়ানগুয়ান হলেন সৌভাগ্যের দেবতা। তাঁর জন্মদিনটি প্রথম চান্দ্রমাসের ১৫তম দিনে পড়ে। বলা হয়ে থাকে যে টিয়ানগুয়ান সব ধরনের বিনোদন পছন্দ করেন, তাই অনুগামীরা বিভিন্ন ধরনের আয়োজনের মাধ্যমে তাঁর কাছে সৌভাগ্যের জন্য প্রার্থনা করে। আরও জানা যায়, ল্যান মুন নামের এক প্রাচীন যোদ্ধার সঙ্গে আরেকজন সহযোগী ছিলেন, যিনি প্রাচীন চীনে অত্যাচারী রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ঝড়ের কবলে তিনি নিহত হন এবং সফল বিদ্রোহীরা তাঁর নামে এই উৎসব স্মরণ করা শুরু করে।
আরও একটি কিংবদন্তি অনুসারে জানা যায় যে একটি সুন্দর সারস পাখি স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে নেমেছিল। এটি পৃথিবীতে নেমে আসার পর কিছু গ্রামবাসী একে শিকার এবং হত্যা করে। এতে স্বর্গে বসে জেড সম্রাট রেগে গেলেন। কারণ, সারসটি তাঁর প্রিয় ছিল। সুতরাং তিনি ১৫ চান্দ্রদিবসে গ্রামটিকে ধ্বংস করতে আগুনের ঝড়ের পরিকল্পনা করেছিলেন। তবে জেড সম্রাটের কন্যা তাঁর বাবার পরিকল্পনার কথা গ্রামবাসীকে জানানোর ব্যবস্থা নিলেন। তবে গ্রামের লোকজন জানত না যে কীভাবে তারা তাদের আসন্ন ধ্বংস থেকে বাঁচতে পারে। তবে অন্য গ্রামের একজন জ্ঞানী ব্যক্তি পরামর্শ দিয়েছিলেন যে প্রতিটি পরিবারকে তাদের বাড়ির চারপাশে লাল লন্ঠন ঝোলানো উচিত এবং ১৪, ১৫ ও ১৬ চান্দ্রদিবসে পটকা ফোটানো উচিত।
এটি জেড সম্রাটকে গ্রামে আগুন দেওয়া থেকে ঠেকাতে পারবে। পঞ্চদশ চান্দ্রদিনে স্বর্গ থেকে সম্রাট তাঁর বাহিনী পাঠিয়ে জানতে পারলেন গ্রামটি ইতিমধ্যে জ্বলছে। সন্তুষ্ট জেড সম্রাট সিদ্ধান্ত নিলেন যে গ্রামটিকে আর তিনি নতুন করে পোড়াবেন না। সেই দিন থেকে লোকজন প্রতিবছর পঞ্চদশ চান্দ্রদিবসে রাস্তায় ফানুস উড়িয়ে ও আতশবাজি ফুটিয়ে এই উৎসব উদ্যাপন করে।
আলোক উৎসবের কিংবদন্তি ও নানা রকম অধ্যায় শুনতে শুনতে ক্ষুধার রাজ্যে ডাক এল। বন্ধুও মনে হয় খানিকটা বুঝতে পেরে আমাকে আলোক উৎসবের পাশেই আয়োজিত ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গুয়ান খাওয়াতে নিয়ে চলল। এটি মূলত চালের আটার ডো, যার মধ্যে মিষ্টি লাল শিম, তিল ও চিনাবাদামের মাখনের পেস্ট দিয়ে ভরা থাকে। এটিকে চীনারা ভেজে, পানি বা বাষ্পে সেদ্ধ করে বিভিন্ন স্যুপ ও সস দিয়ে খায়। চীনারা বিশ্বাস করে যে টাঙ্গুয়ান বলগুলো এবং বাটিগুলোর বৃত্তাকার আকৃতি পারিবারিক মিলনের প্রতীক।
টাঙ্গুয়ান খাওয়া নতুন বছরের জন্য পারিবারিক সম্প্রীতি, সুখ এবং ভাগ্য বয়ে আনতে পারে। স্যুপ ও টাঙ্গুয়ান খেতে খেতে বন্ধুর সঙ্গে উপভোগ্য আড্ডা, আকাশের চকচকে চাঁদ, উড়ন্ত ফানুস, চারপাশের উজ্জ্বল-বর্ণিল পরিবেশ গভীর আবেগে এক আলোর জগতে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল।
ছবি: লেখক