হিমালয়ে হিমবাহে ১
হিমালয়ের হাতছানি
৬৩ বছর বয়সে এসে হিমালয়ের প্রেমে পড়েন ইফতেখারুল ইসলাম। এভারেস্ট বেসক্যাম্প ভ্রমণ নিয়ে ২০২১ সালে লিখেছেন বই—‘যেখানে এভারেস্ট’। হিমালয়ের ডাকে এ বছরও গিয়েছেন গোকিও। গোকিও রির শীর্ষ থেকে দেখেছেন এভারেস্টসহ বিখ্যাত সব পর্বতশিখর। সে অভিযাত্রার প্রথম পর্ব পড়ুন আজ।
এভারেস্ট অঞ্চলে পর্বতশিখরের আসল সৌন্দর্য দেখতে পাই ট্রেক শুরু করার দুদিন পর থেকে। এভারেস্ট ভিউ হোটেলের বারান্দা থেকে আমরা আগেও অনেক সুন্দর দৃশ্য দেখেছি। অমা ধবলাম ভিউ লজ আর তার সামনের চত্বরটা তার চেয়েও বেশি স্মৃতিময়। এখানে দাঁড়িয়েই আমি এভারেস্টের প্রেমে পড়েছিলাম। পাহাড় এত সুন্দর! দুটি যুগল পর্বতশিখর এত সুন্দর, এত মোহনীয়! শুধু পাহাড়ের দিকেই তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। ক্যামেরার দিকে মুখ ফেরাতে ভালো লাগে না।
নামচেবাজার থেকে অনেকটা চড়াই পেরিয়ে খুমজুং। সেখানে ট্রেকিংয়ের পথ দুই ভাগ হয়ে গেছে। ডান দিকে এভারেস্ট বেজ ক্যাম্প (ইবিসি)–এর পথ চলে গিয়েছে থিয়াংবোচ। আর বাঁ দিকে ওপরে উঠে গিয়েছে গোকিও যাওয়ার পথ। সে পথে কিছুদূর যেতেই পাইনের বন শেষ। ঝাউ ও অন্যান্য ঝোপঝাড়ের সঙ্গে মিশে রয়েছে অসংখ্য ফুলগাছ। তাদের শাখার শিখরে রডোডেনড্রন গুচ্ছ। বেশির ভাগই গোলাপি বা বেগুনি রঙের। নিচে দেখে এসেছি ফুল ঝরে গেছে। কিন্তু এই উঁচুতে মে মাসেও রডোডেনড্রন ফোটার বিরাম নেই।
গোকিওর পথে যাওয়ার আগে অমা ধবলাম ভিউ লজ ও রেস্তোরাঁর সামনের চত্বরটায় বসে খানিকক্ষণ দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। আজ মে মাসের ৯ তারিখের বিষাদিত মেঘলা সকাল। মনে পড়ে দুবছর আগে মার্চের মাঝামাঝি রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে ওখানটাতে বসে অমা ধবলাম দেখে কী রকম মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিলাম। তার আগের দিন নামচে থেকে প্রায় একই জায়গাতে এসে অমা ধবলাম ও এভারেস্ট দেখেছি। ঠিক এখানেই ২০২০ সালে হিমালয়ের প্রেমে পড়েছিলাম আমি।
এভারেস্ট বেসক্যাম্প দেখে আসার পর থেকেই বারবার ফিরে যেতে ইচ্ছে করেছে রডোডেনড্রনের কাছে, পাইন বনে, পাথর ভরা পার্বত্য পথে। তুষার ঢাকা পর্বত শিখরের কাছাকাছি। ইবিসি পর্যন্ত ট্রেক করে ফিরে আসার কথা যত ছোট করে বললাম, বিষয়টা মোটেই অত সরল ছিল না। ২০২০ সালের মার্চে ইবিসি থেকে ফেরার সময় আমরা লুকলা পৌঁছানোর আগেই কোভিড মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। সারা পৃথিবী থমকে দাঁড়িয়েছিল। আর আমরা পুরোদস্তুর ট্রেকারের সাজে ব্যাকপ্যাক পিঠে নিয়ে অরণ্য, প্রান্তর, নদী, পাথর, পাহাড় ও হিমবাহ পেরিয়ে অবিচল হেঁটে গিয়েছিলাম হিমালয়ে, এভারেস্টের দিকে।
ট্রেক চলাকালেই প্রথম লকডাউন শব্দটার সঙ্গে পরিচিত হই। তারপর ফিরে আসি লুকলায়। হিমালয়ের কোলে হিমশীতল ছোট্ট লোকালয়ে আটকে থেকে ওই কটা দিন সারাক্ষণ অনুপ্রাসময় লুকলাতে লকডাউন শব্দ দুটি মনে পড়ত। তারপর কাঠমান্ডুতে ফিরে এলেও দেশে–বিদেশে সব এয়ারপোর্ট বন্ধ হয়ে যাওয়াতে কয়েক সপ্তাহ আমাদের সেখানে আটকে থাকতে হয়। কঠোর লকডাউনে আবদ্ধ থেকে আমরা মহামারির সূচনাপর্বের দুর্যোগ ও বিচ্ছিন্নতা মোকাবিলা করেছি। বিধিনিষেধের মধ্যেই কর্তৃপক্ষের বিশেষ অনুমতি নিয়ে দেশে ফেরার আয়োজন করতে হয়েছে।
এত ঝঞ্ঝাট পেরিয়ে দেশে ফিরে এসে, রোগ শোক ও মৃত্যু চিহ্নিত মহামারিকাল অতিক্রম করে আবার হিমালয়ে যাওয়ার ভাবনা সহজ ছিল না। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে শুরু করে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গৃহবন্দী জীবন কাটিয়েছি আমরা সবাই। তখন দেশের অসংখ্য প্রান্তিক মানুষের দুর্দশার কথা ভেবে যেমন ব্যথিত ও বিচলিত বোধ করেছি, তেমনি চিন্তিত হয়েছি আমার হিমালয়-বন্ধুদের জন্য। হিমালয়ের পথে পথে দেখে আসা স্বল্প আয়ের পোর্টার, হোটেল কর্মী, ছোট দোকানদার, শেরপা ও অন্যান্য দরিদ্র মানুষ কেমন আছেন, এমনকি তাঁদের পোষা ঘোড়া, মহিষ, মিউল ও ইয়াকগুলো কীভাবে মহামারির এই দীর্ঘ ক্রান্তিকাল পাড়ি দিচ্ছে, এসব ভেবে দীর্ঘ বিষণ্ন বিকেল কেটেছে। নেপালের ভ্রমণসঙ্গী ও গাইডের সঙ্গে আলাপ করে সাধ্যমতো কিছু পদক্ষেপ নিতে চেষ্টা করেছি।
ইতিমধ্যে আমার বয়স বেড়েছে দুবছর। ৬৫ বছর পূর্ণ হওয়ার পর আবার সেই অসীমের পথে যাত্রার প্ল্যান শুরু করি গত বছরের অক্টোবর থেকে। নেপালের ট্রেকিং এজেন্সি, গাইড, টু৵রিজম বোর্ড পরিচালিত হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ—এসব থেকে কখনো বিচ্ছিন্ন হইনি। দুই বছর ধরে সেখানকার পর্যটকদের সুবিধা-অসুবিধা, বিভিন্ন সংকট, সরকারিনীতি সবকিছুর আপডেট পাই। এই সূত্রগুলো থেকে জানতে পারি, ২০২১ সালের অক্টোবরে ট্রেকার ও পর্যটকেরা আবার হিমালয়ের বিভিন্ন পথে যেতে শুরু করেছেন। আমার উৎসাহ থাকা সত্ত্বেও সে সময় অ্যামেজিং নেপাল ট্রেক কোম্পানির নির্মল আমাকে নিরস্ত করে। ফোনে ও ই–মেইলে আমাকে জানায়, এখনো সব লজ খোলেনি। পার্বত্য এলাকায় এখনো খাদ্য ও অন্যান্য জিনিসের সরবরাহ স্বাভাবিক হয়নি। কিছুদিন অপেক্ষা করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
শরত্কালে যেতে না পারায় শীত শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করি। করোনাবন্দি দুটি বছর কাটিয়ে এই বসন্তে আবার হিমালয়ে যাত্রা করব। শেষ পর্যন্ত রোজা ও ঈদের জন্য একটু দেরি হয়ে যায়। অবশেষে মে মাসের পাঁচ তারিখে কাঠমান্ডু পৌঁছাই।
তার আগে অনেকবার নেপালের গাইড তেজ ও অন্য বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করেছি কোন দিকে কত দূর যাব। অন্য পথে হলেও বারবার এভারেস্টের কাছে যেতে চাই। কিছু খোঁজাখুঁজি, কিছু গবেষণার পর স্থির করি, এবার যাব গোকিওতে। ইবিসির সারা পথে এভারেস্ট যেমন দেখা যায়, তার চেয়ে অনেক ভালোভাবে দেখা যায় গোকিও রি থেকে।
৫ মে বিকেলে যথেষ্ট সময় হাতে পাই। হিমালয়ে ট্রেকিংয়ের জন্য বিশেষ ধরনের জুতো, মোজা, কয়েক স্তর কাপড়চোপড়, জ্যাকেট—সবই আমার আছে। দুটি ট্রেকিং পোল আর কয়েকটি নতুন জিনিস কিনতে হবে। নিতে হবে একটি ডাউন জ্যাকেট। সব কাজ সেরে হোটেলে ফিরে সময়মতো ঘুমাতে হয়। পরদিন ভোরে যাত্রা।