অসাধারণ সেতুটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে সুলতান সুলেমানের নাম
মোস্টারে যখন পৌঁছাই, তখন দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল। তার মধ্যে ঝুমবৃষ্টি। পুরোনো ছোট্ট একটা ভবনে আমাদের হোটেল। সামনে একচিলতে উঠোন। রুমের ভেতরের অন্দরসজ্জাও পুরোনো। রুম লাগোয়া ছোট্ট একটা বারান্দা। ধাতস্থ হয়ে বসতেই হোটেল থেকে কমপ্লিমেন্টারি কফি দিয়ে গেল। বসনিয়ান কফি, নকশাকাটা সুন্দর তামার কাপ-পিরিচ। সোফায় বসে বসনিয়ান কফিতে চুমুক দিতে দিতে জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, আসলেই কি বসনিয়া-হার্জেগোভিনায় আমরা!
আমার মতো আশির দশকে যাঁদের জন্ম, তাঁদের কাছে বসনিয়া মানেই যুদ্ধবিধ্বস্ত এক দেশ। কাগজে পড়া যুদ্ধের খবরগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ১৯৯৩-৯৪ সময়কার কথা বলছি। যুগোস্লাভিয়া ভেঙে টুকরো টুকরো হওয়ার জের ধরেই এই যুদ্ধের সূত্রপাত। তখন তো আর যুদ্ধ-টুদ্ধ অত বুঝতাম না, ভাবতাম আহারে ওই দেশের মানুষগুলোর কত কষ্ট। তাই হয়তো কখনো ভাবিনি বসনিয়ায় যাব। কিন্তু যা ভাবিনি, তা–ই সত্যি হলো।
বৃষ্টি থামার জন্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। থামার সঙ্গে সঙ্গে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে চলে গেলাম। ছাদ থেকে খুব সুন্দর ভিউ—পুরো মোস্টার শহরটাই যেন দেখা যাচ্ছিল, সবকিছুর কেন্দ্রে স্টারি মোস্ট সেতু। আমাদের হোটেলের একদম কাছেই এই স্টারি মোস্ট। সতেরো শতকের বিখ্যাত অটোমান পরিব্রাজক ইভলিয়া সেলেবি তাঁর ভ্রমণকাহিনিতে লিখেছেন, ‘সেতুটা একটা রংধনুর মতো, শূন্যে ভেসে আছে আর এক পাহাড়ের ঢাল থেকে অন্য পাহাড়ের ঢালে গিয়ে মিলেছে। আমি, খোদার এক দরিদ্র-অসহায় বান্দা, পৃথিবীর ১৬টা দেশ ভ্রমণের সৌভাগ্য আমার হয়েছে, কিন্তু আকাশকে ছুঁয়ে দিয়ে নদীর এক পাড় থেকে আরেক পাড়ে চলে যাওয়া এমন সুন্দর সেতু আর কোথাও দেখিনি!’ এরপর কালে কালে পৃথিবীতে আরও হাজারো সুউচ্চ, বড় ও সুন্দর সেতু তৈরি হয়েছে, কিন্তু তা–ও আমি সেলেবির মতোই বলছি, খোদার এক নিতান্তই সামান্য বান্দা আমি, বেশ কিছু দেশ ঘুরে দেখার সৌভাগ্যও আমার হয়েছে, কিন্তু এমন ছবির মতো সুন্দর সেতু আর কোথাও দেখিনি!
হোটেলের ছাদ থেকে রিকি, আমার স্ত্রী, কয়েকটা ড্রোন শট নিয়ে নিল। শেষ বিকেলের আলোয় তোলা প্রতিটি ছবি আশ্চর্য সুন্দর। তারপর ছাদ থেকে নিচে নেমে গেলাম। হোটেলের সামনে থেকেই নদীর দিকে একটা ঢাল নেমে গেছে, ওখান থেকে খুব সুন্দর দেখায় স্টারি মোস্ট। মাত্র শেষ হওয়া বৃষ্টির কারণে নেরেভা নদীতে তখন তুমুল স্রোত। পুরো শহর থেকেই যেন সব পানি নালা বেয়ে নদীর দিকে ছুটে আসছে। নদীর পানিটা নীলচে সবুজ। সেই খরস্রোতা নদীর বুকে মাথা উঁচু করে আছে স্টারি মোস্ট। নদীর বুকে তার প্রায় অর্ধবৃত্তাকার অবয়বের প্রতিবিম্ব পড়েছে। ঢাল থেকেই দেখতে পাচ্ছি, সেতুতে হাঁটছে, দাঁড়িয়ে আছে শ খানেক মানুষ। হঠাৎ দেখি এক যুবক সেতুর ঠিক মধ্যখানে রেলিংয়ের ওপর দাঁড়িয়ে গেছেন, গায়ে ডাইভিং স্যুট। এক, দুই, তিন বলে ঝপ করে নদীতে ঝাঁপ দিলেন, প্রায় দমবন্ধ করে দেখার মতো দৃশ্য। তারপর সাঁতরে আবার পাড়ে উঠে এলেন। সবার সে কী করতালি! আসলে এটা তাঁর পেশা, ঝাঁপ দেওয়ার জন্য দর্শনার্থীরা তাঁকে টাকা দেয়, তাঁর সহকারী সংগ্রহ করেন।
এই সেতুটা দেখতে যেমন সুন্দর, এর ইতিহাসও তেমনি সমৃদ্ধ। বিখ্যাত অটোমান শাসক সুলতান সুলেমানের তত্ত্বাবধানে ১৫৫৭ সালে শুরু হয় সেতুটির নির্মাণকাজ। শেষ হয় ১৫৬৬ সালে। সেতুর স্থপতি ছিলেন মাইমার হাইরুদ্দিন। প্রায় সোয়া চার শ বছর পর ১৯৯৩ সালের ৯ নভেম্বরে ক্রোয়েশীয় বিমানবাহিনীর ছোড়া বোমার আঘাতে ধূলিসাৎ হয়ে যায় অনন্য এই সেতু। ২০০১ সাল থেকে শুরু হয় এর পুনর্নির্মাণ। প্রকৃত নকশা দেখে দেখে পনেরো শতকের নির্মাণপ্রক্রিয়া অনুসরণ ও উপকরণ ব্যবহার করে সেতুটির নির্মাণকাজ শেষ হয় ২০০৪ সালে। আমরা এখন যেটা দেখছি, সেটা আসলে রেপ্লিকা সেতু। স্টারি মোস্টই এখন মোস্টারের প্রাণকেন্দ্র, শহরটির প্রতীক।
স্টারি মোস্ট যাওয়ার রাস্তাটা পুরোটাই পায়ে হাঁটাপথ। দলে দলে পর্যটকেরা হেঁটে যাচ্ছে। দুই পাশে ছোট ছোট দোকান, স্যুভেনির শপ আর রেস্তোরাঁ। দেখলাম সব দোকানে মেয়েরাই শুধু কাজ করছে। হাসিখুশি ও প্রাণবন্ত। যুদ্ধস্মারক অনেক স্যুভেনির ছিল, তার মধ্যে যুদ্ধের সময় ব্যবহার হওয়া গুলির খোসা ছিল সবচেয়ে ইউনিক। গুলির খোসা দিয়ে চাবির রিং। দেখলে মনের মধ্যে অদ্ভুত এক অস্থিরতা তৈরি হয়। চোখের সামনে ভেসে ওঠে যুদ্ধের ভয়াবহতার ছবি। একটা জায়গায় যুদ্ধের ছবি আর স্মারকের প্রদর্শনী চলছিল। মন খারাপ করে দেওয়ার মতো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনে এগিয়ে গেলাম। সেতুর একদম গোড়ায় চলে এলাম। ততক্ষণে সেতুর মানুষ অনেক কমে গেছে। মার্বেল পাথরের তৈরি সেতুর মেঝে, স্লোপ হয়ে উঠে গেছে। মাঝেমধ্যে মার্বেল দিয়ে বিট দেওয়া, যাতে কেউ পা পিছলে পড়ে না যায়। সেতুতে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ মোস্টার শহরটা দেখলাম। তারপর ধীরে হেঁটে সেতু পার হয়ে অন্য পাড়ে চলে এলাম। এদিকটা মনে হলো আরও পুরোনো। প্রাচীন সব দালানকোঠা, বড় বড় পাথরের টুকরো দিয়ে তৈরি পথ, দূরে সুউচ্চ মিনার। এদিককার দোকানগুলো আরও পুরোনো ও দামি স্যুভেনির, কাপড় আর শিল্পসামগ্রী বিক্রি করে। ঘুরে দেখতে দেখতে একটা সুন্দর প্লাজার সামনে এলাম, যেখান থেকে প্রায় পুরো শহরটাই দেখা যায়।
এর মধ্যে সূর্যাস্ত হয়ে গেল। পাহাড়ের পেছনে সূর্য ডুবে পুরো আকাশটাকে লাল আভায় রাঙিয়ে দিয়ে গেল। আমার কাছে প্রতিটি সূর্যাস্তই সুন্দর, কিন্তু ওই দিনের সূর্যাস্তটা যেন বেশি সুন্দর। মোস্টারের পুরোনো রাস্তা ধরে প্রাচীন সব দালানের পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে নেরেভা নদীর তীরে দাঁড়াই। সামনে স্টারি মোস্ট। সেতুটা দেখার সেই মুহূর্তটা এখনো ভাবলে মনে হয়, এ যেন স্থাপনা নয়, দক্ষ শিল্পীর সুনিপুণ তুলির আঁচড়ে আঁকা অসাধারণ জলচিত্র!