পারমাণবিক জাহাজে করে উত্তর মেরু গিয়ে কী দেখলেন কৌশিক
রাশিয়ার পরমাণু শক্তিচালিত এক জাহাজে চড়ে গত ১৩ থেকে ২২ আগস্ট উত্তর মেরু ঘুরে এসেছেন রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৌশিক আহমেদ। তাঁর কাছ থেকে সেই দুর্লভ অভিজ্ঞতার গল্প শুনলেন তানভীর রহমান
সেন্ট্রাল স্পিকারে ঘোষণা শুনে হুড়মুড় করে উঠে বসি। জাহাজের স্পিকারে কেউ একজন বলে চলেছেন, এই যাত্রায় প্রথম বরফের দেখা পাওয়া গেছে। আগ্রহীরা বাইরে আসুন।
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বিছানায় উঠে বসি, ঘড়ি দেখি। সকাল ছয়টা বাজে। জানালার দিকে তাকিয়েই চোখ ফেরাতে হলো, বাইরে কড়া রোদ। এই কদিনে বিষয়টায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এ অঞ্চলে এখন গ্রীষ্মকাল, সূর্য অস্ত যায় না। ২৪ ঘণ্টাই দিন। বাইরের আলো দেখে ঠাহর করা মুশকিল কখন সকাল, ভরদুপুর আর গভীর রাত। কিছুদিন পর আবার উল্টো ঘটনা ঘটবে, সূর্যের আলো দেখা যাবে না, অন্ধকারে ডুবে থাকবে পুরো চরাচর।
আমার কেবিনমেট একজন রুশ তরুণ, নাম দানিল সিদিকভ। বেশ অতিথিপরায়ণ। দুই দিনেই ভালো বন্ধু হয়ে গেছি। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও কথা বলিয়ে দিয়েছে। জাহাজে অধিকাংশ মানুষই রুশ ভাষায় কথা বলে। আমার দোভাষীর কাজে এই বন্ধুই এখন ভরসা। দুজনে বরফ দেখব বলে কেবিন থেকে বাইরে যাই। অন্যরাও বেরিয়েছে। বারেন্টস সাগরের পানিতে বরফের ছোট ছোট চাক ভাসছে। জাহাজে ধাক্কা খেয়ে কোনো কোনোটা সরে যাচ্ছে। জাহাজ শান্ত সমুদ্রে এগিয়ে যাচ্ছে।
আস্তে আস্তে বরফের চাক বড় হতে থাকল। তারপর পানির ওপর দুধের সরের মতো জমাটবাঁধা সাদা বরফ। পুরুত্ব কম বলে অনায়াসে বরফের বুক চৌচির করে যাচ্ছে জাহাজ। দৃশ্যটা বেশিক্ষণ দেখা হলো না। বাইরে অন্য সময়ের তুলনায় তাপমাত্রা বেশি হলেও বাতাস প্রচণ্ড। কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছিল বলে কেবিনের উষ্ণতায় ফিরে যাই। কেবিনে সব সময় হিটার অন করা থাকে।
১৩ আগস্ট রাশিয়ার মুরমানস্ক বন্দর থেকে ‘ফিফটি ইয়ার্স অব ভিক্টরি’ নামের এই রুশ পারমাণবিক শক্তিচালিত জাহাজে আমাদের অভিযান শুরু হয়েছে। তারও আগে উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আমরা ভিনদেশিরা নিজেদের সম্পর্কে স্বাগত বক্তব্য রাখি। তারপর টাগবোটে টেনে জাহাজটাকে বন্দর থেকে গভীর সমুদ্রে নেওয়া হয়। এরপর বিকেলে উত্তর মেরু অভিমুখে যাত্রা।
জাহাজের জীবন একেবারে ঘড়িবাঁধা। সকাল আটটায় সবাইকে হেলিপ্যাডে হাজির হয়ে ব্যায়াম করানো হয়। তারপর নাশতার পালা। পাঁচতলা জাহাজের দোতলায় খাবারেরর ব্যবস্থা। নাশতা সেরে চলে যেতে হয় নিচতলায়, মিলনায়তনে। এখানেই বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত চলে নানা সেশন।
আমি এই অভিযানে একজন আলোচক হিসেবে অংশ নিয়েছি। গত মার্চে বিশ্ব যুব উৎসবে ‘আইসব্রেকার অব নলেজ’ নামে একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রোসাটম। আমরা সারা দুনিয়ার দুই হাজারের বেশি প্রতিযোগী অংশ নিই। চার ধাপে যাচাই-বাছাইয়ের পর ১৪ জন উত্তর মেরুর এই অভিযানে আসার সুযোগ পেয়েছি। আমাদের মতোই আলাদা একটি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে স্কুলপড়ুয়াদের একটি দল অভিযানে এসেছে। তাদের উদ্দেশ্যেই দিনে চার-পাঁচটি লেকচার দেন আলোচকেরা। এ সময় অন্য আলোচকদেরও অংশগ্রহণ করা লাগে।
জাহাজ কেঁপে উঠতে থাকল
অভিযানের তৃতীয় দিন এসে জাহাজ হঠাৎ কেঁপে কেঁপে উঠতে থাকল। অনেকের মধ্যে যখন ‘কী হয়েছে’, ‘কী হয়েছে’ আতঙ্ক, তখন কর্তৃপক্ষ বুঝিয়ে বলল, বিষয় তেমন কিছু না। বরফের পুরুত্ব বেড়েছে। বিশাল বরফে স্লাইড করে জাহাজটাকে উঠতে হয়। তারপর চাপ দিয়ে বরফ ভেঙে সামনে যাওয়ার পথ বের করে নেয়। এ সময় এমনভাবে কেঁপে ওঠে যে শক্ত করে কিছু আঁকড়ে না ধরলে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। সেদিন কর্তৃপক্ষের আশ্বাস শুনে পরিস্থিতির সঙ্গে আস্তে আস্তে মানিয়ে নিই।
লেকচার সেশনের ফাঁকে ফাঁকে বিরতি থাকে। তখন মিলনায়তন থেকে বাইরে চলে আসি। সাদা বরফে সূর্যের প্রখর আলো পড়ে চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। রোদচশমা ছাড়া তাকানো যায় না। যত দূর দৃষ্টি যায় শুধু বরফ আর বরফ। এই বরফের রাজ্যেই চলতে চলতে ১৭ আগস্ট সকালে আমরা উত্তর মেরুতে প্রবেশ করি। আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসতেই উৎসবে মেতে ওঠে সবাই। সাউন্ডবক্সে বেজে ওঠে বাংলাদেশসহ অংশগ্রহণকারী সব দেশের জাতীয় সংগীত। উত্তর মেরুতে ‘আমার সোনার বাংলা’ বাজতে শুনে গর্বে বুকটা ভরে ওঠে।
জাহাজ সকালে পৌঁছালেও বরফে নামার অনুমতি পেতে পেতে দুপুর হয়ে গেল। জাহাজের চাপে বরফে কোনো চিড় ধরে থাকলে তা যেন জমাট বাঁধার সময় পায়, সে জন্যই এই কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষা। জাহাজ থেকে একে একে নেমে যার যার দেশের পতাকা বরফে স্থাপন করি। পতাকা স্থাপনের সময় মনে হচ্ছিল, ঠিক এই দিনটির জন্যই যেন বেঁচে ছিলাম। এরপর আমার শহর ময়মনসিংহের দিক নির্ণয় করি। ময়মনসিংহ থেকে এখানকার দূরত্বসংবলিত একটি দিকনির্দেশনা খুঁটি লাগিয়ে দিই আর সেই সঙ্গে জুড়ে দিই একটা নোট। যেখানে আছে বাংলাদেশের নাম ও পতাকা, আমার মায়ের নাম আর আমার স্বাক্ষর।
এরপর রোমাঞ্চকর পর্বের হাতছানি। বরফ খুঁড়ে সাহসী কয়েকজন শরীরে দড়ি বেঁধে বরফপানিতে ঝাঁপ দিল। কয়েক সেকেন্ড থাকার পর তাকে বাকিরা টেনে তুলল। আমি দাঁড়িয়েই উপভোগ করলাম। একে সাঁতার জানি না, তার ওপর ঠান্ডা, আমার সাহস হলো না।
ততক্ষণে জাহাজ থেকে মনস্টার ট্রাক নামানো হয়েছে। আমরা কয়েকজন ট্রাকে চড়ে বসলাম। আমাদের নিয়ে আশপাশে ঘুরে বেড়ালেন চালক। শ্বেতভালুক দর্শনের ইচ্ছা ছিল খুব। কিন্তু চারপাশে এত কুয়াশা ছিল যে ‘ভালুক মামা’ আশপাশে থাকলেও দেখা যেত না।
এই কদিনে প্রায় সবার সঙ্গেই বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। মনস্টার ট্রাকে ঘোরাঘুরি শেষে তাঁদের সঙ্গে ‘বরফকেলি’তে মেতে উঠলাম। তারপর আবারও উঠে পড়লাম জাহাজে।
লাখো পাখির দ্বীপ
১৮ আগস্ট ফিরতি পথ ধরে জাহাজ। তবে যে পথে এসেছি, সে পথে না। অন্য পথে মুরমানস্ক ফিরছি আমরা। ১৯ আগস্ট বিকেল নাগাদ আমরা ফ্রাঞ্জ জোসেফ ল্যান্ডে পৌঁছাই। ১৮৭৩ সালে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির যৌথ অভিযানে উত্তর মেরুতে এসে অভিযাত্রী জুলিয়াস ভন পেয়ার এবং কার্ল ওয়েপ্রেক্ট আর্কটিক সাগরের দ্বীপপুঞ্জটি আবিষ্কার করেন। ১৯১ দ্বীপ নিয়ে জায়গাটা ছবির মতো সুন্দর। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রজাতির আর্কটিক প্রাণী, সিল, পাখি, ডলফিন, তিমি ইত্যাদির দেখা মিলল। অভিযানে আমরা প্রথম যে বরফের চাক দেখেছি, তা এই এলাকা থেকেই ভেঙে ভেঙে যায়।
ফ্রাঞ্জ জোসেফ ল্যান্ডে যাত্রাবিরতিতে আমরা যেখানে নামি সেটা ‘বার্ডস আইল্যান্ড’ নামে পরিচিত। চারপাশে তাকিয়ে মনে হলো সত্যিই পাখির রাজ্যে ঢুকে পড়েছি। একসঙ্গে এত পাখি জীবনে দেখিনি! পাখির কিচিরমিচিরে কান পাতা দায়। লাখ লাখ পাখির বাসা এই দ্বীপে। ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে বাসায় ঢুকছে আর বের হচ্ছে।
বার্ডস আইল্যান্ডের সময়টা মনে গেঁথে নিয়ে জাহাজে উঠে পড়ি। সেই যে জাহাজ ছাড়ল, এরপর আর কোথাও যাত্রাবিরতি দেওয়া হলো না। একে একে কাটতে থাকল দিন। জাহাজের মিলনায়তনে চলতে থাকল নিয়মিত লেকচার, সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা, বারবিকিউ নাইট, ট্রেনিং প্রোগ্রাম। ২২ আগস্ট সকাল সাতটায় মুরমানস্ক বন্দরে পৌঁছালাম আমরা।