বিমান উড়িয়ে বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকার অভিজ্ঞতা শোনালেন ফাহিম
স্বাধীনতাসংগ্রামীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বিজয়ের মাসে যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে বিমান উড়িয়ে বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকলেন ফাহিম চৌধুরী। কীভাবে মানচিত্রটা আঁকলেন, সজীব মিয়াকে সেই গল্পই শোনালেন এই বাংলাদেশি বৈমানিক
দেশের গ্যালাক্সি ফ্লাইং একাডেমি থেকে গত বছর প্রাইভেট পাইলটের কোর্স করি। এরপর এ বছরই যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের গ্লোবাল এভিয়েশন সেন্টারে ভর্তি হই। এই ফ্লাইট স্কুলে বাণিজ্যিক উড়োজাহাজের পাইলট হতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছি। আরও ভালোভাবে কীভাবে নিজেকে প্রস্তুত করতে পারি, সব সময় সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছি। এই কাজ করতে করতেই মাথায় বাসা বাঁধে অভিনব কিছু করার পোকা।
‘ফোর ফ্লাইট’ নামে একটি অ্যাপ আছে। সেটা ব্যবহার করে ফ্লাইট ট্র্যাক করা যায়। প্লেন কোথায় যাচ্ছে, কত উচ্চতায় উড়ছে, তার সবিস্তার অ্যাপে আঁকা হতে থাকে। অ্যাপটি ব্যবহার করে অনেকে প্লেন চালিয়ে মজার নানা কিছু আঁকার চেষ্টা করেন। কখনো ভালোবাসা প্রকাশ করে কারও নাম লেখেন, কখনো আঁকেন স্বদেশের মানচিত্র। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে সেসব ভাইরালও হয়েছে। আমিও ভাবলাম আমার দেশ নিয়েও কিছু একটা করি।
তবে বাংলাদেশের মানচিত্র নিয়ে কাজ করাটা একটু চ্যালেঞ্জিং। কারণ, আমাদের মানচিত্রে এত বেশি মোচড় যে একটু এদিক-সেদিক হলেই কাজটা নষ্ট হয়ে যাবে। সব শুনে এ কাজে আমাকে সহায়তা করতে এগিয়ে এলেন আফগান বন্ধু আসাদ আবদুল্লাহ। আমরা বিজয় দিবস মাথায় রেখে পরিকল্পনা করলাম। স্থানীয় বেসরকারি রিপাবলিক এয়ারপোর্ট এভিয়েশন সেন্টার থেকে একটা প্লেন বুকিং দিয়েও রাখলাম। এই দেশে প্রাইভেট পাইলটের লাইসেন্স থাকলে যে কেউ ইচ্ছেমতো প্লেন ভাড়া করে চালাতে পারেন।
১৪ ডিসেম্বর আসাদের সঙ্গে খুঁটিনাটি বিষয়ে কথা বলার সময় দেখলাম, পরের দুদিন আবহাওয়া খারাপ থাকবে। ১৬ ডিসেম্বর রাতে বৃষ্টিও হতে পারে। আবার চাইলেও আমরা দিনে চালাতে পারব না। কারণ, দিনের বেলা যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে প্রচুর ট্রাফিক থাকে, মানে বিভিন্ন গন্তব্যে বিমান চলাচল করে। সে সময় নিজের ইচ্ছেমতো চালানো যায় না, ট্রাফিকের কারণে অনেক সময় ছেড়ে দিতে হয় পথ। তখন আসাদ বললেন, দিন-তারিখ তো বড় কথা নয়, তুমি কাজটা করতে চেয়েছ, আজই করে ফেলো।
যে এভিয়েশন সেন্টার থেকে প্লেন ভাড়া করেছিলাম, তার মালিক আবার আসাদের পরিচিত। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে কল করলেন আসাদ। ভাগ্য সুপ্রসন্নই বলতে হবে, তাঁদের সেসনা ১৭২ মডেলের এয়ারক্র্যাফটটা সেদিন ভাড়া হয়নি, হ্যাঙ্গারেই পড়ে আছে। তাঁকে বলা হলো, ১৬ ডিসেম্বর নয়, আজ রাতেই প্লেনটা নিতে চাই আমরা।
সে–ও রাজি।
রাত নয়টার দিকে আমরা চলে গেলাম। কত হাজার ফুট উচ্চতায় ফ্লাই করব, কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করব, জরুরি অবস্থায় কোন কোন বিমানবন্দরে অবতরণের সুবিধা পাব, কতটুকু এলাকাজুড়ে আমরা কাজটা করব, কতটুকু জ্বালানি নিতে হবে—প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতি নিলাম। এরপর এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারের (এটিসি) অনুমতি নিলাম।
১৪ ডিসেম্বর রাতে ককপিটে বসলাম। পাশে আসাদ। দুজনের কাছেই আইপ্যাড। সেখানে পুরো ম্যাপ রেডি। সঙ্গে জিপিএস যুক্ত করা আছে। মানচিত্র জুম করে নিয়ে আসাদ দেখে দেখে বলবে কোথায় টার্ন নেব। রাত ১১টার দিকে এভাবেই টেকঅফ করলাম।
মানচিত্রের বরিশাল অঞ্চল দিয়ে শুরু হলো আমাদের যাত্রা। খুলনা, সাতক্ষীরা হয়ে উত্তরবঙ্গের দিকে চলে গেলাম। যুক্তরাষ্ট্রে রাতে এটাই আমার প্রথম ওড়া। হিমাঙ্কের নিচে তাপমাত্রা এখন। তীব্র শীতের সঙ্গে মানিয়ে উঠতে পারিনি। বেশ কষ্টই হচ্ছিল। তবু চেষ্টা করে চালাচ্ছিলাম।
উত্তরবঙ্গের দিকে প্রচুর বাঁক নিতে হলো। এটিসি থেকে আমাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করা হচ্ছিল। তাদের বললাম, ‘আমরা মানচিত্র আঁকার চেষ্টা করছি।’ তারা আর কিছু বলল না। এভাবে ময়মনসিংহ, সিলেট হয়ে চট্টগ্রামে চলে এলাম। উড্ডয়নের পর যে বিন্দু থেকে মানচিত্র আঁকা শুরু করেছিলাম, আবার সেই বিন্দুতে পৌঁছে রানওয়ের পথ ধরলাম। এতক্ষণ পর আইপ্যাডে জুম আউট করতেই দেখি, বাংলাদেশের মানচিত্র ফুটে উঠেছে। আসাদের মুখেও বিজয়ের হাসি। আকাশে মানচিত্র শতভাগ সঠিকভাবে আঁকা যায় না, তবে যতটুকু হয়েছে, তাতেই খুশি।
সেই খুশি নিয়েই ১৫ ডিসেম্বর রাত ১টা ৫৪ মিনিটে অবতরণ করলাম। প্রায় তিন ঘণ্টায় ২৯০ নটিক্যাল মাইল পরিভ্রমণ করেছি আমরা।
সেদিনই ফেসবুকে ছবিসহ মানচিত্র আঁকার প্রেক্ষাপট ছোট করে লিখে পোস্ট করি। সঙ্গে সঙ্গে হাজার মানুষ সেটা শেয়ার করে। অনেক গণমাধ্যম খবরও প্রকাশ করে। আসলে মানচিত্রটি তৈরি করতে গিয়ে অনেক আবেগ অনুভব করেছি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে মানুষের যে ত্যাগ ও সংগ্রাম, তা কখনোই ভুলে যাওয়ার নয়। বিজয়ের মাসে মাতৃভূমির মানচিত্র এঁকে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছি।