নরসিংদীর মাসুদ সাইকেল নিয়ে ঘুরছেন আফ্রিকার দেশে দেশে, ছেড়েছেন ব্যবসা
ভারতের বিভিন্ন রাজ্য ঘুরেটুরে প্রায় তিন মাস আগে দিল্লি থেকে উড়াল দিয়ে যান পূর্ব আফ্রিকার দেশ কেনিয়ায়। সেখানে দিন দশেক থেকে তারপর একে একে উগান্ডা, রুয়ান্ডা, বুরুন্ডি ও তানজানিয়া। এই পথে তাঁর একমাত্র সঙ্গী বাইসাইকেল। এরপর কোথায় যাবেন মোহাম্মদ মাসুদ? উত্তর জানতে গিয়ে তাঁর জীবনগল্পটাও শুনেছেন সজীব মিয়া
এরপর কোন দেশে যাচ্ছেন?
মাস তিনেক ধরে প্রশ্নটা মোহাম্মদ মাসুদকে হরদম শুনতে হচ্ছে। উত্তরটাও তাই ঠোঁটের কাছে প্রস্তুত। কেনিয়া থাকতে বলতেন রুয়ান্ডা, রুয়ান্ডায় এসে বলেছেন উগান্ডা। ৫ জুলাই তানজানিয়া থেকে মেসেঞ্জারে কথা বলার সময় বললেন, ‘মোজাম্বিক যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। নির্ভর করছে ভিসাপ্রাপ্তির ওপর। মোজাম্বিকে যেতে না পারলে মালাউই বা জাম্বিয়ায় যাওয়ার চেষ্টা করব।’
আসলে সহজ ভিসাপ্রাপ্তির কথা মাথায় রেখেই তৈরি হয়েছে মাসুদের ভ্রমণসূচি। বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীরা সহজে যেতে পারেন, এমন দেশের খোঁজ করতে গিয়েই পূর্ব আফ্রিকায় পা রেখেছেন তিনি। দুই চাকায় ভর করে ছুটে যাচ্ছেন এক দেশ থেকে আরেক দেশ। সেই ধারাবাহিকতায় ২৩ জুন প্রবেশ করেছেন তানজানিয়ায়। দেশটার বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে ঘুরে এখন আছেন কিলিমাঞ্জারো। কিলিমাঞ্জারোতে কেন?
‘এখানে আমি দুজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছি। তাঁরা বাংলাদেশি পর্যটক। অনলাইনে আলাপ হয়েছিল। দেখা করেই অন্য কোনো গন্তব্যে চলে যাব,’ বলেন মাসুদ।
মাসুদের অত তাড়াও নেই। তিনি ছুটে চলেছেন আপন খেয়ালে। যেখানে স্থানীয় মানুষ আর প্রকৃতির রূপ ভালো লাগে, দুদিন বেশি থাকেন। যেখানে মন টানে না, সেখান থেকে দ্রুত পাততাড়ি গুটিয়ে প্যাডল মারতে শুরু করেন। চলতে চলতে যেখানে রাত, সেখানেই কাত। কখনো জনবসতির কাছে তাঁবু পড়ে, কখনো স্কুলের বারান্দায়, মসজিদে কাটে রাত, আবার স্থানীয় ব্যক্তিদেরও আতিথ্য নেন মাঝেসাঝে। তিনি বলছিলেন, ‘বাইসাইকেল থাকায় যাতায়াতে আমার তেমন কোনো খরচ নেই। খাওয়াদাওয়াও করি সাধ্যের মধ্যে। নিজেও রান্না করি অনেক সময়। বাধ্য না হলে গেস্টহাউসে থাকি না।’
এভাবে পথকেই ঠিকানা করে নিয়েছেন মোহাম্মদ মাসুদ।
টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া
২০১৩ সালে এসএসসি পাস করার পর পড়াশোনায় আর উৎসাহ পাননি মোহাম্মদ মাসুদ। ভোকেশনাল ট্রেনিংয়ের সূত্রে নরসিংদীর মনোহরদী শহরে বাড়ির পাশে মুঠোফোনের ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশের দোকান দেন। সেখানে মোবাইল-কম্পিউটার সারাইয়ের কাজও করতেন। ব্যবসাটাও বেশ জমে উঠেছিল। এর মধ্যেই ভ্রমণের বাই চাপল। সেটা কবে? মাসুদ বলেন, ‘খুব বেশি দিন আগে নয়। বছর দুই আগে ভ্রমণবিষয়ক ভ্লগ দেখে দেখে ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছাটা জাগে।’
বেরিয়ে পড়লেন মাসুদ। কখনো বাসে করে সিলেট-শ্রীমঙ্গল, কখনো লঞ্চে বরিশাল। ট্রেনে-বাসে-লঞ্চে ঘুরতে ঘুরতে মাসুদের মনে হলো, দেশটা ঠিকঠাক দেখা হচ্ছে না, শুধুই ঘুরছেন। তখন নিরাপদ আর ধীরগতির বাহন হিসেবে বাইসাইকেল বেছে নেন। বাইসাইকেল কেনার গল্পটাও মজার, ‘নতুন একটা সাইকেল কিনতে ঢাকা গিয়েছিলাম। তারপর অনেকের পরামর্শ শুনে মনে হলো সেকেন্ড হ্যান্ড কেনাই ভালো। অনলাইনে খুঁজেটুজে পেয়েও গেলাম। মিরপুর থেকে আট হাজার টাকায় সেই সাইকেল কিনেই চলে গেলাম টাঙ্গাইল!’
সেই সাইকেলে চেপেই ঢাকা থেকে তেঁতুলিয়া গেছেন মাসুদ। সেখান থেকে আবার টেকনাফের পথ ধরেছেন। কয়েক শ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে যেদিন টেকনাফ পৌঁছালেন, সেদিনই মাসুদের মনে হলো একটু পাহাড়ে না গেলে হয়! চলে গেলেন থানচি। সে–ও দুই চাকায় ভর করে।
মাসুদের বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা জালাল উদ্দিন। নায়েব সুবেদার হিসেবে বিজিবি থেকে অবসর নিয়েছেন। তিন ভাই, এক বোনের মধ্যে মাসুদ তৃতীয়। ছেলের এই ভ্রমণ–বাই দেখে শুরুতে অনেক বুঝিয়েছেন মা শিরিন সুলতানা, ব্যবসায় মনোযোগী হতে বলেছেন। একসময় বুঝলেন ছেলেকে বলে লাভ নেই, ‘বাসা থেকে এখন আর কিছু বলে না। দোকানটাও বিক্রি করে দিয়েছি। এখন খুব আনন্দ নিয়ে ঘুরছি,’ বলেন মাসুদ।
কাছের বিদেশ
দেশের আনাচকানাচে ঘুরে মাসুদের মন তখন বিদেশ বিদেশ করছে। অধিকাংশ বাংলাদেশির মতো তাঁরও বিদেশ ভ্রমণের শুরুটা ভারত দিয়েই হয়। প্রথম কেনা সাইকেল বিক্রি করে আরেকটি সাইকেল কেনেন মাসুদ। সেই সাইকেল নিয়েই ভারতে যাবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু বিভ্রান্ত হলেন এক সাইক্লিস্টের কথায়। ভারতীয় ভিসা আনতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে পরিচয়। তিনি মাসুদকে জানিয়েছিলেন বিদেশে সাইকেল নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া জটিল। গত সেপ্টেম্বরে সাইকেলটা বেচেই তাই ভারতে গেলেন মাসুদ। এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে ঘুরতে থাকলেন। ঘুরতে ঘুরতে মহারাষ্ট্রে একটা রাস্তা দেখে মনে হলো, ‘এই পথে সাইকেল না চালালে জীবনটাই বৃথা!’
পকেটে টাকা ছিল না। দেশ থেকে ক্রেডিট কার্ডে ডলার এনডোর্স করে নিলেন। বেঙ্গালুরু গিয়ে ৫৭ হাজার রুপিতে একটা বাইসাইকেল কিনে ফেললেন।
তারপর? ‘তিন মাসের সিঙ্গেল এন্ট্রি ভিসা ছিল। সাইকেল কেনার দিন ভিসার মেয়াদ ছিল ২৮ দিন। সেই সাইকেল নিয়েই ছুটলাম গোয়া,’ যোগ করেন মাসুদ।
ভারতে ঘুরেটুরে গত নভেম্বরে সাইকেল নিয়েই দেশে ফেরেন মাসুদ। স্থলবন্দরে এসে বুঝেছেন সাইকেল নিয়ে বিদেশে যাওয়ার ঝক্কি পোহানোর তথ্যটা তাঁকে ভুল দেওয়া হয়েছিল। এরপর একটু বিরতি দিয়ে ভিসা করিয়ে আবার ভারতে গেলেন। ৩ জানুয়ারি থেকে কয়েক মাস ঘুরে সেখান থেকেই পূর্ব আফ্রিকার ভিসার আবেদন করেন। সেই ভিসা পেয়ে কলকাতায় সাইকেল রেখে দেশে ফিরেছিলেন ২৯ মার্চ। দিন কয়েক থেকে আবার ভারত। ১২ এপ্রিল সেখান থেকে বিমানে কেনিয়ার নাইরোবি বিমানবন্দরে। সঙ্গে নিয়ে যান প্রিয় বাইসাইকেলটা।
চারাটা বড় হবে ‘বাংলাদেশ’ হয়ে
এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে পৌঁছে নতুন এক পৃথিবীর দেখা পান মোহাম্মদ মাসুদ। মানুষের গায়ের রং আলাদা, মুখের আদল, খানাখাদ্যও আলাদা। তবে মানুষগুলোকে মনে হলো সহজ–সরল। তাঁদের সঙ্গে মিশতে অসুবিধা হলো না। পথে পথে অতিথির মতো মাসুদকেও বরণ করে নিলেন কেনিয়ার মানুষ। সেভাবে গন্তব্য ঠিক করা নেই। রুয়ান্ডার সীমান্তে পৌঁছাতে খুব সময় নিয়ে দেখেশুনে পথ চলছিলেন। নাইরোবি শহর ছাড়া দিন সাতেক পর এলমা রাভাইন নামের এক এলাকায় পৌঁছান। সরকারি একটা প্রাইমারি স্কুলে তাঁবু পেতেছিলেন। পরদিন সকালে স্কুল থেকে বিদায় নেবেন, এমন সময় স্কুলের প্রধান শিক্ষক এসে হাজির। তিনি মাসুদকে বললেন, চলেই যখন যাবে, একটা গাছের চারা রোপণ করে যাও।
স্কুল প্রাঙ্গণে একটা গাছের চারা রোপণ করলেন মাসুদ। সেই চারার নাম দিয়ে এসেছেন ‘বাংলাদেশ’।
কেনিয়ার স্কুলটায় মাসুদ হয়তো আর কোনো দিন যাবেন না। তবে তাঁর স্মৃতি হয়ে বড় হতে থাকবে গাছের চারাটা, যার সঙ্গে মিশে থাকবে বাংলাদেশের নাম।
পথের বিপদ, পথের বন্ধু
উগান্ডার নাকাপিরিপিরিত থেকে মরোতোর দূরত্ব প্রায় ১০০ কিলোমিটার। পার্বত্য এলাকার মধ্য দিয়ে চলে গেছে মহাসড়ক। শহর ছেড়ে আসার পর ভীষণ একাকিত্ব ভর করল। পথের পাশে শুধু পাহাড় আর জঙ্গল। কোনো জনবসতি নেই, মানুষেরও দেখা নেই। শাঁই শাঁই করে তাঁকে পেছনে ফেলে বড় বড় লরি চলে যায়। অজানা জায়গা, জিরানোর জন্য থামতেও সাহস হয় না। দিনটার বর্ণনা দিচ্ছিলেন মাসুদ, ‘খুব কষ্ট হয়েছে সেদিন। খিদে পেয়েছিল, ভেবেছিলাম পথে কোথাও খেয়ে নেব। সেটা আর হয়নি। আর মানুষের দেখা না পেয়ে ভয়ে ভয়ে পথ চলতে হয়েছে। এবারের যাত্রায় সবচেয়ে ভয়াবহ দিনটা সেদিনই পার করেছি।’
উগান্ডারই আরেকটি দিনের কথা মাসুদ ভুলতে পারবেন না। সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিলেন। পথে ভাড়ায় চালিত প্রচুর মোটরসাইকেল। এক চালক অযাচিতভাবে এসে মাসুদের সাইকেলে লাগিয়ে দেন। মাসুদ ছিটকে পড়েন। হাতে ব্যথা পেয়ে আহত হন, সাইকেলটাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শয্যাশায়ী থাকতে হয় কয়েক দিন।
রেবেকা পোকারের আতিথ্য অবশ্য মাসুদকে সেদিনের বাজে অভিজ্ঞতার কথা ভুলিয়ে দিয়েছে। তানজানিয়ার ট্যুর অপারেটর রেবেকার সঙ্গে এক ফেসবুক গ্রুপে মাসুদের পরিচয়। তানজানিয়ায় প্রবেশ করতে ইমিগ্রেশনে মাসুদের কাছে জানতে চাওয়া হলো, ‘আপনি যে তানজানিয়ায় যাবেন, দেশটির কোনো নাগরিকের রেফারেন্স বা আমন্ত্রণপত্র আছে?’
মাসুদের কিছুই ছিল না। একজন ট্রাভেল এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করলে রেফারেন্স বাবদ ৫০ ডলার চাইলেন। মাসুদের হঠাৎই মনে হলো রেবেকার কথা। মেসেঞ্জারে তাঁকে সুপারিশের কথা বলতেই চেনা বন্ধুর মতো নিজের বাসার ঠিকানা আর মোবাইল নম্বর দিয়ে দিলেন রেবেকা। তাঁর এই উদারতার কথা ভুলবেন না মাসুদ। ঈদের আগের দিন তানজানিয়ায় আরুশ এলাকায় পৌঁছে দেখা করেন রেবেকার পরিবারের সঙ্গে। ‘রেবেকার স্বামী ইমানুয়েল দারুণ মানুষ। বাচ্চাগুলো আমাকে পেয়ে উদ্বেলিত হয়। আরাম–আয়েশে ওদের বাসায় দুদিন থাকি,’ মাসুদের কথায় আতিথ্যের মুগ্ধতা।
পথে পথে পাওয়া এই আতিথেয়তাই মাসুদকে সাহস জুগিয়েছে সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে যেতে, দূরদেশকেও আপন ভাবতে।