সমুদ্র ও মরুভূমির মিলন যেখানে
নামিবিয়ার সোয়াকোপমন্ডের সল্ট জ্যাকাস হোটেলে প্রচণ্ড ঠান্ডায় কাঁপছি। শহরটা মরুভূমির ওপর, তারপরও তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সেটাকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে আটলান্টিকের বাতাস।
দিনে অস্বস্তিকর গরম, বিকেল গড়াতেই জেঁকে বসে তীব্র শীত—সোয়াকোপমন্ড এলাকার তাপমাত্রা এমনই বিচিত্র। নামিবিয়ার রাজধানী উইন্ডহোক থেকে ২৮০ কিলোমিটার পশ্চিমের এই শহর দেশের প্রধান সমুদ্রতীরবর্তী এলাকা। আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূলে অবস্থিত সোয়াকোপমন্ডের মানুষজনের প্রধান অবলম্বন মাছ।
অবশ্য আমাদের এই শহরে আসার কারণ নামিব। পৃথিবীর সবচেয়ে শুষ্ক স্থানগুলোর একটি এই মরুভূমি। তিনটি দেশে প্রায় ৮১ হাজার বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত নামিব। কমপক্ষে ৫৫ মিলিয়ন বছর বয়সী নামিবকে বিশ্বের প্রাচীনতম মরুভূমি বলে মনে করা হয়। অঞ্চলটার কোথাও মঙ্গল গ্রহের মতো উঁচু বালুর টিলা, কোথাও এবড়োখেবড়ো পাহাড়, আবার কোথাও বা নুড়ি সমভূমি। গ্রীষ্মে তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, রাতে এটাই আবার হিমাঙ্কের নিচে নেমে যায়। পৃথিবীর অন্যতম পুরোনো সমুদ্র ও মরুভূমি এখানে মিলেমিশে আছে।
পরদিন ভোরের সূর্য ফোটার আগেই হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়ি। বিভিন্ন দেশের ছয় পর্যটককে নিয়ে মরুর বুক চিরে ছুটে চলল আমাদের ল্যান্ড ক্রুজার। মরুভূমির মধ্যে সরু রাস্তা। ওয়ালভিস বে হয়ে স্যান্ডউইচ হারবার আমাদের গন্তব্য। যেতে যেতে দেখছি অপূর্ব সুন্দর প্রকৃতি। চোখ ধাঁধানো বললে অত্যুক্তি হবে না। এক দিকে মরুভূমির উপত্যকা, ঠিক তারই পাশে সমুদ্রের ঢেউ।
মরুভূমির মধ্যে তখন মধ্যদুপুর। প্রচণ্ড খরতাপ, কোথাও মরুর বালু উড়ছে। একটির পর একটি মরুর উপত্যকা পার হয়ে যাচ্ছে আমাদের ল্যান্ড ক্রুজার। আচমকা এক উঁচু স্থান থেকে গাড়িটি পড়ে যেতে যেতে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিলেন চালক।
পথে পড়ল সোসুসভলেই। এটি সংরক্ষিত এলাকা। নামিব মরুভূমির যে জায়গাগুলোয় পর্যটক আসেন সবচেয়ে বেশি, তারই একটি এই সোসুসভলেই। জায়গাটা অদ্ভুত। বড় লাল টিলা ঘিরে সাদা ধবধবে লবণ।
নামিবের আরেকটি আশ্চর্য এলাকা স্যান্ডউইচ হারবার। এখানেই আটলান্টিকে গিয়ে মিশেছে মরুভূমি। এই জায়গাটা পেরিয়ে আমরা যাই ওয়ালভিস বে বন্দর। এখানে রয়েছে এমন একটি হ্রদ, যা দেখে মনে হয়েছে বুঝি কোনো জলজ আর পাখপাখালির দুনিয়ায় চলে এসেছি। ছোটাছুটি করছে হাজারো ফ্লেমিংগো, নীল পানির ওপর ওড়াউড়ি করছে বিভিন্ন ধরনের পাখি। স্টার ফিশগুলো ঢেউয়ের সঙ্গে এদিক-সেদিক ভাসছে।
ওয়ালভিস উপদ্বীপ থেকে ১৩ কিলোমিটার ড্রাইভ করার পর পৌঁছালাম পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু বালুর টিলার কাছে। বিকেলের সূর্য তখন গড়িয়ে পড়ছে মরু উপত্যকার বাঁকে। চলন্ত গাড়ির জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে অপূর্ব সোনালি রঙের উপত্যকা। তার কোল ঘেঁষে সূর্যটা ডুবে যাচ্ছে। পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো মরুভূমি নামিব অঞ্চলের প্রতিটি স্থান যেন স্বর্গের প্রতিচ্ছবি।