‘দ্রুত সবাই জাহাজের ভেতরে প্রবেশ করো, আবহাওয়া অত্যন্ত বিপজ্জনক’
সব মিলিয়ে ১২ দিনের অভিযাত্রা। এর মধ্যে যেতে-আসতেই ছয় দিন শেষ। অ্যান্টার্কটিকার সাগর-উপসাগরে ঘুরে ঘুরে কেটেছে বাকি ছয় দিন। কখনো কখনো জাহাজ থেকে নেমে ছোট নৌকায় ভেসে ভেসে দেখেছেন পেঙ্গুইনের কীর্তিকলাপ, কখনো বরফঢাকা অ্যান্টার্কটিকার ওপর করেছেন হাইকিং। অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রার সেই গল্প শোনাচ্ছেন মহুয়া রউফ। আজ পড়ুন বিংশ পর্ব
তন্দ্রামতো এসেছিল। হঠাৎ শব্দ। টেবিল থেকে জিনিসপত্র ছিটকে পড়ছে। বিছানা ছেড়ে উঠতে গিয়ে গড়িয়ে পড়ার দশা। বসে পড়লাম। আমাদের অ্যান্টার্কটিকা অভিযান শেষ। অ্যান্টার্কটিকা ছেড়ে উসুয়াইয়া বন্দরের দিকে যাচ্ছে জাহাজ। এখন ড্রেক প্যাসেজে ঢুকেছে।
আমি জানি, এ সময় কী ঘটে। আগেই সাবধান হওয়া দরকার ছিল। ব্যবহারের যত জিনিস ড্রেসিং টেবিলের ওপর ছিল, সব পড়ে গেছে। অন্ধকারে বুঝতে পারছি না কয়টা জিনিস ভাঙল আর কয়টা অক্ষত থাকল। ভাগ্যিস ল্যাপটপটা ফ্লোরে রেখেছিলাম। ছড়িয়ে–ছিটিয়ে পড়া সবকিছু আবার ড্রয়ারে রাখছি। একদিকে পড়ছে, আরেক দিকে তুলছি। ভাবছি, পর্দা সরিয়ে কি একবার দেখার চেষ্টা করব কেমন শক্তি এই তরঙ্গের! সাহসে কুলাল না।
মুঠোফোনটাও পড়েছিল, মেঝেতে কার্পেট ছিল তাই রক্ষা। দুই পাল্লার আলমারির দরজা দুটি খুলে গেছে। গেলাম বন্ধ করতে, আছড়ে পড়লাম মেঝেতে। নাস্তা রুমের লাইট জ্বালাল, আমাকে টেনে তুলল। জাহাজ যেই ডানে কাত হচ্ছে, ওয়াশরুমের দরজাটা খুলে দেয়ালের সঙ্গে বিকট শব্দে বাড়ি খাচ্ছে। আবার জাহাজ যখন বাঁয়ে কাত হচ্ছে, সেই দরজা আবার ঝপাৎ করে আটকে যাচ্ছে। দেশে দরজায় খিল থাকে, খিল আটকে দেওয়া যায়। জাহাজের ওয়াশরুমের দরজায় খিল থাকা জরুরি ছিল। আমার পানির ফ্লাস্কটা মেঝেতে পড়ে গিয়ে গড়িয়ে যত দূর গেছে, তত দূরই পানিতে ভিজে গেছে। পায়ে আমার মোজা পরা ছিল, মেঝের পানিতে মোজা ভিজে গেল। মোজা খুলে যে আরেক জোড়া পরব, তার উপায়ও নেই, খুঁজে পাচ্ছি না। জিনিস সামলাতে সামলাতে জিনিসের স্তূপ জমে গেল। সমুদ্র বোধ হয় বেশিই খেপেছে।
সকালে নাশতা খেয়ে সবে কেবিনে ফিরেছি। নাস্তা বলল, ‘জাহাজে নাকি হাট বসেছে, চলো যাই, দোতলায়।’ আমি তো অবাক! মারিয়ার নেতৃত্বে নানান সু্৵ভেনির নিয়ে বসেছে কয়েকজন গাইড। বিক্রির ধুম লেগেছে। সবাই একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। আমি তিনটি টি-শার্ট কিনলাম। দুই ছেলে আর স্বামীর জন্য। টি-শার্টের সামনের–পেছনের ছবি দেখলেই বোঝা যায় এটি অ্যান্টার্কটিকা এবং অ্যান্টার্কটিকাগামী জাহাজের স্মৃতিচিহ্ন।
এ অসময়ে ঘোষণা—প্রেজেন্টেশন হবে! আমি তো ভেবেছিলাম, হেসেখেলে ছবি তুলতে তুলতে দুই দিন কাটিয়ে দেব। কঠিন বিষয়ে প্রেজেন্টেশন শুরু করেছে। অ্যান্টার্কটিকার ইতিহাস, জলবায়ু পরিবর্তন, পক্ষিকুল, একটি নয় পরপর দুটি লেকচার। প্রেজেন্টার আমাদের একজন গাইড। তাঁকে দেখে অবাক হই। তিনি জোডিয়াক চালাচ্ছেন, প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন, আবার কী কঠিন কঠিন বিষয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন। শ্রদ্ধা-ভক্তিতে মাথা নত হয়। অসাধারণ লেকচার তাঁর।
প্রেজেন্টার বলছেন, চিন্তাবিদেরা পৃথিবীর উত্তর অংশ নিয়ে বেশ আগে থেকেই জানতেন। তাই তাঁরা ধরেই নিয়েছেন, ভারসাম্য রক্ষার জন্য দক্ষিণেও আরেকটি অংশ আছে। উত্তরের নাম যেহেতু আগে থেকেই দেওয়া ছিল আর্কটিক, দক্ষিণ অংশ হওয়া উচিত এর বিপরীত, অর্থাৎ অ্যান্টি-আর্কটিক। এই সূত্র ধরে হয়ে গেল অ্যান্টার্কটিকা। তবে এরও বহু আগে টলেমির যুগে এর নাম দেওয়া হয়েছিল অ্যান্টার্টিকোস (Antartikos); যার অর্থ অপোজিট টু বিয়ার। বিয়ার অর্থ উত্তর গোলার্ধের নক্ষত্রপুঞ্জ; আমরা বাংলায় যাকে বলি সপ্তর্ষিমণ্ডল। দক্ষিণ গোলার্ধ থেকে সপ্তর্ষিমণ্ডল দেখা যায় না, তাই এমন উল্টিয়ে নাম রাখা। তিনি বলছেন, অ্যান্টার্কটিকার যে রূপ আমরা এখন দেখছি, সেটি গঠিত হয়েছে ২৫ লাখ বছর আগে। আরও আশ্চর্যের তথ্য হলো, ১৭০ মিলিয়ন বছর আগে নাকি এটি ভারত ও আফ্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিল।
২০ মিনিটের বিরতি। জাহাজ দুলছে। বহু কষ্টে জাহাজের ভারী লোহার দরজা খুলে বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করি। ডেকে দাঁড়িয়ে থাকা মুশকিল। বসলাম। প্রবল বাতাস। পানির দিকে দৃষ্টি দিলে শ্বাস বন্ধ হয়। কয়েকটি ডলফিন দেখলাম মনে হলো! ভয়ংকর পানি থেকে হঠাৎ চোখ ফিরিয়ে নিলাম। আকাশে পাখির ঝাঁক। জাহাজের সঙ্গে উড়ছে। পাখি নিয়ে আমার বিদ্যা কম। অ্যান্টার্কটিকার আকাশের যে পাখি বেশি ধবধবে, সেটি আমার কাছে পেট্রেলস। আর সাদা–কালো মিলিয়ে যেটি, সেটি নিশ্চয়ই অ্যালবাট্রস। পেট্রেলসকে বলা হয় সর্বদক্ষিণের পাখি। এরা ঘর বাঁধে এই বরফের মহাদেশের পর্বতমালায়। তাদের ঘ্রাণশক্তি তীব্র; যা অন্য পাখির থাকে না। ঘ্রাণশক্তি দিয়ে সহজে তারা মৃত প্রাণী খুঁজে বের করে, তার আহার জোটে। যতই উড়ে আসুক না কেন, তারা যে উসুয়াইয়া পর্যন্ত যাবে না, তা আমি জানি। পেট্রেলস নাকি স্বামী-স্ত্রীর সমান অধিকারে বিশ্বাস করে, দুজনে মিলে সন্তান লালন–পালন করে। জাহাজের লেকচারেই শুনেছি, অ্যালবাট্রস নাকি সঙ্গী বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে খুব খুঁতখুঁতে, তবে একবার যাকে বেছে নেবে, সহজে তার সঙ্গে বিচ্ছেদ হবে না।
সমুদ্রের পানির ঝাপটায় ডেক প্লাবিত। পিছলে পড়ার আশঙ্কা ব্যাপক। ঘোষণা এল, ‘দ্রুত সবাই জাহাজের ভেতরে প্রবেশ করো, আবহাওয়া অত্যন্ত বিপজ্জনক।’ মাথা ঘুরছে আমার। মনে হচ্ছে, জাহাজটা উল্টেই যাবে। প্রাণপণ চেষ্টা করছি জাহাজের ভারী দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতে।
আরও পড়ুন
১. অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রা কীভাবে শুরু হয়?
২. ৭২ জন ‘গোপাল ভাঁড়ের’ সঙ্গে অ্যান্টার্কটিকা যাত্রা
৩. ‘তোমরা আমাকে যেকোনো সময় হাগ করতে পারো’
৪. আকাশে এখনো কোনো অ্যালবাট্রস পাখির দেখা মেলেনি
৫. অ্যান্টার্কটিকার জাহাজে খেতে দিল রুটি আর বেগুন ভাজি
৬. অ্যান্টার্কটিকায় প্রথম সন্তান প্রসব করেছিলেন যে নারী
৭. সাগরের পানিকে কেন বলা হতো কালাপানি
৮. অ্যান্টার্কটিকায় গিয়ে জাহাজ থেকে অভিযাত্রীদের যেভাবে নামতে হয়
৯. অ্যান্টার্কটিকায় পৌঁছে অভিযাত্রীদের মধ্যে আমিই প্রথম জাহাজ থেকে নামলাম
১০. দ্বীপটিতে পেঙ্গুইন ছাড়া আর কিছু নেই
১১. তিনটি তিমি আমাদের ঘিরে ধরল
১২. অ্যান্টার্কটিকায় যেভাবে উদ্যাপিত হলো জন্মদিন
১৩. পৃথিবীর সবচেয়ে দূরের ডাকঘর থেকে দুই ছেলেকে চিঠি পাঠালাম
১৪. মাসে মাত্র ১০০ শব্দের বার্তা পাঠাতে পারতেন তাঁরা, এতেই হতো যোগাযোগ
১৫. নদীপারের মেয়ে আমি কিন্তু বইঠা হাতে নিয়েছি আজই প্রথম
১৬. রূপপুরে কাজ করতে আসবে রাশিয়ার ওলগা, তাঁর সঙ্গে দেখা অ্যান্টার্কটিকায়
১৭. কবরের মতো বরফ খুঁড়ে সেখানেই থাকতে হয় রাতভর
১৮. একেকজন এগিয়ে যাচ্ছেন আর লাফিয়ে পড়ছেন সাগরের হিমশীতল পানিতে
১৯. এটি পৃথিবীর একমাত্র আগ্নেয়গিরি, যার কেন্দ্রে জাহাজ নিয়ে যাওয়া যায়