এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় বৌদ্ধমন্দির, কোথায় জানেন?
ইন্দোনেশিয়া ভ্রমণ-পরিকল্পনার সময় থেকেই বরোবুদুর যাওয়ার ইচ্ছা। তাই সাত দিনের বালি দ্বীপ ভ্রমণের মধ্যেই একটা দিন বিস্ময়কর জায়গাটার জন্য বের করলাম। ভোরেই ঘুম থেকে উঠে রেডি হয়ে চলে গেলাম বালি বিমানবন্দরে। গন্তব্য যোগজাকার্তায়।
ইন্দোনেশিয়ার মোট ১৭ হাজার দ্বীপ আছে, তার মধ্যে ৬ হাজার দ্বীপে মানুষ থাকে। এর মধ্যে জাভা, সুমাত্রা, বোর্নিও, সুলাওয়েসি অন্যতম বড় দ্বীপ। বালি দ্বীপের ঠিক পশ্চিম পাশেই লম্বাটে আকারের জাভা। আর জাভার ঠিক মাঝামাঝি যোগজাকার্তা শহর। সংক্ষেপে ‘যোগজা’।
দেড় ঘণ্টার উড়ান শেষে যোগজাকার্তা পৌঁছাই। বিমানবন্দর থেকেই সারা দিনের জন্য ট্যাক্সি নিয়ে নিই। সোয়া ঘণ্টায় শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে আমার আপাতগন্তব্যে পৌঁছে যাই। সেখানে নেমে লাইনে দাঁড়িয়ে সুসজ্জিত আধুনিক টিকিট কাউন্টার থেকে টিকিট কিনি। এরপর গেট পেরিয়ে মূল চত্বরে ঢুকে অন্য পর্যটকদের পিছু পিছু হাঁটতে থাকি। দূরে পথের শেষে বিশাল এক স্থাপনা দেখে হঠাৎ থমকে দাঁড়াই। এটিই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বৌদ্ধমন্দির, নাম বরোবুদুর! ‘বরো’ মানে ‘বড়’ আর ‘বুদুর’ মানে ‘বুদ্ধ’।
খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে সমুদ্রপথে বাণিজ্যিক জাহাজে চেপে ইন্দোনেশিয়াতেও আসে বৌদ্ধধর্ম। বিভিন্ন রাজবংশের পৃষ্ঠপোষকতায় একসময় এই দ্বীপগুলোর অন্যতম প্রধান ধর্ম হয়ে ওঠে বৌদ্ধধর্ম। একসময় অন্য দেশ থেকেও অনেকে বৌদ্ধধর্ম নিয়ে পড়াশোনা করতে এখানে আসতেন। বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রাম থেকে সুমাত্রা দ্বীপে এসে টানা ১২ বছর অধ্যয়ন করেন আমাদের অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান।
সেই সময়ই জাভার শৈলেন্দ্র রাজবংশের বৌদ্ধ রাজাদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় বরোবুদুর। কী উদ্দেশ্যে কে এই বিশাল মন্দির স্থাপন করেছিলেন, সে বিষয়ে কোনো লিখিত দলিল পাওয়া যায়নি। তবে কারুকাজ ও নির্মাণশৈলীর ধরন দেখে ধারণা করা হয় যে অষ্টম শতাব্দীতে কাজ শুরু হয়ে ৮২৫ সালে বরোবুদুর মন্দিরের নির্মাণকাজ শেষ হয়। একেক দিকে ৩৮৭ ফুট লম্বা বর্গাকৃতির এই মন্দির বিশ্বের সবচেয়ে বড় বৌদ্ধ স্থাপনা।
৯২৮ থেকে ১০০৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ছাইভস্মের নিচে চাপা পড়ে ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে বরোবুদুর মন্দির। ছাইয়ের ওপরে মাটির ঢিবি তৈরি হতে থাকে, গাছপালা গজিয়ে জঙ্গলে পরিণত হয় পুরো এলাকা। আর চতুর্দশ শতাব্দীতে জাভা দ্বীপে ইসলাম ধর্মের ব্যাপক প্রসার হওয়ার পর চোখের সঙ্গে সঙ্গে মনেরও আড়াল হয়ে যায় বরোবুদুর।
১৮১৪ সালে এখানে এসে পাহাড় আর জঙ্গলের মাঝে প্রাচীন কোনো স্থাপনার অস্তিত্ব খুঁজে পান জাভা দ্বীপের গভর্নর ও পরে সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠাতা স্যার স্ট্যামফোর্ড র্যাফেলস। তাঁর নির্দেশে ডাচ প্রকৌশলী হেরম্যান কর্নেলিয়াসের নেতৃত্বে ২০০ লোক ৪৫ দিন ধরে জঙ্গল কেটে, আগুনে পুড়িয়ে, মাটি খুঁড়ে পুরো এলাকা সাফসুতরো করে। আক্ষরিকভাবেই মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে বরোবুদুর। পরে ডাচ শাসকদের হাত ঘুরে ইউনেসকো এর পুরোনো রূপ ফিরিয়ে দেয়।
কাছে গিয়ে মন্দিরের ব্যাপকতা আর বিশালতা দেখে অবাক হই। কী অদ্ভুত মুনশিয়ানায় আগাগোড়া প্রতিসাম্য বজায় রেখে নয়টা প্ল্যাটফর্ম বা স্তরের ওপর তৈরি হয়েছে এই মন্দির! নিচের ছয়টা স্তরের পাটাতন চারকোনা, ওপরের তিনটা বৃত্তাকার। বৌদ্ধদের মান্ডালা রীতির অনুসরণে এই বিশাল স্থাপনা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ধার্মিকদের জন্য প্রতিটা স্তরে উঠে মন্দির প্রদক্ষিণ বা পরিক্রমা করার সুনির্দিষ্ট নিয়ম আছে। সিঁড়ি বেয়ে প্রতিটি তলায় উঠে করিডরের দুই পাশে পাথরের তৈরি লম্বা দেয়ালজোড়া কারুকাজ আর খোদাই করা দৃশ্যাবলি দেখে মুগ্ধ হই। দেয়ালের পাথর খুদে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বৌদ্ধধর্মের নানা গল্প আর তখনকার সমাজের বিভিন্ন চিত্র।
বরোবুদুর মন্দিরের মূল আকর্ষণ অনেকগুলো ঘণ্টা আকৃতির স্তূপ। মন্দিরের শীর্ষে মাঝখানের মূল স্তূপের চারদিকে আছে ঘণ্টা আকৃতির ৭২টি বিশাল স্তূপ। প্রতিটি স্তূপের ভেতরেই আছে গৌতম বুদ্ধের একেকটা মূর্তি। পদ্মাসনে বসা বুদ্ধমূর্তির হাতের ভঙ্গিতে নানা রকম মুদ্রা।
মনের চোখে দেখতে পাই প্রাচীন জাভায় আকাশছোঁয়া এক স্থাপনার প্রতিটি স্তরে বৌদ্ধধর্মগুরুরা গম্ভীর মুখে প্রদক্ষিণ করছেন কিংবা মুদিত চক্ষে স্থির হয়ে বসে মৌনচিত্তে ধ্যান করছেন। হয়তো শোনা যাচ্ছে সমবেত প্রার্থনার অস্পষ্ট ধ্বনি কিংবা চারদিকজুড়ে শুধুই অখণ্ড নীরবতা।
খাড়া সিঁড়ি বেয়ে চূড়া পর্যন্ত উঠে ঘুরে ঘুরে দেখে নেমে আসি। এরপর এগিয়ে যাই আমার পরবর্তী গন্তব্যের দিকে।